বাড়ছে মানুষ …

20

কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম

বিশ্বে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে বহু শিশু জন্ম গ্রহণ করছে। বাড়ছে মানুষের সংখ্যা। প্রায় সাতশো কোটি মানুষের আবাস বর্তমানের এই পৃথিবী। মানুষ বাড়লে কী হবে, প্রকৃত মানুষের সংখ্যা তো খুঁজে নিতে হচ্ছে কষ্ট করে। সেই সৎ মানুষ বরং দিন দিন কমছে। আপনি আমি আমাদের সামনে দেখছি কত মানুষ। চেহারায়, কথা-বার্তা ও চলনে বলনে কোন পার্থক্য নেই। যেন সাক্ষাত ফেরেশতা! কিন্তু যখন কথা বলবেন, লেনদেন করবেন তখন বুঝবেন তার আসল পরিচয়। যখন ভেতরেরটা জানবেন তখন হয়তো চোখ কপালে উঠবে। এ কী দেখছি? হ্যাঁ, এমনই মানুষ জগৎটাই।
যারা পৃথিবীর এখানে ওখানে নানা ধরনের অপরাধ করে বেড়াচ্ছে তারা কী মানুষের কাতারে পড়ে? দেখতে মানুষের মতো মনে হলেও প্রকৃত অর্থে মনুষ্যত্ববর্জিত একটি পশুর সমান। এমন মানুষের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলেছে। সত্যবাদি, ন্যায়নিষ্ঠ মানুষের বড় আকাল পড়েছে। মানুষের মনমেজাজ যেন ক্রমশঃ সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যে কারণে পারিবারিক ও সামাজিক অশান্তি লেগেই আছে।
মানুষের অর্থবিত্ত, অহমিকা আর অবৈধ কর্মকাÐের কমতি নেই। যে যেভাবে পারছে কামাই করে নিচ্ছে সহায়সম্পদ। কিন্তু সততার সাথে, নির্লোভ মনোভাব নিয়ে কয়জনই বা তার জীবন চালাচ্ছে ? জীবন গঠন ও হালাল রুজিরোজগারের পথ বেছে নিচ্ছেই বা কারা? এমন মানুষ আমি আপনি খুঁজে পাবোই বা কয়জন? হ্যাঁ, নেই সেটা বলা যাবেনা। কিন্তু তা খুবই নগণ্যসংখ্যক। এই মানুষগুলোই দিনদিন কমছে। কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে কষ্ট করে এসব মানুষকে খুঁজে নিতে হবে।
মানুষের প্রতি মানুষের সহযোগিতা সংকুচিত হয়ে আসছে। পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে নোংরা বাক্যবাণে। ছাড় দেওয়ার মানসিকতা কারো নেই। মানুষকে তার অধিকার ফিরে পেতে প্রচুর বেগ পেতে হচ্ছে। এর কারণ নানা ধরনের চাপ ও প্রভাবের কাছে নতিস্বীকার। কিন্তু সহজে এবং স্বাভাবিকভাবে মানুষের এ অধিকার পাওয়ার কথা। দুর্বল ও অসহায় মানুষ প্রভাবশালীদের কাছে সর্বদা পরাস্ত! নিজেদের সম্মান কিংবা বেঁচে থাকার তাগিদে এসব মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। কিছু বলারও থাকেনা। বললে প্রাণনাশের হুমকি-ধামকিসহ নানা নিপীড়ণের সম্মুখীন হতে হয়। এসব মানুষের কারণে প্রকৃত মানুষেরা অসহায়। জুলুম, নির্যাতনের শিকার হয় তারা। সমাজে এই নির্যাতনকারীদের সংখ্যাই বাড়ছে। ভালো মানুষের কদর নেই। থাকলেও তা একেবারে ছিটেফোঁটা।
আমাদের সমাজে মানুষ অনেক। কিন্তু বিপদে কয়জনকে পাশে পাবেন? গ্রামে সহযোগিতার পরিবেশ কিছুটা বিরাজ করলেও শহরে এক ফ্ল্যাটে থেকেও পাশের ঘরে একজন মানুষ বিপদে পড়লে বা মারা গেলে কেউ খবরই নেয়না!
প্রকৃত মানুষ কমার কারণে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধটুকুও বিলুপ্তির পথে। কে কাকে ঠকাবে, কে কাকে সম্মানহানি করবে তার প্রতিযোগিতা চলছে যেন। অফিস-আদালত কিংবা ব্যবসাবাণিজ্যে কত মানুষ সৎ আছেন? আদৌ কি আছে? ঘুষ গ্রহণ কিংবা অবৈধ উপায়ে অর্জন করেনা এমন মানুষ কয়জন পাবেন? সামান্য বাজার করতে গিয়ে দেখবেন পঁচা/খারাপ জিনিস কীভাবে তাজা/ভালো বলে আমাকে, আপনাকে গছিয়ে দেয়! ঠেরও পাওয়া যায়না। আমাদের মাযহাবের ইমাম হযরত আবু হানিফা (রা:) এর ব্যবসায় সততার কথা কি আমরা জানি? একবার ইমাম আবু হানিফার সাথে একটি ব্যবসার অংশীদার ছিলেন বসরার জনৈক লোক। একবার ইমাম আবু হানিফা তাকে ৭০টি মূল্যবান কাপড় পাঠিয়েছিলেন এবং সেগুলোর সাথে আলাদা করে লিখে দিয়েছিলেন, “এই কাপড়গুলোর একটিতে খুঁত আছে, সেটি হলো অমুক কাপড়টি । সুতরাং, আপনি যখন কাপড়গুলো বিক্রি করবেন তখন ভালো করে খেয়াল রাখবেন যেন কাপড়ের সমস্যাটি ক্রেতাকে উল্লেখ করে দেয়া হয়।”
ইমাম আবু হানিফার ব্যবসার অংশীদার সেই লোকটি কাপড়গুলো ৩০ হাজার দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করেন এবং যখন তিনি টাকাসহ আবু হানিফার কাছে এলেন, তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, “আপনি কি কাপড়ের খুঁতগুলো বলে দিয়েছিলেন?” বসরার লোকটি উত্তর দিলেন,”আমি ভুলে গিয়েছিলাম।” আবু হানিফা সেই কাপড় বিক্রির মুনাফা থেকে কিছুই গ্রহণ করেননি বরং তার সবটুকুই সাদাকাহ করে দিয়েছিলেন।” এমন মানুষ কি এ যুগে আছে? আমরাতো খারাপটাও ভালো বলে চালিয়ে দিতে পারলেই বাঁচি।
এভাবে জীবনচলার প্রতি পদক্ষেপে দেখা মিলবে অগণিত মুখোশধারী ভালো মানুষের! কাজেকর্মে উন্মোচিত হয় এসব মানুষের প্রকৃত চরিত্র। স্বার্থের বেলায় আমি আপনি সবাই এক। কেউ কারো চেয়ে কম যাইনা। মানুষ চেনার কোন যন্ত্র থাকলে হয়তো প্রকৃত মানুষের খোঁজ পাওয়াও কষ্টকর হতো। যখন ঝগড়াবিবাদে লিপ্ত হয় কিংবা কারো সাথে সম্পর্কের টানাপোড়ন চলে তখন বোঝা যায় মানুষের আচরণ সম্পর্কে। অপরের বিরুদ্ধে কটূ কথা বলতে, গীবত করতে পিছপা হইনা।
আমাদেরকে ভালো মানুষ, সৎ মানুষ বাড়ানোর কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। যে মানুষ অপরের বিপদে, দুঃখের সময় পাশে দাঁড়াবে, কারো ক্ষতি করার মানসিকতা থাকবেনা -এমন মানুষ তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণের মাধ্যমে ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নৈতিকতা জাগ্রত করার কোন বিকল্প নেই। আগের সময়ে অনেক মানুষ ক্ষুদ্র একটি কাজ করতে গেলেও তাতে অবৈধ বা অসততা রয়েছে কিনা যাচাই করতো। অন্ততপক্ষে সেসময় খারাপ মানুষের সংখ্যা কম ছিল। এখন তার উল্টোটাই! যে যতো খারাপ কাজ কিংবা মানুষের ক্ষতি করা যায় এখন যেন তার প্রতিযোগিতা চলছে। কোন ধরনের বাছবিচার নেই। এজন্য সর্বক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও একটি সুন্দর সমাজ গড়তে ভালো মানুষ, প্রকৃত মানুষ তৈরি অত্যন্ত জরুরি। একজনের জন্য আরেকজনের ত্যাগের, ছাড়ের মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। আমিত্ব পরিহার করতে পারলে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠা সহজ হবে। অপরের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়াতে পারলে ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে।
আসুন ভালো মানুষ হই, ভালো মানুষের সংখ্যা বাড়াই। মহান আল্লাহ আমাদের নৈতিকতাবোধসম্পন্ন একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার তাওফীক দিন। আমিন।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট