পুরো রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাটা বিপজ্জনক জোন

17

তুষার দেব

ভয়ঙ্কর ক্রাইম জোনে পরিণত হয়েছে কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়ার পুরো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। মানবিক কারণে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এখন ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’। ক্যাম্পগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিসহ (আরসা) ১০ অপরাধী চক্রের বেপরোয়া তৎপরতা চলছে। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি ও হানাহানি এখন ডাল-ভাতের মত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে কক্সবাজারের হোটেলগুলোতে যৌন পেশায় জড়িয়ে পড়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নারী। যা পুরো কক্সবাজার অঞ্চলে এইচআইভি-এইডসসহ মরণঘাতী নানা ব্যাধির সংক্রমণের ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। নতুন করে অস্বস্তি তৈরি করেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা।
জানা গেছে, সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে দুষ্কৃতিকারীদের হামলার ঘটনায় নুর কায়েস (২৫) নামে এক রোহিঙ্গা নারী নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া অপর হামলায় রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতা (হেডমাঝি) আব্দুর রহিমসহ (৩৮) দুজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নিহত নুর কায়েস উখিয়ার বালুখালী ৮-ইস্ট নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বি-৫৭ ব্লকের বাসিন্দা মো. নজুমউদ্দিনের স্ত্রী। পৃথক ঘটনায় আহতদের মধ্যে আব্দুর রহিম উখিয়ার ময়নারঘোনা ১২ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জি-১ ব্লকের বাসিন্দা করিম উল্লাহর ছেলে। তিনি ময়নারঘোনা ১২ ক্যাম্পের প্রধান কমিউনিটি নেতা (হেড মাঝি)। আহত অন্যজন হলেন, বালুখালী ৮-ইস্ট নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বি-৫৭ ব্লকের বাসিন্দা আরাফাত হোসেন।এদিকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ে ‘উদ্বেগজনক’ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এতে তথ্য প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বর্তমানে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিসহ (আরসা) তিনটি সন্ত্রাসী গ্রুপ ও সাতটি ডাকাত দল রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ক্যাম্পের ওপর আরসার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। জিরো লাইনে অবস্থিত তুমব্রু কোণাপাড়া ক্যাম্পটিতে নিয়মিত টহল ও নজরদারি জোরদার করতে না পারার কারণে সেখানে আরসার সাংগঠনিক কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ, মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, রোহিঙ্গা শিবিরে সক্রিয় দশ সশস্ত্র দলের মধ্যে আরসা সক্রিয় রয়েছে উখিয়া, বালুখালী, পালংখালী ও হোয়াইক্যংয়ে, আরএসও ও মাষ্টার মুন্না দল উখিয়ার পালংখালীতে, ইসলামী মাহাজ ও জাবু ডাকাত দল হোয়াইক্যংয়ে, নয়াপাড়া ক্যাম্পে চাকমা ডাকাত দল, নবী হোসেন ডাকাত দল, পুতিয়া ডাকাত দল, সালমান শাহ ডাকাত দল ও খালেক ডাকাত দল সক্রিয় রয়েছে। বেশিরভাগ শিবিরের উপর আরসার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে উল্লেখ করে এতে আরও বলা হয়, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আরসা ও নবী হোসেন ডাকাত দল প্রায়ই মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং হতাহতের ঘটনা ঘটে।
প্রতিবেদনে ২০২১ ও ২০২২ সালে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘটিত অপরাধমূলক কর্মকান্ডের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাতে সার্বিক অপরাধ কিছু কমেছে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে এসময় বেড়েছে হত্যাকান্ড ও হানাহানি। ২০২১ সালে যেখানে ২২টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে, ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় ৩২টি। এছাড়া ২০২১ সালের চুরি-ডাকাতির ঘটনা ৭৭ থেকে কমে ২০২২ সালে ৭৫টি, গোলাগুলির ঘটনা ৫১টি থেকে ১৮টি, অপহরণের ঘটনা একশ’ ৭৩টি থেকে কমে ৮৬টি, অন্তর্দলীয় সংঘাত ১১টি থেকে কমে একটি, মাদকের ঘটনা দুইশ’ ৬৮টি থেকে দুইশ’ ৪৯টি এবং অন্যান্য অপরাধ পাঁচশ’ ৬৭টি থেকে কমে পাঁচশ’ ৫৩টি সংঘটিত হয়েছে। এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দুইশ’ ২২টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ৯৯টি দুর্ঘটনাজনিত ও ৬০টি নাশকতামূলক এবং ৬৩টির কারণ জানা যায়নি। উদ্বেগজনক তথ্য হলো, রোহিঙ্গা এলাকা এইচআইভি- এইডস, হেপাটাইটিস সি, ডিপথেরিয়া ইত্যাদির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এখন পর্যন্ত কক্সবাজারে সাতশ’ ১০ জন এইচআইভি পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। এরমধ্যে ছয়শ’ ১২ জনই রোহিঙ্গা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬১ জন রোহিঙ্গা এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। পাঁচ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নারী কক্সবাজারে বিভিন্ন হোটেলে যৌন পেশায় জড়িত রয়েছেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন ৯৫ জন শিশু জন্মগ্রহণ করে। সেই হিসেবে আগামী ২০২৫ সালে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ১২ থেকে ১৩ লাখ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয় আট লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে আসে আরও কয়েক লাখ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। সেসময় ছয় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের কোনারপাড়া খালের দক্ষিণে শূন্যরেখায় বসতি শুরু করে। ওই আশ্রয়শিবিরের কয়েক গজ দূরত্বে মিয়ানমার সীমান্ত কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। শূন্যরেখায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নজরদারিতে কাঁটাতারের বাইরে পাহাড়চূড়ায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) একাধিক চৌকি স্থাপন করা হয়েছে। এর বাইরে তমব্রুর কোনারপাড়া শূন্যরেখা আশ্রয়শিবিরে ছয়শ’ ২১টি পরিবারে চার হাজার দুইশ’ রোহিঙ্গা বসবাস করছিল। শুরুতে শূন্যরেখার এই শিবিরে এক হাজার তিনশ’ ২১ পরিবারের ৬ হাজার ২২ জন রোহিঙ্গার বসবাস ছিল। তাদের বাড়ি এই আশ্রয়শিবিরের পেছনে দেড় থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ১২টি গ্রামে।