বঙ্গবন্ধু টানেলের রিংয়ে রিংয়ে স্বপ্ন-সম্ভাবনার বাস্তবরূপ

128

টানেল টিউবে প্রতিদিন সাত থেকে আটটি করে রিং লাগানো হচ্ছে। ৩৫ ফিট চাওড়া ও দুই মিটার দৈর্ঘ্যরে রিং বসানোর সাথে সাথে দুই মিটার করে এগিয়ে যাচ্ছে টানেলের কাজও। প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৬ মিটার করে কাজ হচ্ছে। এ হিসাবে আগামী এপ্রিলের মধ্যেই টানেলের একটি টিউবের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে। দ্রুত এগিয়ে যাওয়া টানেলের কাজের সাথে এগিয়ে চলছে চট্টগ্রামবাসীর স্বপ্নও। এ যেন প্রতিটি রিংয়ের সাথে স্বপ্নের বাস্তবরূপ।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় পাতাল পথ বঙ্গবন্ধু টানেলের (কর্ণফুলী টানেল) মোট দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৪০০ মিটার বা ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। এরমধ্যে টিউবের দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৪৫০ মিটার। কর্ণফুলী নদীর নিচে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় দুটি টিউব বসানোর মাধ্যমে টানেলটি নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিটি টিউব চওড়ায় হবে ৩৫ ফুট এবং উচ্চতায় প্রায় ১৬ ফুট। টিউব দুটির একটি দিয়ে শহর থেকে গাড়ি প্রবেশ করবে। আরেকটি টিউব দিয়ে ওপার থেকে গাড়ি প্রবেশ করবে। নদীর তলদেশে ৯৪ মিটার দীর্ঘ ২২ হাজার টন ওজনের টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) দিয়ে চলছে খননের মূল কাজ। প্রতিদিন অল্প অল্প করে এগিয়ে চলছে টানেলের নির্মাণ কাজ। ইতোমধ্যে একটি টিউবের ১২শ মিটার বোরিং ও রিং লাগানোর কাজ শেষ হয়েছে। গতকাল ৬০৮ নং রিং (প্রতিটি রিংয়ের দীর্ঘ দুই মিটার) বসানো হয়েছে। সে হিসাবে টানেলের প্রায় অর্ধেক কাজ (৪৯ শতাংশ) শেষ হয়েছে। নির্ধারিত সময় ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার আশা করছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি)।
প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, টানেলের ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে মধ্যে ১২শ মিটার অংশের খনন কাজ শেষ হয়েছে। সার্বিকভাবে প্রকল্পের প্রায় ৪৯ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। অর্ধেক কাজ শেষ হলেও পুরো কাজ কখন শেষ হবে সেটা নির্ধারিত করে বলা যাবে না। কারণ এগুলো মাটির নিচের কাজ। এখন মেশিন মাটি কেটে যাচ্ছে, রিং লাগানো হচ্ছে। ৯৪ মিটার দৈর্ঘ্যরে মেশিনটিতে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। এতে কাজও বন্ধ রাখতে হতে পারে।
পৃথক দুটি টিউবে নির্মিত হবে টানেল। প্রতি টিউবে দুই লেন করে চার লেনে গাড়ি চলাচল করবে। জরুরি মুহূর্তে এক টিউব থেকে অন্য টিউবে যাতায়াত করতে দুই টিউবের সঙ্গে পৃথক তিন স্থানে সংযোগ সড়ক থাকবে। এখন টিবিএম মেশিনটি টিউব তৈরি করে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারার দিকে যাচ্ছে। যা দুই লেনের একটি টিউব সড়ক হবে। সেটি শেষ হলে টিবিএম আনোয়ারা প্রান্ত থেকে নদীর তলদেশে ঢুকে আরেকটি দুই লেনের সড়ক খনন করে পতেঙ্গা অংশে বের হবে। দুটি টিউবে চার লেন সড়ক পথ হবে। এজন্য প্রথম টিউবের কাজ শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় টিউবের কাজ শুরু করতে কিছুদিন সময় ব্যয় হবে। কারণ আনোয়ারা অংশ থেকে আবার নতুনভাবে টিবিএম মেশিনটি সংযোজন করতে হবে।
হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, টিবিএম মেশিন দিয়ে একটি টিউবের কাজ শেষ হওয়ার পর সেটি আবার আনোয়ারা অংশ থেকে পতেঙ্গা অংশের দিকে আরেকটি টিউবের কাজ শুরুর জন্য সংযোজন করতে হবে। প্রথমে একটি টিউবের কাজ শেষ হলেও সেখানে মানুষ চলাচলের কোনো সুযোগ থাকবে না। পুরো কাজ শেষ হওয়ার পরে যখন উদ্বোধন হবে তখন সবাই দেখবে। এর আগে এক অংশ খুলে দেয়া হবে না।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে ২০০৮ সালে লালদিঘীর ময়দানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের ঘোষণা দেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে টানেল নির্মাণের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকন কোম্পানির (সিসিসিসি) সঙ্গে চুক্তি সই হয়। চীন সরকার ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে জিটুজি ভিত্তিতে (সরকার টু সরকার) টানেল নির্মাণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। গত বছরের ২৪ ফেব্রূয়ারি কর্ণফুলী টানেলের খনন কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন তিনি টানেল প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড পরিদর্শন করেন।
টানেলটি চট্টগ্রাম নগরকে কর্ণফুলী নদীর অপর অংশের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করবে। ফলে কর্ণফুলী নদীর দুই পাশে নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। পরোক্ষভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাধ্যমে সারাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এতে কক্সবাজারের সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার কমে যাবে। এটি ভবিষ্যতে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে।
৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ টানেলটি পতেঙ্গার নেভাল অ্যাকাডেমি পয়েন্ট থেকে শুরু হয়ে কাফকো ও সিইউএফএল পয়েন্টের মাঝখান দিয়ে কর্ণফুলী নদীর ওপারে গিয়ে উঠবে। এ প্রকল্পের অধীনে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার টানেল নির্মাণের পাশাপাশি টানেলের পূর্ব (আনোয়ারা) প্রান্তে ওপেন কাট ২০০ মিটার, কাট অ্যান্ড কভারের ১৯৫ মিটার, অ্যাপ্রোচ রোড ৫৫০ মিটার এবং ২৫ মিটার ওয়ার্কিং শ্যাফট নির্মাণ করা হবে। অন্যদিকে, টানেলের পশ্চিম (পতেঙ্গা) প্রান্তে ওপেন কাট ১৯০ মিটার, কাট অ্যান্ড কভারের ২৩০ মিটার, অ্যাপ্রোচ রোড ৪ হাজার ৭৯৮ দশমিক ০৯৫ মিটার এবং ২৫ মিটার ওয়ার্কিং শ্যাফট নির্মাণ করা হবে।
কর্ণফুলী টানেলের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা শেষ হয় ২০১৩ সালে। চার বছর মেয়াদকালের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। ২০১৪ সালের ১০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বেইজিংয়ে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। পরে ২০১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর সিসিসিসির সঙ্গে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের চুক্তি হয়। ২০১৫ সালের ২৮ ফেব্রূয়ারি সিসিসিসি বাণিজ্যিক প্রস্তাব দাখিল করে। বাণিজ্যিক প্রস্তাবের পর কারিগরি দিক পরীক্ষায় দুজন বিদেশি ও একজন দেশি পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ৩০ জুন সিসিসিসির সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সর্বশেষ ৬ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে লোন কার্যকরে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রকল্পে ঋণ হিসেবে চাইনিজ এক্সিম ব্যাংক ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকার অর্থায়ন করছে। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকার ব্যয় করবে।