প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ : চেতনার বাতিঘর

70

মো. আবদুর রহিম

ইতিহাসের ধ্রুবতারা, চেতনার বাতিঘর, উদার মনের মহৎপ্রাণ মানুষ প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ আজ থেকে ১০ বছর পূর্বে ২০১০ সালের ২৮ নভেম্বর পৃথিবী ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। প্রফেস ড. আবু ইউসুফ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়ন শেষে একই বিশ^বিদ্যালয়ে প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক, প্রো-ভিসি ও সর্বশেষ ভিসি পদে আসীন ছিলেন। ২০০১ থেকে ২০০৫ সালে প্রো-ভিসি পরে উপাচার্য নিযুক্ত হন। প্রফেসর আবু ইউসুফ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে আসীন থাকাকালে ২০১০ সালের ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে ব্রেইন স্টোক করে মারা যান। তার মরদেহ দাফন নিয়ে কিছুটা মতভেদ তৈরি হয়। তাঁর পরিবারের সকলে তাকে পারিবারিক কবরস্থান চৈতন্য গলিতে দাফন করার ইচ্ছা পোষণ করেন। আবু ইউসুফের কলিগরা চান তাঁর দেহ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে। পরে বিশ্ববিদ্যিালয়ের সেন্ট্রাল মসজিদের পাদদেশে তাকে দাফন করা হয়। ওখানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি আর আর চৌধুরী’র কবরও রয়েছে। ড. আবু ইউসুফের ৩ দফা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম জানাজা জমিয়তুল ফালাহ্ জাতীয় মসজিদ ময়দান, মরহুমের জন্মস্থান মাদারবাড়ি ও সর্বশেষ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে। মরহুম এ শিক্ষাবিদের জানাজায় মন্ত্রী, মেয়র, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সাংসদ, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদসহ নানা শ্রেণির পেশার প্রায় ২০ হাজার মানুষ শরিক হন। প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অধ্যয়নকালে তার ক্লাসমেট খুলনার সম্ভ্রান্ত পরিবারের খ্যাতিমান নারী যিনি মাস্টার ডিগ্রি (এম.এ.) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শেষ করেন সেই সুশিক্ষিত মহিলা রওশন আরা ‘সুকু’কে বিয়ে করেন। এই যুগলের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় খুলনায় ১৯৭৩ সালের ১৫ মে। প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ উচ্চতর ডিগ্রি পিএইচডি করার জন্য ইন্ডিয়ান সরকারের বৃত্তি নিয়ে স্ত্রীসহ দিল্লীর জওহর লাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে অবস্থানকালে প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ সস্ত্রীক ভারতের বহু এলাকা ভ্রমণ করেন। তাছাড়া সেই সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া এবং শেখ হাসিনার দুই সন্তান জয় ও পুতুল ভারত সরকারের আশ্রয়ে ছিলেন। এ সময় বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীও বর্ধমানে ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সপরিবারে হত্যার পর জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৬ মে ১৯৮১ পর্যন্ত ভারতে নির্বাসনে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু’র কন্যা শেখ হাসিনা ও প্রফেসর ড. আবু ইউসুফের মধ্যে মাঝে মধ্যেই দেখা সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হতো। উভয়ে উভয়ের পরিবারে যাতায়াত ছিল এবং খাওয়া-দাওয়াও হতো। সেই সময় প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ সস্ত্রীক ভারতে থাকাকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সহ জ্ঞানী-গুণী ও সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গের সাথে দেখা সাক্ষাৎ ও ভাববিনিময় হয়। ড. আবু ইউসুফ বিবাহিত জীবনে এক কন্যা সন্তানের পিতা। বিয়ের প্রায় ১০ বছর পর কন্যা রুহি মাহজাবীনের জন্ম হয়। পিতার প্রাণের ধন রুহি মাহজাবীন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংলিশ বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ এর মৃত্যুর ৪০ দিন পর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশলী ফরহাদুল আলম এর সাথে তাঁর একমাত্র মেয়ে রুহি মাহজাবীনের বিয়ে হয়। বিয়েতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনা ২ লক্ষ টাকা উপহার দেন। এ বিয়েতে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মশিউর রহমান, মুখ্যসচিব আবদুল করিম, মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, প্রিমিয়ার বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. অনুপম সেন সহ ড. আবু ইউসুফ এর বন্ধু-বান্ধব, বিশ^বিদ্যালয় পরিবারের সদস্যবৃন্দসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। বর্তমানে রুহি মাহজাবীন ২কন্য ও ১ ছেলে সন্তান নিয়ে স্বামী ও মা রওশন আরা ইউসুফ এর সাথে পিতার নির্মিত বাড়িতেই বসবাস করছেন। এই দম্পতি শ্বশুরবাড়ির সম্মতিতেই পিতার বাড়িতে মাকে নিয়ে বসবাস করছেন। প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ আমার সরাসরি শিক্ষক। আমি এইচএসসি (বিজ্ঞান) পাস করার পর চাকুরীজীবন শুরু করি। চাকুরীরত অবস্থায় এইচ.এস.সি পাসের প্রায় ১০ বছর পর সিটি কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে এম.এ. ডিগ্রি নেয়ার জন্য ভর্তি হই। সেই সময় থেকেই আবু ইউসুফ এর সান্নিধ্যে আসি এবং তাঁর সাথে বঙ্গবন্ধু পরিষদ এর সংগঠক হিসেবে কাজ করতে থাকি। পর্যায়ক্রমে প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ এর সাথে খুবই ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠে। সাবেক মেয়র মরহুম এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে প্রফেসর ড. আবু ইউসুফের সম্পর্ক ছিল আপন সহোদর ভাইয়ের মত। গণতান্ত্রিক আন্দোলন সহ সববিষয়ে প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ ছিল এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী খুবই ঘনিষ্ঠজন। ১৯৮৬ ও ১৯৯১ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৪ সাল, ২০০০ সাল ও ২০০৫ সালের মেয়র নির্বাচনে গঠিত নাগরিক কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর ড.আবু ইউসুফ। সেই সময়ে প্রয়াত মেয়র ইতিহাসের কিংবদন্তি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী’র খুব কাছে থেকে রাজনীতির অঙ্গনে আমিও ছিলাম।
মাননীয় মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর একজন কর্মচারী হিসেবেও তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত খুব নিকটে আমি ছিলাম। বিশেষ করে ২০০৭ ও ২০০৮ সনের দুর্দিনে যখন প্রফেসর ড. আবু ইউসুফের উপর নির্যাতন নেমে আসে সেই সময়েও আমি তাঁর খুব কাছে ছিলাম। ১/১১ সামরিক সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময় তৎকালীন মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী কারাগারে থাকাকালীন সময়ে প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী’র মুক্তির জন্য নানাভাবে তৎপর ছিলেন। ড. আবু ইউসুফ এর নির্দেশ ও পরামর্শ নিয়েই আমি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে কর্মরত ছিলাম এবং তৎসময়ে এই শিক্ষাবিদকে রক্ষা এবং বহুরাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জেল-জুলুম থেকে রক্ষার নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করার চেষ্টা করি। দুঃখের বিষয় যে, তিনি তখন দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে বাংলাদেশ ও ভারতে চিকিৎসা শেষে পঙ্গুত্ব নিয়ে নিজ বাসভবনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ১/১১ সরকারের নির্যাতনকে মাথায় নিয়ে এ শিক্ষাবিদ ও মহৎপ্রাণ মানুষটি সাহস ও দৃঢ়তার সাথে বৈরি পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করেছেন। তিনি সরকারের রোষানলে থাকার পরও পঙ্গুত্ব অবস্থায় মনোবল হারাননি। ড. আবু ইউসুফ শত প্রতিকূলতা অতিক্রম করেছেন সাহসের সাথে। তিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ ও তাঁর আদর্শ ধরে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন, জনমত গঠন ও প্রতিবাদীদের পক্ষ অবলম্বন করে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মৌলভী সৈয়দ আহমদ সহ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদীদের সাথে ছিলেন। সর্বশেষ ১/১১ সরকারের দুঃসময়ও তিনি সাহসের সাথে মোকাবেলা করেন। স্বৈরাচার ও সামরিক স্বৈরাচারদের স্বৈরশাসনেরও প্রতিবাদী যোদ্ধা প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ। তিনি প্রথিতযশা ইতিহাসবিদ ও বরেণ্য বুদ্ধিজীবী। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন লালন করে জীবনভর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন শুদ্ধাচারী মানবসম্পদ। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব এবং ১৯৯৩ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার মহাসচিবের দায়িত্ব ও পালন করে ইতিহাসে অমর অক্ষয় হয়ে আছেন। প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়কে একটি আদর্শ উচ্চ শিক্ষাপীঠ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। একজন খাঁটি বাঙালি ও মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনার ধারক হিসেবে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব। এই শিক্ষাবিদ নীতি-আদর্শের সাথে আপোস করেননি, আদর্শচ্যুত হননি কোন লোভ-লালসা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। স্বাধীনতা বিরোধীদের সন্ত্রাস, নৈরাজ্য প্রতিরোধ, সমাজের সকল কল্যাণময় কর্মকান্ডে অগ্রণী ভূমিকা ছিল প্রফেসর ড. আবু ইউসুফের। দেশ ও জাতিকে মূল স্রোতধারায় ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অর্থাৎ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আদর্শে পরিচালনার লক্ষ্যে তিনি ছিলেন শতভাগ খাঁটি মানুষ। শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন ও রাজনীতির মাঠ এসব ক্ষেত্রে খুব কাছে পাওয়া বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও প্রগতিশীল শিক্ষাবিদের মহাপ্রয়ান আমাদের চলার পথকে বাধাগ্রস্ত করেছে। আশা করি প্রজন্ম এই মহৎপ্রাণ নির্ভীক বুদ্ধিজীবীর অনুসরণ ও অনুকরণ করে দেশপ্রেমে বলিয়ান হয়ে দেশের সেবায় আত্মনিয়োগে উৎসাহিত হবেন।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা স্মৃতি পরিষদ