বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ও করণীয়

220

অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

করোনা মহামারির ২০২০-২১ অর্থবছরে অথনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিম্নগামীতার পরেও ২০২২ সাল পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। করোনা মহামারির অর্থবছর ২০২০-২১ এ বাংলাদেশ সরকার অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনার যেসব কৌশল অবলম্বন করেছিল তা খুবই ইতিবাচক ভাবে কার্যকর হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফাইন্যান্স (আইআইএফ) ওয়াশিংটনভিত্তিক এর মতে, ‘বাংলাদেশ ১.০ ট্রিলিয়ন টাকারও বেশি উদ্দীপনা সরবরাহ করেছে দেশীয় অর্থনীতিকে উন্নীত করতে। ঋণ সঙ্কটের ঝুঁকি কম হওয়ায় এটি বাংলাদেশের পক্ষে ইতিবাচক হয়েছে।’ বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সর্বোচ্চ বছর ছিল ২০১৮-১৯, মহামারি আক্রান্ত অর্থবছর ২০২০-২১, দ্রæত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বছর ২০২২ এবং ২০২২-২৩ হবে বাংলাদেশের উচ্চ-গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের বছর। আমরা যদি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চ‚ড়ান্ত হিসাবের দিকে লক্ষ্য করি তবে দেখা যায় ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে জিডিপি ছিল ৮.১৫%, যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার। এবং অতিতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যা ছিল ৬.৫৫%, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৭.১১%, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ৭.২৮%, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ৭.৮৬%। ঝচ একটি বৈশ্বিক রেটিং এজেন্সি তারা তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ‘২০২১ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ৫.৫% এবং ২০২২-এ ৬.৮% বৃদ্ধির প্রত্যাশিত এবং বাংলাদেশ দৃঢ় প্রবৃদ্ধির আগামী ১২ মাসে কোভিড-১৯ মহামারির ঝুঁকির বিরুদ্ধে জয়লাভ করবে।’ অন্যদিকে স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস-এর সা¤প্রতিক বৈশ্বিক রেটিংয়ে বলা হয়েছে, ‘আমরা পূর্বাভাস দিচ্ছি যে, তুলনামূলকভাবে দুর্বল ভিত্তি প্রভাব এবং বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা পরিস্থিতির ক্রমাগত স্বাভাবিককরণ, বিশেষ করে অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধ্বে ২০২২ সালের অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭%-এ উঠবে এবং ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে ৫.৫% প্রকৃত স¤প্রসারণের পরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি আগামী এক থেকে দুই বছরে তৈরি হতে থাকবে।’ অন্যদিকে এসএন্ডপি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবণতা সম্পর্কে বলেছে, ‘অদূরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ সত্তে¡ও, আমরা আশা করি বাংলাদেশ উচ্চ-গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন অব্যাহত রাখবে’। ‘গত বছর ধরে, অর্থনীতি ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার শুরু করেছে, বাহ্যিক চাহিদার অবস্থার একটি প্রগতিশীল স্বাভাবিকীকরণ বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করেছে’। বাণিজ্য প্রবাহ এবং বাহ্যিক-ভিত্তিক শিল্পে সংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থান, যেমন গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং, উন্নত হয়েছে, প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২১ অর্থবছরে ৫.৫% হয়েছে। রেটিং এজেন্সি উল্লেখ করেছে যে, ‘পরিমিত মাথাপিছু আয়, যা ২০২২ অর্থবছরের জন্য প্রায় ২,৩৬৩ মার্কিন ডলার অনুমান ছিল।’ দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসে ২০২১ সালের ফেব্রæয়ারিতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ এ এশিয়ার ছয়টি সীমান্ত বাজারের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম বিশ্বের দ্রæততম বর্ধমান অর্থনীতি হিসাবে গণ্য হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক বলছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১৩৯ ডলার। অন্যদিকে, ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১১৬ ডলার। বাংলাদেশের অর্থনীতি গত ৫০ বছরে ২৭১ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বøুমবার্গের কভিড রেজিলিয়েন্স র‌্যাংকিং অনুযায়ী যেসব দেশের জিডিপি ২০০ বিলিয়ন ডলারের ওপর, সেসব ৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৩তম। সর্বশেষ এপ্রিল ২০২১- প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, করোনা অনিশ্চয়তার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল।
২০২২-২৩ সালে বাংলাদেশের উচ্চ-গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে মানসম্পন্ন অবকাঠামোতে সরকারকে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল করতে অবকাঠামো বিনিয়োগ করে দেশের রাস্তা, সেতু, বাঁধ এবং অন্যান্য অবকাঠামো মেরামত বা নির্মাণ করতে হবে, যেমন: নৌবন্দর ও বিমানবন্দর। বিনিয়োগের জন্য বিদ্যমান এবং সম্ভাব্য আর্থিক সংস্থানগুলিকে আরও ভালভাবে কাজে লাগাতে হবে। স্বাস্থ্য, ডিজিটাল এবং পরিবেশ পরিকাঠামোতে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং সমস্ত স্তরে পাবলিক বিনিয়োগ ভাল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আরও স্মার্ট ভাবে বিনিয়োগ করতে হবে। শহর এবং গ্রামের রক্ষণাবেক্ষণ এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, কম-কার্বন বিল্ডিং, শক্তি দক্ষতা, বর্জ্য এবং দূষণ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা এবং পরিষ্কার গণপরিবহনে নতুন বিনিয়োগ প্রয়োজন। ভালো সমন্বয়, সংকট ব্যবস্থাপনা ব্যর্থতার ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। সরকারের সকল স্তরের এবং মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বিত প্রতিক্রিয়া সংকট-ব্যবস্থাপনা ব্যর্থতা হ্রাস করতে পারে। সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোর একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যহত হবে। মন্ত্রণালয় গুলোর মধ্যে সম্বনয়, সহযোগিতা সরকারের অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যগুলি এবং পরিকল্পনার ব্যবস্থাগুলি সনাক্ত করতে বা একত্রিত করা নিয়ন্ত্রণ এবং করোনা পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যাবে। অর্থনীতির উন্নয়নের গতিধারাকে এগিয়ে নিতে সকল ব্যবসার মালিক, পরিষেবা প্রদানকারী, শিক্ষক ও অভিভাবক এবং সুশীল সমাজ সহ অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সাথে সরকারকে পর্যাপ্ত এবং সময়োপযোগী পরামর্শ নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতি অঞ্চলগুলো দেশের সর্বত্র বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। দেশকে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত করতে হবে। শহর, ছোট শহর, গ্রাম এই বিভাজন কমিয়ে আনতে হবে। কৌশলগত শিল্প পুনঃস্থাপনের সাথে যুক্ত সুযোগগুলি বিবেচনা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ কাঁচামালে জোগানদাতা হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে বৃহত্তর শিল্পগুলির হোস্ট হিসাবে সক্রিয় করতে পারে। অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হলে চারটি প্রয়োজনের উপর জোর দিতে হবে: অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, সামাজিক সমাধান, শহুরে মডেলের পুনর্বিবেচনা এবং সংস্কৃতি/শিক্ষা/জ্ঞান খাতকে উন্নত করা। অতিক্ষুদ্র, কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, বৃহত্তর শিল্পের ফরোয়ার্ড ও ব্যকওয়ার্ড লিঙ্কেজকে শক্তিশালী করা, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং গ্রামীণ ও শহরে বসবাসকারীদের মাঝে বৈষম্য হ্রাস করার লক্ষ্যে আগামী শিল্পনীতি প্রণয়ন করতে হবে। অগ্রাধিকারমূলক খাতসমূহে নীতি সহায়তা, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আয়ত্বকরণের প্রযুক্তি, দক্ষতা উন্নয়ন ও করোনা বা দুর্যোগ মোকাবেলায় টেকসই দিক নির্দেশনা দেবার বিষয়টি নতুন জাতীয় শিল্পনীতিতে গুরুত্ব দিতে হবে। গ্রিন এনার্জিতে বিনিয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশের এখনই সময় জলবিদ্যুৎ, সৌরশক্তিসহ অন্যান্য পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে বিশেষ বিনিয়োগ করা। অর্থনৈতিক গতিধারাকে এগিয়ে নিতে হলে শান্তি, ন্যায়বিচার ও শক্তিশালী রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল কাজে লাগাতে হলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, আইনের শাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। রূপকল্প-২০৪১ এর আলোকে ‘উন্নত বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে আগামী দিনে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধি, জনমিতিক মুনাফা ভোগ, এলডিসি থেকে উত্তরণের পরবর্তী চ্যালেঞ্জসমূহ জয় করতে পারলে, ২০৩১ সালে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর হবে বাংলাদেশ। বর্তমান বাজেট দিয়েই হবে সুদৃঢ় বাংলাদেশ বিনির্মাণের অভিযাত্রা।
লেখক: প্রাবন্ধিক