বই পড়ি, বই উপহার দিই, বইয়ের সাথেই থাকি

48

পিংকু দাশ

সা¤প্রতিক নৃশংসতার পরিবেশ থেকে বাঁচতে শিশু, কিশোর, তরুণ প্রজন্মের প্রয়োজন বই পড়া । সংস্কৃতি চর্চা ও বই পড়ার মত সৃজনশীল চর্চায় জড়িয়ে থাকলে তারা ধর্মান্ধতা , সা¤প্রদায়িকতা ও নৃশংস মনোভাব থেকে বেরিয়ে, সৃজনশীল মানবিক মানুষ হয়ে উঠতে পারবে। সাহিত্যচর্চা না করলে মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলো বিকশিত হয় না। মানবিকতা রুদ্ধ হয়ে যায়।
বর্তমানে আমাদের সমাজে কিশোর, তরুণ বয়সের ছেলেমেয়েরা নানা রকম অপকর্মে জড়িয়ে যাচ্ছে । আমার মনে হয় তারা আমাদের বাংলা সাহিত্যের রস আস্বাদন করা শেখেনি। আমাদের বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ। জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি মানবিকতার বিশাল ভাÐার এগুলোতে রয়েছে। আমাদের কবি সাহিত্যিকরা তাঁদের সমস্ত জ্ঞানের আলো বইয়ের মধ্যে ঢেলে দিয়েছেন। বই পড়ে সেই জ্ঞানের আলোকে নিজেকে আলোকিত করা যায়। আমরা যদি শিশু কিশোরদের বই পড়ার অভ্যাস এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাÐে অনুপ্রাণিত করতে পারি তাহলে আস্তে আস্তে তারা এগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে । লেখাপড়ার পাশাপাশি তারা এগুলোকে ভালোবাসবে, ভালো লাগবে।
সকালে পত্রিকা হাতে নিলে গা শিউরে , বুক কেঁপে ওঠে। কিশোর গ্যাং, আধিপত্য বিস্তার, মানুষের বাড়িঘর এবং বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে আগুন দেওয়া, সর্বশেষ জুতা হাতে নিয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে সেøাগান। কি শিখছে ওরা, আমরা কি শেখাচ্ছি তাদের! আমাদের কি কোন দায়বদ্ধতা নেই!
এক কিশোর আরেক কিশোরকে খুন করছে বীর দর্পে , আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগীয় কায়দায় নিরাপরাধ মানুষকে গাছের সাথে বেঁধে রক্তাক্ত করছে উচ্ছৃঙ্খল যুবক। এমনটা হওয়ার কথাতো ছিল না। কারণ আমাদের কিশোর তরুণদের গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। তাঁরা পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ভাষার জন্য, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে কার্পন্য করেননি।
ডিজিটাল এই যুগেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ লাইব্রেরি বিমুখ হয়নি। পাড়ায় পাড়ায়, গাড়িতে ,ট্রেনে এমনকি শপিং মলেও তাদের সময় কাটানোর জন্য বই রাখা আছে। আমি সিঙ্গাপুরে ট্রেনে দেখেছি ইয়াং ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বই পড়ছে। কোনদিকে তাদের কোন খেয়াল নেই। কথা পর্যন্ত কম বলে, সময় নষ্ট হওয়ার ভয়ে। একসময় আমাদের দেশেও বই পড়ার ব্যাপক প্রচলন ছিল। কে কোন রাইটার এর কয়টা বই শেষ করতে পেরেছে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা ছিল। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম পাঠ্যবইয়ের নিচে লুকিয়ে গল্পের বই রেখে দিতাম । মা যাতে দেখতে না পারে। দুপুরে এবং রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে বই না পড়লে ঘুম আসত না। আমার মা, ঠাকুরমা অলস দুপুরে বসে সুর করে বিভিন্ন পুঁথি পাঠ করত । সে সুর আজও আমার কানে বাজে। ভালো পাস করার জন্য পাঠ্য বই অবশ্যই পড়তে হবে , পাশাপাশি মানবিক জ্ঞান , সহনশীল ও সহমর্মী হয়ে ওঠার জন্য বৈচিত্র্যময় বইও পড়তে হবে। আমার মনে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে থাকাকালীন একটা বই কেউ কিনলে সেটা পুরো ফ্লোরে ঘুরত , এরুম থেকে ওরুমে। যে বই পড়ে না মনে হয় তাকে কেউ সম্মানও করত না।
এখন যুগ বদলেছে , ডিজিটাল যুগে অনেকে মনে করে অনলাইনে বই পড়ে নেবে। আসলে ছাপা অক্ষরের কাগজের বইয়ের যে মিষ্টি গন্ধ, যে সুবিধা , যে আবেগ সেটা কি অনলাইনে পাওয়া যায়। তাছাড়া তরুণ প্রজন্ম অনলাইনে সারাদিন সময় কাটালে অর্থ , শরীর, সর্বোপরি চরিত্র নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। যেটা এখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
অবসরে বই পড়লে মন নির্মল আনন্দে ভরে ওঠে। বই একজন মানুষকে পরিপূর্ণ , চটপটে , বাগানুশীলন ও করে। সঠিক ধরনের সাহিত্য মনকে সতেজ করে তোলে, মানসিক চাপ কমিয়ে পুনর্জীবিত করে তোলে , মেজাজ ঠিক করে , মনের ব্যাটারি রিচার্জে সাহায্য করে। সাহিত্য মানুষের মধ্যে যে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি করে তা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে তরুণরা আজ বিপথে যাচ্ছে।
জ্ঞানবিজ্ঞানের আশ্চর্য সব আবিষ্কার , মানুষের ক্রমবিবর্তনের রোমাঞ্চকর কাহিনী, নর-নারীর চিরায়ত ভালোবাসার কাহিনী পাঠককে হিংসা বিদ্বেষ ভুলে জ্ঞানী এবং ভালোবাসতে শেখায়। কবিতাপাঠ মানুষকে ছন্দময় করে তোলে , গনিত মানুষকে বুদ্ধিদীপ্ত করে এবং সাহিত্য মানুষকে অবারিত জ্ঞান বিজ্ঞানের পথ দেখায়। বই মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। সাহিত্যিকদের মতে , “একটি বই মূলত আপনাকে যে বার্তাটি দেয়, সেটি হল নিজের নীতিতে অটল থাকার । এ কারণে নানা ধরনের মানসিক পীড়া থেকে মুক্তি মেলে আর মন পুরো পরিশুদ্ধ নতুনের মত হয়ে যায়”।
বই এমন এক বন্ধু যা কখনো বিশ্বাস ঘাতকতা করে না। নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে পারলে তা নেশায় পরিনত হয়ে যাবে। আর বই পড়ার নেশা জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ নেশা। একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের উচিৎ নিজের সন্তানকে পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি জ্ঞানমূলক বিভিন্ন বই পড়ার জন্য উৎসাহিত করা। যে মানুষ সারাদিন বইয়ের সাথে থাকে সে কোনদিন বিপদগামী হয় না।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সাঈদ সন্তানকে জিপিএ ফাইভ পাওয়াকে প্রাধান্য না দিয়ে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বেশি করে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করতে অভিভাবকদের আহবান জানিয়েছেন। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের বলেন, সারাজীবন পড়তে থাকো। তোমরা সুন্দর হলে, বাংলাদেশ সুন্দর হবে।
আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির সুনাম বিশ্বময়। হাজার বছরের ঐতিহ্য বাঙালি সংস্কৃতি তরুণ প্রজন্মের কাছে আমরা মনে হয় সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারিনি। আগে পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ইভেন্ট, বই পড়া, ফুটবল খেলা, গরুর লড়াই এগুলোর প্রতিযোগিতা চলত শিশু ,কিশোর এবং তরুণদের মধ্যে। বিভিন্ন ক্লাবের মাধ্যমে এই প্রতিযোগিতা চলত। যেখানে সদস্য থাকত শিশু থেকে তরুণরা। বয়স্করা থাকত উপদেষ্টা হিসেবে। মাসিক একটা চাঁদা নির্ধারণ করা থাকত। ওই চাঁদা দিয়ে ক্লাব ঘরে বই এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পুরস্কার দেওয়া হত । এখনকার শিশুকিশোররা এই মধুর সময় চোখেই দেখেনি । এর বদলে তারা বিপথে যাওয়া উচ্ছৃঙ্খল কিছু বখাটে ছেলের বিভিন্ন লোমহর্ষক কাহিনী দেখছে প্রতিদিন, পত্রিকা , টেলিভিশন এবং ফেইসবুকে।
প্রমথ চৌধুরী বই পড়া প্রবন্ধে বলেছেন , “আমাদের বই পড়তে হবে, কেননা বই ছাড়া সাহিত্য চর্চার উপায়ান্তর নেই। তিনি আরও বলেছেন ,ধর্মের চর্চা চাই কি মন্দিরের বাইরেও করা চলে, দর্শনের গুহায়, নীতির চর্চা ঘরে এবং বিজ্ঞানের চর্চা যাদুঘরে; কিন্তু সাহিত্যের চর্চার জন্য লাইব্রেরি; ও চর্চা মানুষ কারখানাতেও করতে পারে না , চিড়িয়াখানাতেও নয়। সেজন্য আমরা যত বেশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করব দেশের তত বেশি উপকার হবে”।
তরুণ প্রজন্মকে বাঁচাতে প্রয়োজন সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা। সাহিত্য চর্চা শিক্ষার সর্বপ্রধান অঙ্গ। সাহিত্য চর্চার জন্য আমাদের বই পড়তে হবে। বই-ই পারে একজন মানুষকে যথার্থ জ্ঞানী করে তুলতে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে তরুণ প্রজন্মকে আলোকিত মানুষ হতে হবে। এজন্য প্রয়োজন বই পড়া। দেশকে ভালবাসলে , নিজেকে ভালোবাসলে ,জ্ঞানী হতে চাইলে অবশ্যই বই পড়তে হবে। অধ্যাপক আবুল ফজল লাইব্রেরিকে “মনের হাসপাতাল” বলে অভিহিত করেছেন। বই পড়াকে উৎসাহিত করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরে একদিন বই উৎসব চালু করতে পারে। দেশের বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের জন্মদিনেও করা যায় সেটা।
ব্রাজিলে নাকি কিছু কারাগার আছে বই পড়লে অপরাধীদের শাস্তি কমিয়ে দেওয়া হয়। একজন বন্দী ১টি বই পড়লে তার সাজার মেয়াদ ৪ দিন কমানো হয় । মাসে ১টি করে একজন বন্দী বছরে ১২টি বই পড়ার সুযোগ পায়। ১২টি বই পড়লে বন্দীর সাজার মেয়াদ প্রতি বছরে কমে যায় ৪৮ দিন। তাই আসুন বই পড়ি , বই উপহার দিই এবং অবসর সময় বইয়ের সাথেই থাকি। নিজে বাঁচি , ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাই, দেশের সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ অক্ষুন্ন রাখি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক (অর্থনীতি)