প্রতিবন্ধী কল্যাণ : সমঅগ্রযাত্রা হোক সমাজের অঙ্গীকার আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস-২০১৯

207

কয়েকদিন পরপর তারা আমাকে ফোন করে। বিভিন্ন দাবি নিয়ে, মনের আকুতি নিয়ে বা তাদের একান্ত চাওয়া-পাওয়া নিয়ে। এরা কারা, কাদের কথা বলছি ? যারা শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষম ব্যক্তি, বলছি তাদের কথা। গত একমাস পূর্বে শামসু নামে কৃষি ডিপ্লোমাধারী এক শারীরিক প্রতিবন্ধী ফোন করল। আবেগী কন্ঠে প্রশ্ন করল, স্যার আমার কি কখনো সরকারি চাকুরী হবে না! শফি নামের এক শারীরিক প্রতিবন্ধী ফোনে জানাল তার একটি কৃত্রিম পা প্রয়োজন। নাছির নামের এক শারীরিক প্রতিবন্ধী ঘনঘন ফোন করে জানায়, তার চলাচলের জন্য একটি হুইল চেয়ার দরকার। শুধুমাত্র একজন পেশাদার সমাজকর্মীর নিকট আস্থার দাবি নিয়ে তাদের এ আবেদন। এধরনের ফোন আসে বান্দরবান পার্বত্য জেলার বিভিন্ন প্রান্ত হতে। যেখানে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার হিসেবে কাজ করেছি দীর্ঘ একযুগ। একজন পেশাদার সমাজকর্মী হিসেবে নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ করেছি তাদের অসহায়ত্বের কথা, কষ্টের কথা এবং অতৃপ্ত জীবনের কথা।
আজ জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস। সমগ্র বিশ্বের সকল প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের দিন। প্রতিবন্দ্বীতা বিষয়ক সচেতনতা সর্ব মহলে প্রচারের অনন্য দিন। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদেরই অতি আপনজন। প্রশ্ন হল প্রতিবন্ধী কারা ? কাদের আমরা প্রতিবন্ধী বলছি ? প্রতিবন্দ্বীতা হলো মানুষের স্বাভাবিক কর্ম অক্ষমতা। কোন ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত ও বিকাশগত প্রতিবন্ধকতা। যার ফলে এই ব্যক্তি সমাজে দৃষ্টি ভঙ্গিগত এবং পরিবেশগত বাধার সম্মুখীন হয়। স্বাভাবিক অক্ষমতার কারণে তারা সমাজের পিছিয়ে পড়া এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠী। জাতিসংঘ এ অবহেলিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করে ১৯৭৬ সালে। জাতিসংঘ ১৯৮১ সালকে আন্তর্জাতিক ‘প্রতিবন্ধী বর্ষ’ এবং (১৯৮৩-১৯৯২) সালকে আন্তর্জাতিক ‘প্রতিবন্ধী দশক’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সাল হতে ৩ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও ১৯৯৯ সাল হতে দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘অভিগম্য আগামীর পথে’ (future is accessible)।
মানবের সুস্থতা ও সক্ষমতা মহান ¯্রষ্টার অনন্য আশীর্বাদ। সক্ষম ব্যক্তির বিচরণ সমাজের সর্বত্র। স্বাধীনভাবে পথচলা, কথা বলা, উপার্জন করা, চিত্ত-বিনোদন, শিক্ষাগ্রহণ ও সামাজিক দায়িত্ব পালনসহ নানান কাজ তাদের পক্ষে অতি সহজ। কিন্তু একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ক্ষেত্রে জীবনচিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে ব্যক্তি শারীরিক ও মানসিক ভাবে অক্ষম, যার কথা বলতে বাধা, কানে শুনেনা বা যিনি চোখে দেখেনা তাদের পক্ষে কি স্বাভাবিক জীবন চলা সম্ভব! মানুষ হিসেবে তারা জীবনের ন্যূনতম চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারছেনা। দরিদ্রতা, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, মতপ্রকাশ, যৌন নির্যাতনসহ বিবিধ সংকটে দুর্বিষহ তাদের জীবন। নাগরিক হিসেবে বঞ্চিত হচ্ছে প্রাপ্য অধিকার হতে।
বিশ্বব্যাপী প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সামাজিকভাবে অবহেলা, অবজ্ঞ ও বৈষম্যের শিকার। আমাদের দেশেও প্রতিবন্ধীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক নয়। সমাজে তাদেরকে ডাকতে শুনা যায়- ল্যাংড়া, কানা, খোঁড়া, আন্ধ্যাঁ, পাগলা, আতুড়, বোবা ইত্যাদি নানান অবজ্ঞা সূচক নামে। প্রতিবন্ধীতাকে ভাবা হচ্ছে পিতা-মাতার কৃতকর্মের ফল, পূর্বপ্রজন্মের কৃতকর্মের ফল, কুসংস্কার, ধর্মীয় অপব্যাখ্যাসহ নানানভাবে প্রতিবন্ধী পরিবারকে প্রতিনিয়ত হেয় করা হয়। এই প্রতিবন্ধীতার জন্য দায়ী করা ? নিশ্চই সমাজ বা রাষ্ট্রের অবহেলা। চিকিৎসা শাস্ত্র মতে মানব শিশুর অপুষ্টি, সুষম খাদ্যের অভাব, চিকিৎসাহীনতা, অপচিকিৎসা, গর্ভকালীন পরিচর্যার অভাব, জন্মগত ত্রুটি, দুর্ঘটনাসহ নানান কারণে মানুষ প্রতিবন্ধি তার শিকার হচ্ছে। এ জন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কোনভাবে দায়ী নয়। এ ব্যর্থতার দায় পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা সকলের।
গত ২৯অক্টোবর, ২০১৯ দৈনিক ‘প্রথম আলো’ প্রত্রিকায় ৮৪% প্রতিবন্ধী নারী নির্যাতনের শিকার মর্মে একটি সংবাদ প্রকাশ হলো। এ প্রতিবেদনে দেখা যায় প্রতিবন্ধী মেয়েরা বাল্য বিবাহের শিকার, প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের হার ১৮ গুণ বেশি, জোরপূর্বক বন্ধ্যুত্বকরণ করা হচ্ছে প্রতিবন্ধী নারীদের এবং ৯০ শতাংশ প্রতিবন্ধী নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার সংরক্ষণে আমাদের ব্যর্থতা অনেক ক্ষেত্রে। খবরে প্রায় প্রকাশ হয়, ধর্ষণের শিকার প্রতিবন্ধী শিশুরাও। শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে এবছর ২২জন প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যাহা এ সমাজের জন্য চরম লজ্জা। ব্যস্তময় রাস্তার মোড়ে বা আদালত প্রাঙ্গণে বা মাজার চত্বরে দেখা যায় প্রতিবন্ধী শিশু নিয়ে পরোক্ষ ভিক্ষাবৃত্তি। আরো দেখা যায়, বিকলাঙ্গ শরীর নিয়ে পেশাদার ভিক্ষুক হিসেবে অলি-গলি ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য। ফুটে উঠে প্রতিবন্ধী সমাজের বিপন্নতার চিত্র।
অনেক সক্ষম প্রতিবন্ধী ব্যক্তি দেখা যায়। যাদের আছে কর্মস্পৃহা ও কর্ম সক্ষমতা। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি সেক্টরে তাদের কর্মসংস্থান অতি নঘন্য। ফলে তারা ভিক্ষাবৃত্তির পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। শিক্ষা কোন মানুষের বিশেষ সুযোগ নয়, বরং অধিকার। সর্বত্র প্রতিবন্ধীবান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থা দ্রæত প্রচলন করতে হবে। বিশেষত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী ও স্নায়ুবিক বিকাশজনিত শিশু শিক্ষার বিকাশে বিদ্যমান পরিবেশ উন্নত করতে হবে। প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে উপযুক্ত শিক্ষক স্বল্পতা চরমে। এ সংকট নিরসনে বিভাগীয় উদ্যোগ গ্রহণ অতি জরুরি।
বাংলাদেশের সংবিধান মানবাধিকারের এক অনন্য দলিল। সংবিধানের ১৪, ১৫, ১৭, ২০, ২৭ ও ২৯ অনুচ্ছেদে দেশে সকল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী ও স¤প্রদায়ের সমঅধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদে উল্লেখ্য “সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃ-পিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ পরিস্থিতিজনিত আয়ত্বিত করণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার আছে”। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে উদ্যোগে ১৯৭৪ সালে দৃষ্টিহীনদের জন্য প্রবর্তন করা হয় ‘সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম’। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হলে, শুরু হয় প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিশেষ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। তাঁর শাসনকালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কল্যাণে দু’টি বিশেষ আইন প্রণীত হয়েছে। আইন দু’টি হলো ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩’ এবং ‘নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন-২০১৩’। প্রণীত আইনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পূর্ণমাত্রায় বাঁচিয়া থাকা, আইনী স্বীকৃতি, উত্তরাধিকার প্রাপ্তি, শিক্ষার সুযোগ, চিকিৎসার সুযোগ, কর্মসংস্থান সহ সকল নাগরিক অধিকারের বিধান রাখা হয়েছে। দেশে মোট প্রতিবন্ধীর সংখ্যা- ১৭ লক্ষ ৯ হাজার ৯৪৪ জন। প্রতিবন্দ্বী বান্ধব বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধী মানুষের কল্যাণে সরকার চালু করেছে নানান কর্মসূচি। অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি, প্রতিবন্ধী পুনর্বাসনে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম, প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র চালু, অটিজম রিসোর্স সেন্টার স্থাপন, অবৈতনিক অটিজম স্কুল চালু সরকারের অনন্য উদ্যোগ।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ঐশ্বরিক ক্ষমতা প্রাপ্ত এবং প্রকট মেধা শক্তির অধিকারী। সভ্যতার ক্রমবিকাশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভূমিকা অনন্য। মার্কিন নাগরিক হেলেন কেলার, গ্রীস দার্শনিক- কবি হোমার, আইনষ্টাইন ও আধুনিক বিশ্বের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ষ্টিফিন হকিন্স হলেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। বর্তমান বৈশ্বয়িক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ঝউএ-২০৩০। এ লক্ষ্য অর্জনের এর মূলমন্ত্র হচ্ছে কাউকে পশ্চাতে রেখে নয় (No one will be left behind)। সমাজের সকলকে সাথে নিয়ে সামগ্রিক উন্নয়ন। এসডিজি’র ১৭টি লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের কথা সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ আছে। বিশেষত প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, যানবাহনে চলাচলের সুযোগ, দারিদ্র্য বিলোপ সাধন, সর্বস্তরে অংশগ্রহণের সুযোগসহ সার্বিক দিকনির্দেশনা আছে।
আজ যারা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশে বিকশিত সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। তারাই এ সমাজের নিয়ন্ত্রক। সমাজের অসহায়, দুর্দশাগ্রস্ত, বিদ্ধ, বিধবা, এতিম ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সকল প্রকার সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে এগিয়ে আসতে হবে তাদেরকেই । যারা আজ সুস্থ, সক্ষম ও স্বাভাবিক মানুষ। তবেই জাগতিক কল্যাণ এবং পরকালীন মুক্তি। সমঅধিকার নাগরিকের প্রাপ্য। সমঅগ্রযাত্রা হোক আমাদের অঙ্গীকার। বৈষম্যহীন প্রতিবন্ধীবান্ধব সমাজ হোক আমাদের প্রচেষ্টা। জয় হোক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর।

লেখক : সহকারী পরিচালক
সমাজসেবা অধিদফতর বিভাগীয় কার্যালয়, চট্টগ্রাম