বিএনপি ও সমমনাদের আন্দোলন হুমকি কিভাবে দেখছে সরকারি দল

29

ঢাকা প্রতিনিধি

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। তৃণমূল পর্যায়ের প্রস্তুতি শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। সরকারি দল আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে দল ও সহযোগী সংগঠনকে তৃণমূল পর্যন্ত সুসংগঠিত করার পাশাপাশি নির্বাচনকেন্দ্রিক কাজগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। বিরোধীদের অপপ্রচারের জবাব দিতে ও উন্নয়ন কর্মকান্ড জনগণের সামনে তুলে ধরতেও মাঠে নামছে দলটি। এছাড়া দলীয় প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু না হলেও বিভিন্ন জরিপ এবং তথ্য সংগ্রহের মাধমে আওয়ামী লীগ এ কাজটিও এগিয়ে রাখছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায় ।
অপরদিকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও দেখা যাচ্ছে নানা তৎপরতা। এর মধ্যে কেউ জাতীয় সরকারের দাবি জানাচ্ছেন, কেউ বলছেন আগে নির্দলীয় সরকার। এদিকে আগামী নির্বাচন নিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম জানিয়েছেন, আগে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। নির্বাচিত হলে আন্দোলনে থাকা সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠন করা হবে জাতীয় সরকার। বিএনপির সরকারের ধারণাটি হলো, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। এ লক্ষ্যে যে আন্দোলন হবে সে আন্দোলনে যারা থাকবেন তারা নির্বাচনে বিজয়ী না হলেও তাদের সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে।
বিএনপি’র এ ঘোঘণার পর থেকেই রাজনীতিতে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। দলটির এই অবস্থানকে ইতিবাচক বলেই ভাবছে সরকারবিরোধী অন্যান্য দলগুলো। বিএনপি জাতীয় সরকারের দাবির বিষয়ে একমত হয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়তে অন্য দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করেছিল আগেই।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সব দলকে নিয়ে বৃহৎ জোট গঠনে সরকারবিরোধী সব দলের সঙ্গে বৈঠক শেষ করতে নানামুখী তৎপরতাও শুরু করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। এ জন্য ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করছেন তারা। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কেউ এককভাবে আবার দলগতভাবে এসব দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন।
বিএনপি নেতারা জানান, বৈঠকে দলগুলো বিভিন্ন প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছে। প্রত্যেক দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে দলের হাইকমান্ড এসব প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করে জোট গঠনের চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরি করবে। বৈঠকে বেশিরভাগ দল জোটের পরিবর্তে যুগপৎ আন্দোলনের পক্ষে সায় দিচ্ছে। আবার অনেকে নির্বাচনকালীন সরকারের এক দফা দাবির বিষয়ে বলছেন। কোনো কোনো দলের নেতারা জাতীয় সরকার ইস্যুতে মাঠে নামার প্রস্তাব দিচ্ছেন বলেও জানা গেছে। একই সঙ্গে জামায়াত ইস্যুতেও ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করছে। কেউ জামায়াতের সঙ্গ পুরোপুরি ত্যাগ করার জন্য বললেও বেশিরভাগ দল জামায়াতকে জোটে নয়, যুগপৎ আন্দোলনে পাশে রাখার বিষয়ে মত দিয়েছেন।
সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকার হটাতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে ছোট-খাটো ‘বিভেদ ভুলে’ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, আজকে এক দিকে বাংলাদেশের ভয়াবহ অর্থনৈতিক অবস্থা, আইনশৃঙ্খলা অবস্থা, দুর্নীতি সর্বব্যাপী অবস্থা, দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় অবস্থা আর অন্যদিকে রাজনৈতিক অবস্থা।
এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব অনেক বেশি, এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। এজন্য দলগুলোর মধ্যে থাকা যে কোনো ধরনের বিভেদের অবসান ঘটানা আহŸান জানান বিএনপি মহাসচিব।
ফখরুল বলেন, আসুন আমাদের মধ্যকার ছোট-খাটো বিরোধ ভুলে গিয়ে দেশে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার জন্য, দেশকে রক্ষা করার জন্য, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার জন্য আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই যে জালেম গণতন্ত্রবিরোধী সরকার যারা, আমাদের ওপরে চেপে বসে আছে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা এদেরকে সরে যেতে বাধ্য করি, পদত্যাগে বাধ্য করি।
এদিকে বিএনপি ও সমমনাদের সরকারবিরোধী জোট গঠন নিয়ে গতকাল বুধবার কৃষক লীগের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে বামদলসহ আরও কিছু নেতা যুক্ত হয়ে সরকার উৎখাতে ‘ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন’। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, আওয়ামী লীগের অপরাধ কী?।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি একটি বিষয় একটু বলতে চাই, এখানে আমি দেখি, প্রায়ই শুনি বক্তৃতায়, আমাদের দেশে কিছু নেতা আছে দুঃসময়ে মানুষের পাশে কতটুকু দাঁড়িয়েছে, সেটা জানি না।
করোনাকালীন সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সাহায্য করেছে কি না, সেটার কিন্তু কোনো লক্ষণ আমরা দেখি নাই। তবে তারা খুব আন্দোলনের জন্য ব্যস্ত।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কিছু ব্যক্তিও জোট বেঁধেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে বিএনপি-জামায়াত জোট, তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আমাদের মান্না সাহেব, ড. কামাল হোসেনসহ তাদের এক গ্রæপ। সেই সাথে আবার যুক্ত কমিউনিস্ট পার্টি এবং আমাদের বাম দল। এই যে বাসদ টাসদ আর কারা কারা। তারা সবাই নাকি এক হয়ে আন্দোলন করবে আওয়ামী লীগ সরকারকে হটাবে।
সরকার উৎখাতে এমন তৎপরতার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা খুব আন্দোলনের জন্য ব্যস্ত। কী?… এই সরকারকে হটাতে হবে। কোন সরকার? আওয়ামী লীগ সরকার।
আমার প্রশ্ন, অপরাধটা কী আওয়ামী লীগের? এটা (উন্নয়ন) কী তাদের ভালো লাগেনি? সেই জন্যই তারা এই সরকারকে হটাতে চায়?
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে আমরা উন্নীত হয়েছি। আমার প্রশ্ন, এটা কি তাদের ভালো লাগেনি? সেই জন্যই তারা এই সরকারকে হটাতে চায়?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই যে একটা মানুষ যার কোনো জমি নেই, ঘর নেই কিছু নেই, একটি ঘর পাওয়ার পর তার জীবন জীবিকার পথ সে খুঁজে পাচ্ছে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, এটাই কি আওয়ামী লীগের অপরাধ? এই জন্যই কি এই সরকার হটাতে হবে?
যারা সরকার উৎখাত করতে চায় তাদের উদ্দেশ্য কী? জানতে চেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এই মানুষগুলোকে এই সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে দেওয়া? এটাই তাদের লক্ষ্য? এটাই তাদের উদ্দেশ্য?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এককভাবে আন্দোলন করার সক্ষমতা হারিয়ে বিএনপি এখন অন্যদের দলে টানার চেষ্টা করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কোনো প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন বিএনপির এই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
গতকাল তার দপ্তরে ব্রিফিংকালে বিএনপিকে হাতের তালু দিয়ে আকাশ ঢাকার ব্যর্থচেষ্টা না করার আহব্বান জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, জনগণ অবিরাম মিথ্যাচার শুনতে শুনতে এখন আপনাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দেওয়া প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, গত নির্বাচনের আগেও বিএনপির ঐক্যের কিম্ভুতকিমাকার চেহারা দেশের মানুষ দেখেছে।
ঐক্যের নামে বিএনপি ও সমমনাদের মধ্যে লেজে গোবরে অবস্থা দেশের মানুষের স্মৃতি থেকে এখনও মুছে যাওয়ার কথা নয় জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, তাদের মধ্যে ঐক্যের চেয়ে দূরত্বই বেশি। তিনি বলেন, একঘরে হয়ে বিএনপি আসলে এখন হতাশাগ্রস্ত।
ঈদের পর অন্যান্য দলকে নিয়ে বিএনপির আন্দোলনে নামার বিষয়ে গতকাল তথ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিবকদের এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, তাদের আন্দোলন কোন ঈদের পরে? আমরা গত ১২-১৩ বছর ধরে ঈদের পরে, রোজার পরে, বার্ষিক পরীক্ষার পরে, শীতের পরে, বর্ষার পরে তাদের আন্দোলন হবে এরকম শুনে আসছি। তাই কোন ঈদের পরে সেটি একটু খোলসা করলে ভালো হয়। মির্জা ফখরুল সাহেবরা বেকায়দায় পড়ে গেছেন, তাদের পাকিস্তানপ্রীতি ক’দিন আগে উন্মোচিত হয়েছে, সেকারণে তারা উল্টো কথা বলছেন’ বলেন তথ্যমন্ত্রী।
ড. হাছান মাহমুদ বলেন, যে দলের জন্ম অগণতান্ত্রিকভাবে, সেই দলের নেতা যখন গণতন্ত্রের কথা বলে তখন মানুষ হাসে। সুতরাং বিএনপির গণতন্ত্রের কথা বলার অধিকার কতটুকু আছে সেটিই প্রশ্ন।
তিনি বলেন, যাদের জন্মটা অগণতান্ত্রিকভাবে, ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে ক্ষমতা দখল করে সেই ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে রাজনীতির কাকদের সমন্বয় ঘটিয়ে যে দলের জন্ম, সেই দলের নেতা যখন গণতন্ত্রের কথা বলে মানুষ হাসে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে ১৯৭১ এর ১৭ এপ্রিল যে সরকার গঠিত হয়েছিল, জিয়াউর রহমান সেই সরকারের ৪০০ টাকা বেতনের চাকুরে ছিলেন এবং নিয়মিত বেতন গ্রহণ করেছেন।
এদিকে বিএনপির সরকারবিরোধী বৃহত্তর জোট গঠন প্রসঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং তারপরে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য কীভাবে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হবে সে বিষয়ে নিশ্চয়ই আলাপ আলোচনা হবে। তবে এই আলোচনা কীভাবে হবে, বিএনপি অন্যদলকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে এমন প্রশ্ন রয়েছে সমমনা অন্যান্য দলের নেতাদের মাঝে।