ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বিদায় নিলেন গাফফার চৌধুরী

14

পূর্বদেশ ডেস্ক

যার লেখা গান কণ্ঠে ধরে প্রভাত ফেরির মিছিল ছোটে শহীদ মিনারে, সেই স্থানেই শেষ বিদায় জানানো হল আবদুল গাফফার চৌধুরীকে। শনিবার দুপুরে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর পর সর্বসাধারণের শ্রদ্ধায় সিক্ত হন প্রয়াত এই সাংবাদিক-সাহিত্যিক। পরে যুগল জীবনের ৫৬টি বছর একসঙ্গে কাটানো স্ত্রী সেলিমা আফরোজ চৌধুরীর পাশেই অন্তিম শয্যা শায়িত হলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। বিকালে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয় এই ভাষাসৈনিক ও মুক্তিসংগ্রামীকে।
একুশের গানের রচয়িতা গাফফার চৌধুরী ৮৮ বছর বয়সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৯ মে যুক্তরাজ্যে মারা যান। শনিবার সকালে লন্ডন থেকে বিমানে মরদেহ ঢাকায় পৌঁছনোর পর সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় শহীদ মিনারে।
দুপুর ১টায় গাফফার চৌধুরীর কফিন পৌঁছনোর পর প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়। এসময় তার স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর গাফফার চৌধুরী রচিত সেই অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গেয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর লন্ডনে মৃত্যুর পরমিরপুরের এই কবরস্থানেই শেষ শয্যা হয় স্ত্রী সেলিমা আফরোজ চৌধুরীর। সেখানে দীর্ঘদিনের সঙ্গীর পাশেই শায়িত হলেন গাফফার চৌধুরীও।
তার কবরের একপাশে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘চরমপত্র’ এর ¯্রষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা এম আর আখতার মুকুল। আরেক পাশে মুক্তিযোদ্ধা ও গীতিকার ইমতিয়াজ বুলবুলের কবর। আশেপাশে শায়িত আছেন মুক্তিযোদ্ধা ও অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী, গোলাম মোস্তফা, কমরেড আলী আকসাদ, সাংবাদিক ও ভাষা সৈনিক কে জি মুস্তাফা, শিল্পী কলিম শরাফী ও সংগীতগুরু সোহরাব হোসেন।
দুপুর ১টায় গাফফার চৌধুরীর কফিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পৌঁছনোর পর প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়। এসময় তার স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর গাফফার চৌধুরী রচিত সেই অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গেয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
বেলা ৩টায় শ্রদ্ধা নিবেদনের পর্ব শেষে শহীদ মিনার থেকে কফিন নেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে, সেখানে জানাজার পর মরদেহ নেওয়া হয় জাতীয় প্রেস ক্লাবে। সেখানে প্রবীণ-নবীন সাংবাদিকরা ফুল দিয়ে অগ্রজের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এর আগে প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে জানাজাও হয়। পরে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে নিয়ে সন্ধ্যার আগেই দাফন করা হয়।
শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বের শুরুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাহউদ্দিন ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কবীর আহম্মদ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী শ্রদ্ধা জানান।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর কফিনে আওয়ামী লীগের পক্ষে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলের শীর্ষ নেতারা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের সংস্কৃতির সমকালের সবচেয়ে বড় বটবৃক্ষটির পতন ঘটল। তিনি মরে গেলেও একুশের আমর গানে তিনি বেঁচে থাকবেন।
আমাদের নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দুঃসময়ে, সংকটে পরামর্শ দিতেন। আজকে এই চলমান বিশ্বের সংকটে জাতিকে পরামর্শ দেওয়ার, আমরা যারা ক্ষমতার মঞ্চে আছি, আমাদেরকে পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে তার শূন্যতা অনুভব করব।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে দেখা যায়নি বিএনপিকে, যা নিয়ে প্রশ্ন করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, আজকে বিএনপিকে দেখছি না, এটা দুর্ভাগ্যজনক। না আসার একটা কারণ হতে পারে, তারা গত কয়েকদিন যাবৎ সরকারি পেটোয়া বাহিনী ছাত্রলীগকে দিয়ে ছাত্রদলের উপরে হামলা করেছে। হাই কোর্টের ভেতরে গিয়েও হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যেও আমি মনে করি বিএনপির আসা উচিৎ ছিল। উনি দলকানা হতে পারেন, কিন্তু উনি তো আমার অগ্রগতিতে অবদান রেখেছেন। তাকে সম্মান না দেখালে আমার ক্ষুদ্রতা প্রকাশ পাবে।
শ্রদ্ধা জানাতে এসে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, তাকে আমরা সব সময় বলতাম চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া।
লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, বাংলাদেশের একটি ছোট ঘটনা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক যে কোনো ঘটনা, সব জায়গায় উনি অত্যন্ত বিশ্লেষণ করে কথা বলতেন। তার লেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম। তাকে হারানোর পর আমাকে মানসিকভাবে নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে। আমরা অভিভাবক হারিয়ে ফেললাম।
সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, সাংবাদিক হিসেবে তিনি আমাদের পথিকৃৎ। তার চেতনা ও আদর্শের প্রশ্নে তিনি কখনও আপস করেননি।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সভাপতিমÐলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, জাহাঙ্গীর কবির নানক, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মাদ সামাদ, উপ-উপাচার্য ( শিক্ষা) অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী শ্রদ্ধা জানাতে আসেন।
এছাড়া আওয়ামী নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট, জাতীয় পার্টি, জাসদ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, শিল্পকলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটি, জাতীয় কবিতা পরিষদ, ছায়ানট, জাতীয় প্রেস ক্লাব, প্রেস কাউন্সিল, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, বেতার টেলিভিশন শিল্পী সংঘ, গণ সংগীত শিল্পী পরিষদ ও সমন্বিত সাংস্কৃতি জোটসহস বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে আবদুল গাফফার চৌধুরীকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
গাফফার চৌধুরীর ছেলে অনুপম আহমেদ রেজা চৌধুরী বলেন, আমার আব্বা বাংলাদেশকে খুবই ভালোবাসতেন। তিনিও জানতেন বাংলাদেশের মানুষ তাকে অনেক ভালোবাসেন। আব্বা সব সময় বলতেন এই দেশেই যাতে তাকে মাটি দেওয়া হয়। সেজন্য তাকে এখানে নিয়ে আসছি।
আজকে এখানে তাকে শ্রদ্ধা অনেক মানুষ এসেছেন। আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার বাবার প্রতি যে শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন, সেজন্য আমি উনার কাছে চির কৃতজ্ঞ।
এর আগে সকাল ১১টার দিকে মরদেহ দেশে পৌঁছলে বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে সরকারের পক্ষ থেকে তা গ্রহণ করেন মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ সদস্য, মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজম্মেল হক।
উড়োজাহাজ থেকে মরদেহ নামানোর পর জাতীয় পতাকায় ঢেকে দেওয়া হয়। পরে সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান মন্ত্রীরা।
বিমানবন্দরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়মন্ত্রী মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেন, আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন ইতিহাসের জলন্ত সাক্ষী। ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট তিনি জাতির সামনে তুলে ধরেছেন আজীবন। বাংলার মানুষ তার কাছ থেকে জানার জন্য অপেক্ষা করতেন।
বাংলাদেশের বিমানের একই ফ্লাইটে গাফফার চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরাও দেশে এসেছেন। একাত্তরের মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক জয়বাংলার নির্বাহী সম্পাদক গাফফার চৌধুরী দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পদকে ভূষিত ছিলেন।
পেশায় সাংবাদিক গাফফার চৌধুরী কলামনিস্ট হিসেবে ছিলেন সুপরিচিত। গল্প-কবিতা-উপন্যাসেও তিনি রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর। খবর বিডিনিউজ।