বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ আজ

45

তুষার দেব

বর্ষ পরিক্রমায় বাঙালি জাতির সামনে আবার ফিরে এলো প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ। জীর্ণ-পুরাতন, অশুভ ও অসুন্দরকে পেছনে ফেলে নতুনের কেতন উড়িয়ে বাঙালি জাতি নববর্ষকে বরণ করে এই দিন। আজ বৃহস্পতিবার থেকে বাংলা বর্ষপঞ্জিকায় যাত্রা শুরু হলো আরও একটি নতুন বছরের। ১৪২৮ পেরিয়ে ১৪২৯ বঙ্গাব্দ। বৈশ্বিক অতিমারি করোনার প্রাদুর্ভাব অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ও ম্রিয়মাণ হয়ে আসায় এবার নগরীসহ দেশজুড়ে মানুষ বর্ষবরণের উৎসবে মাতোয়ারা হবে মন-প্রাণ খুলে।
সংস্কৃতিসেবী ও বিদগ্ধজনদের মতে, বাঙালির নববর্ষ এক অনন্য বৈশিষ্ট্যময় উৎসব। কেননা, পৃথিবীতে প্রচলিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনও না কোনও ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ধর্মীয় কোনও অনুষঙ্গ ও সংযোগ নেই। মূলত কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে ঘিরে এর উৎপত্তি ও প্রচলন। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বছরজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব মেটানো। দিনে দিনে পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসবে। ধর্ম ও সম্প্রদায়গত পরিচয় নির্বিশেষে বাংলা ভূখন্ডের সব মানুষের প্রাণের উৎসবে পরিণত পয়লা বৈশাখে নববর্ষকে বরণ করা। এমন অসাম্প্রদায়িক উৎসব সত্যিই পৃথিবীতে বিরল।
পয়লা বৈশাখের উৎসব শুরুর দিকে ছিল মূলত গ্রামাঞ্চলকেন্দ্রিক। গ্রামীণ মেলা, লোকজ নানা ধরনের খেলাধুলা ও নৃত্য-গীত ছিল উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। দিনে দিনে এই উৎসব শহরাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে এবং বর্তমানে পয়লা বৈশাখের উৎসবের আড়ম্বর শহরগুলোকে ঘিরেই বেশি পরিলক্ষিত হয়। রাজধানী ঢাকার রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে সূচিত বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রার মত চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও বৈশাখী মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বনেদি ব্যবসায়ীরা খুলে বসেন হালখাতা। তরুণ-তরুণীরা বৈশাখী উৎসবের রঙিন পোশাক পরে বেরিয়ে আসে, ঐতিহ্যবাহী পাঁচনসহ দেশি খাবারের জমজমাট আয়োজন চোখে পড়ে। সর্বত্র দেখা যায় নতুন প্রাণের কল্লোলিত উচ্ছ্বাস। হালসময়ে বাংলা নববর্ষকে ঘিরে দেশি পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্যরুচির মর্যাদা বেড়েছে ও ধরন বদলেছে। এসব পণ্য বিপণনে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা। সর্বস্তরের মানুষের মিলন ও সৌহার্দ্যরে পরিবেশ তৈরি হয় পয়লা বৈশাখের এই অসাম্প্রদায়িক উৎসবেই। অবশ্য বিগত ২০০১ সালের পয়লা বৈশাখে রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে উগ্রবাদী জঙ্গিদের হামলায় নয়জন মানুষ প্রাণ হারানোর বেদনাবিধূর ঘটনার স্মৃতিও ভোলা যায় নি। এরপরও নববর্ষ মানেই নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন সংকল্প।
পয়লা বৈশাখে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে চট্টগ্রামেও মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন রয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে রঙিন করে তুলতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট সকল প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা বাদশা মিয়া সড়কে চবির চারুকলা ইন্সস্টিটিউটের সামনে থেকে আজ বৃহস্পতিবার সকাল দশটায় শুরু হয়ে নগরীর কাজির দেউড়ি এলাকা ঘুরে ফের চারুকলায় ফিরবে। শোভাযাত্রায় লোকজ সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তুলতে পাখি, প্যাঁচা, পুতুলসহ বিভিন্ন প্রাণির প্রতকৃতি তৈরি করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে গতি ও শক্তির প্রতীক হিসেবে প্রদর্শন করতে তৈরি করা হয়েছে ঘোড়ার বিশালাকৃতির প্রতিকৃতি। থাকছে হাতপাখা, চরকিসহ বৈশাখী অনুষঙ্গের রংবাহারি নানা প্রতিকৃতিও।
চবি চারুকলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক প্রণব মিত্র চৌধুরী জানান, বাংলা নববর্ষ বরণে মঙ্গল শোভাযাত্রার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। আজ সকাল দশটায় চবি চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়ে নগরীর কাজির দেউড়ি সার্কিট হাউস প্রদক্ষিণ শেষে পুনরায় চারুকলায় এসে শেষ হবে। এছাড়া চবিতেও দিনব্যাপী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজন রয়েছে।
নগরীর ডিসি হিলে রয়েছে সম্মিলিত পয়লা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের আয়োজনে নববর্ষকে বরণের নানা অনুষ্ঠান। এছাড়া, সিআরবি’র শিরীষতলায় চট্টগ্রাম নববর্ষ উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে বর্ষবরণের নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন থাকছে। উৎসবের নিরাপত্তায় পুলিশের তরফ থেকে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েনের পাশাপাশি বাড়তি নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
সম্মিলিত পয়লা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের আহব্বায়ক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ন্যাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার বলেন, করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর ধরে বন্ধ ছিল নববর্ষ বরণের উৎসব। এবার পবিত্র রমজানের মধ্যেই আমাদের সামনে ধরা দিয়েছে পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ। এ কারণে তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত পরিসরেই বর্ষবরণ উৎসব আয়োজনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। এবার পয়লা বৈশাখের থিম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘পয়লা বৈশাখ বাঙালির, সবার যোগে জয়যুক্ত হোক’।