বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অমিত শক্তির উৎস বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ

19

লায়ন ডা. বরুন কুমার আচার্য

হৃদকম্পিত ঐতিহাসিক ভাষণের প্রতিটি লাইন ছিল গর্জে উঠার, ঘুরে দাঁড়াবার। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চে জাতির পিতার ঐতিহাসিক এই ভাষণ উজ্জীবিত করেছিলো দেশের আপামার জনগণকে। দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এ দিনেই মূলত বাংলাদেশের অঘোষিত স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুই প্রথম দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন শত্রæর মোকাবেলায়। কালজয়ী এই ভাষণ বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত ও মুক্তিকামী মানুষের সব সময় প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাস রচিত হয়েছে মূলত তার হাত ধরেই। বঙ্গবন্ধুর সাহসিকতার পরিচয় জানা যায়, তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র পাঠ থেকে। ছোট থেকেই তিনি ছিলেন সকল ধরনের অন্যায়, শোষণ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি রাজনীতিতে জড়িত হোন এবং বাঙালির অধিকার নিয়ে কথা বলতে থাকেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত তাঁর ছিলো অপূরণীয় ভূমিকা।
মূলত ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ এসেছিল এক ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে। এই আন্দোলনের একপর্যায়ে মার্চের প্রথম দিন থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাজপথ। এর মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়ানো হয়েছে। পাঠ করা হয়েছে স্বাধীনতার ইশতেহার এবং নির্বাচন করা হয়েছে জাতীয় সঙ্গীত। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার প্রশ্নে বা আন্দোলনের ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত কবে দেবেন, সেজন্যই ছিল মানুষের অধীর অপেক্ষা। আন্দোলন এবং মানুষের আকাক্সক্ষা বিবেচনায় নিয়েই শেখ মুজিব ৩রা মার্চ পল্টনে ছাত্র সমাবেশে ৭ই মার্চ ভাষণ দেয়ার ঘোষণা করেছিলেন। একদিকে আন্দোলনের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার ব্যাপারে চাপ ছিল এবং সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণার দাবিতে ছাত্রনেতাদের একটা অংশ চাপ তৈরি করছিল। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ সকাল থেকেই ঢাকায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ছিল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এবং ছাত্রনেতাদের ভিড়। দুপুর দুটার দিকে আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদসহ তরুণ নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে শেখ মুজিব বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিলেন জনসভার উদ্দেশ্যে। ভাষণ দিতে বাসা থেকে বেরোনোর সময় শেখ মুজিবকে বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেছিলেন, তুমি যা বিশ্বাস করো, তাই বলবে। ৭ই মার্চের সেই ভাষণ তিনি নিজের চিন্তা থেকেই দিয়েছিলেন। ভাষণটি লিখিত ছিলো না। এদিকে সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকা পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সে সময় রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিল। সেই রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের অপেক্ষার পালা শেষ করে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি এবং হাতাকাটা কালো কোট পড়ে শেখ মুজিব উপস্থিত হয়েছিলেন। যাতে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা না হয়, সেজন্য তিনি চারটি শর্ত দিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার দায় নেননি। কিন্তু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনকের ঐতিহাসিক ভাষণ সরাসরি স¤প্রচার করতে দেয়নি তখনকার পাকিস্তান সরকার। তা পরদিন বিভিন্ন পত্রিকায় তা ফলাও করে প্রকাশিত হয়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আসেন বেলা ৩টা ২০ মিনিটে। মঞ্চে উঠেই তিনি জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন। তখন পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান লাখ লাখ বাঙালির কণ্ঠে ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ ধ্বনিত হয়। বঙ্গবন্ধু দরাজ গলায় তাঁর ভাষণ শুরু করেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।’
অন্যদিকে, এই একটি ভাষণের মাধ্যমে তিনি একটি জাতিকে সশস্ত্র বাঙালি জাতিতে রূপান্তর করেছিলেন। স্বাধীনতার বীজ তিনি বপন করেছিলেন। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ‘ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভরাট কণ্ঠের এই আওয়াজে যেন সারাদেশের মানুষকে বিস্মিত করে তুলেছিল। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ১৯ মিনিটের এক জাদুকরী ভাষণে বাঙালি জাতিকে স্বপ্নে বিভোর করেছিল। এরপরই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, ৯ মাসের লড়াই এবং স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
জনসভায় ছিলেন এমন অনেকে বলেছেন, লাঠি, ফেস্টুন হাতে লাখ লাখ মানুষ উত্তপ্ত শ্লোগানে মুখরিত থাকলেও শেখ মুজিবের ভাষণের সময় সেখানে ছিল পিনপতন নিরবতা। ভাষণ শেষে আবার স্বাধীনতার পক্ষে শ্লোগানমুখর হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাস্তাগুলো। ওই দিন বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। এদিন লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে এই মহান নেতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধুর প্রেরণাদায়ী সেই ভাষণ বাঙালি জাতির কাছে সবসময়ই বিশেষ কিছু। ২০১৭ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকো বিশ্ব ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গ্রহণ করে ভাষণটিকে। সংস্থাটি বিশ্বের ৭৮টি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল, নথি ও বক্তৃতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণও অন্তর্ভুক্ত করে। এরপর সরকারিভাবে দিবসটি আড়ম্বরের সঙ্গে পালন করা হয়। তিনি তাঁর ভাষণে সামরিক আইন প্রত্যাহার, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে মতা হস্তান্তর, গোলাগুলি ও হত্যা বন্ধ করে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া এবং বিভিন্ন স্থানের হত্যাকান্ডের তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি জানান।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সর্বশেষ দুটি বাক্য, যা পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিক-নির্দেশনা ও প্রেরণার হাতিয়ারে পরিণত হয়। এ ঘোষণার পরই বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতার দিক-নির্দেশনা। মূলত ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় চিন্তা, সা¤প্রদায়িকতার মানসিকতা ও দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতিসত্তা, জাতীয়তাবোধ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে ভিত রচিত হয় তারই চূড়ান্ত পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তা, জাতীয়তাবোধ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে ভিত রচিত হয়, তারই চূড়ান্ত পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দেন। এতে ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের বাঙালি নতুন প্রেরণা খুঁজে পায়। পৃথিবীর ইতিহাসের ৭ মার্চের এই ভাষণ অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে। কেননা, পৃথিবীতে অন্য যে সকল ভাষণগুলো সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে সে সকল ভাষণ ছিলো লিখিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিলো সম্পূর্ণ অলিখিত। বিভিন্ন ধরনের অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন এই ভাষণের মাধ্যমে। আর ঐতিহাসিক এই ভাষণটি ছিলো মাত্র ১৮ মিনিটের। কিন্তু অলিখিত এই ১৮ মিনিটই একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ গঠনের কাÐারী হিসেবে কাজ করেছে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েছিলো দেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষজন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষে ঢাকার রাজপথগুলো শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত ছিলো। আর একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর এই উদ্দীপ্ত ভাষণকে স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। এটাকে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনাও বলা হয়। এই ভাষণের পরই মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বমানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধুর এই বজ্রনিনাদে আসন্ন মহামুক্তির আন্দোলনে বাঙালি জাতি উজ্জীবিত হয়ে উঠে, যুগ যুগ ধরে শোষিত বঞ্চিত বাঙালি ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায় কাক্সিক্ষত মুক্তির লক্ষ্যে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে বাঙালি জাতি। অর্জিত হয় নতুন মানচিত্র, নতুন পতাকা।
নতুন স্বপ্নের পথ ধরে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। এ বিজয়ে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্বের দাবিদার জাতির পিতার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সেই ভাষণ। এই ভাষণ শুধু ১৯৭১ সালেই নয়, যুদ্ধ পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে। এমন কি বর্তমান সময়েও তরুণের অন্যরকম অনুপ্রেরণা দেয় বঙ্গবন্ধু অগ্নিমশাল এই ভাষণ। নিজেদেরও অধিকার আদায়ে করে তুলে অনির্বাণ। এ ভাষণ শুরু দেশের ভেতরে অনুপ্রেরণা দিয়েই ক্ষান্ত নয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলেও অনুপ্রেরণার দাবিদার বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অগ্নিঝরা এই ভাষণ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এই ভাষণকে ব্যাখ্যা করেছে যুগান্তকারী দিকনির্দেশনা হিসেবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, মরমী গবেষক