বাজেট বইয়ে ‘স্বাবলম্বী’, অথচ অভাবে বন্ধ লেখাপড়া

36

বাবা-মা অসুস্থ, তিন ভাইয়ের একজন প্রতিবন্ধী ও বাকি দুজন রাজধানীর দুটি কাপড়ের দোকানে কাজ করে কোনোমতে নিজের খরচ চালান। লালবাগের এই পরিবারেই আরেকজন সদস্য হলেন ফারজানা। বাবার সঙ্গে টেইলারে কাজ করে এবার এসএসসি পাস করেছেন। কিন্তু অনাগত দিনগুলো নিয়ে এখন তার দুচোখজুড়ে আঁধারের ঘনঘটা। ঠিক এমন একটা পরিস্থিতিতেই ফারজানার জীবনালেখ্যকে জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ায় কেসস্টাডি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ‘বিকশিত শিশু: সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ শীর্ষক শিশু-বাজেট বইতে।
বাজেট-বইয়ে ফারজানার পরিবারে অভাব-অনটন না থাকার কথা বলা হলেও বাস্তবের চিত্র খানিকটা উল্টো। মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও শুধু অভাবের কারণে তার উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির বিষয়েই শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অথচ শিশু বাজেট-বইয়ের দশম অধ্যায়ে পঞ্চম স্মারণীতে ‘স্বাবলম্বী’ হিসেবে দেখানো হয়েছে আঠারো বছরের এই তরুণীকে। তাকে ২০০৮ সালে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়)-এর মাধ্যমে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা প্রদানের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল।
শিশু বাজেট এর বইতে জীবনের গল্পকে কেসস্টাডি হিসেবে উপস্থাপিত হওয়ার খবর শুনে ফারজানা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। হাসিমুখে বিস্ময়ও প্রকাশ করলেন কিছুটা। জানালেন পারিবারিক অভাব-অনটনের কথা, অর্থের অভাবে উচ্চমাধ্যমিকের লেখাপড়া অনিশ্চয়তার মুখে পড়ার কথা। গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে লালবাগের শহীদনগরের ২ নম্বর গলির শেষ মাথায় ‘ইসরাত টেইলার্স অ্যান্ড ফেব্রিক্স’ এর দোকানে বসে কথা বলেন ফারজানা। এসময় তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহের কথাও জানান।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের শিশু বাজেট সংক্রান্ত বইতে ফারজানাকে নিয়ে বলা হয়েছে, ‘দুঃখ, কষ্ট আর বাস্তবতার সাথে লড়াই করে কাটছিল ফারজানা ও তাদের পরিবারের জীবন। ওদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল ৬ জন। ফারজানার বাবা মো. হুমায়ূন ও মা মাজেদা এবং ফারজানার তিন ভাই। ওরা বসবাস করতো ঢাকা শহরের লালবাগ শহীদনগর ৩নং গলির একটি বাড়িতে। বাবা একটি সামান্য দোকানে কাজ করে যে অর্থ উপার্জন করতো তাতে তাদের বাসা ভাড়া দিয়ে তিন বেলা খাবার ঠিকমতো জুটত না, শিক্ষা গ্রহণের কোনও সুযোগ ছিল না।’
বাজেট-বইয়ে আরও বলা হয়, ‘সময়টা ছিল অক্টোবর, ২০০৬ । শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্পের মাধ্যমে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ফারজানাকে নির্বাচিত করা হয়। প্রকল্পের মাধ্যমে এই সুযোগ পেয়ে ফারজানা লালবাগ এলাকায় প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ফারজানার বয়স এখন ২০ বছর এবং ফারজানার বাবা হুমায়ূন অসুস্থ। প্রকল্পের মাধ্যমে পরিচালিত টেইলারিং এর দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে লালবাগের শহীদ নগর এলাকার ২নং গলিতে ফারজানা দোকান দেয়। এখন সে নিজে সেলাই-এর কাজ করে অর্থ উপার্জন করে তার পুরো সংসার এবং ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছে। এখন তাদের সংসারে কোনও অভাব অনটন নেই। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এই প্রকল্পের মাধ্যমে এরকম অনেক ফারজানার জীবনে পরিবর্তন এসেছে।’
সরেজমিনে যা জানা যায়: কেস স্টাডিতে ‘ফারজানা ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছে’ এমন তথ্য দেওয়া হলেও সরেজমিনে গিয়ে কথা বলার সময় তিনি জানান, তার দুই ভাই রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে ভিন্ন দুটি কাপড়ের দোকানে কাজ করেন। আরেক ভাই প্রতিবন্ধী। বাবা-মা দু’জনই অসুস্থ।
জীবন সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে ফারজানা জানান- ২০০৮ সালে তার বয়স যখন ৯ বছর, তখন পিএসসি পরীক্ষার আগে অর্থসংকটে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। সেসময় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের মাধ্যমে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি নির্বাচিত হন। সেখানে ছয় মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। বাবা টেইলার্স মাস্টার হওয়ার পর সেখানেই কাজ শুরু করেন তিনি। বাবার কাছ থেকে হাতে কলমে টেইলারিং-এর ওপর প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে চাচা ও ফুপুর সহযোগিতায় কাজের পাশাপাশি ২০১৪ সালে আবারও লেখাপড়া শুরু করেন। এ বছর এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ করতে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।
তবে প্রতিবন্ধকতার কাছে পরাজিত না হয়ে আগামীর সময়-রাঙানো-স্বপ্নের কথা বলছেন ফারজানা। জানিয়েছেন, লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ও গার্মেন্টস-এর মালিক হওয়ার ইচ্ছার কথা। বর্তমান সংকটের প্রসঙ্গে ফারজানা আরও বলেন, ‘এখন কলেজে ভর্তি হতে চাই। কিন্তু এবারও অর্থ সংকটে সেটি সম্ভব হয়ে উঠছে না। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
মেয়েকে নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেছেন বাবা হুমায়ূন। বাজেট-বইয়ে মেয়ের সংগ্রামের গল্প উঠে আসায় আনন্দ প্রকাশ তিনি বলেন, ‘ওই সময়ে পরিবারকে সাহায্য করতে আমার মেয়ের জন্য প্রশিক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি চাই আমার সন্তান যেন আমার মতো কষ্ট করে না চলে। তার পরিবার যেন সচ্ছল থাকে।’
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের সুপারভাইজার জেসমিন আহমেদ পলি বলেন, ‘মেয়েটির শেখার আগ্রহ ছিল। সে অল্পতেই অনেক ভালো করতে পেরেছে। আমি চাই ও বড় হয়ে প্রতিষ্ঠিত হোক এবং স্বামীর ওপর নির্ভরশীল না হোক।’