পনরই আগস্ট: অতঃপর নির্মমভাবে প্রাণ হারালেন মৌলভী সৈয়দ ভারতের মাটিতে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ফেরার জীবন

118

 

মাওলানা সৈয়দ আহমদ। মৌলভী সৈয়দ নামে যিনি পরিচিত। একাত্তরের এই গেরিলা কমান্ডার স্বাধীন দেশে আরও একবার অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। পঁচাত্তরে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর। তবে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের দোর্দন্ড প্রতাপের মুখে বেশিদিন টিকতে পারেননি এই যোদ্ধা। নির্মমভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার জীবনপ্রদীপ। বিপ্লবী জীবনের নির্মম পরিসমাপ্তি ঘটিয়েই সেদিন ক্ষান্ত হয়নি শাসকগোষ্ঠী। মৌলভী সৈয়দের বাবা একরাম সিকদারকে ঢাকায় সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ছেলের মরদেহ শনাক্ত করতে। নিজের চোখের সামনে সন্তানের ছিন্নভিন্ন মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল হতভাগ্য বাবাকে। মানসিক ভারসাম্য প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলেন মৌলভী সৈয়দের বাবা-মা দুজনই। সন্তান হারানোর ব্যথা নিয়ে দুজন ছিলেন আরও কয়েক বছর। বাঁশখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাদ্রাসা থেকে আলেম পাশ করে মৌলভী সৈয়দ শহরে এসে সিটি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পৌঁছেছিলেন নেতৃত্বের কাতারে। ১৯৭১ সালের মার্চে ‘জয় বাংলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’ গঠিত হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন মৌলভী সৈয়দ এবং এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী (সাবেক মেয়র)। মৌলভী সৈয়দ একাত্তরে নৌকমান্ডোদের দুঃসাহসিক অপারেশন জ্যাকপটের সফল অপারেশনের প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে গেরিলাদের আসা ও তাদের কর্ণফুলী নদীর অপর তীরে পৌঁছে দিতে রুট ক্লিয়ারেন্স নিশ্চিত করেন, গেরিলা কমান্ডার হিসেবে রনাঙ্গনে ছিল তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা।
’৭৫ পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারের নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের অনেক বাঘা বাঘা নেতা ভয়ে চুপসে গিয়েছিলেন বা খোলস পাল্টাতে তৎপর ছিলেন। আর সে সময়ই মৌলভী সৈয়দ সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন সামরিক জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে। ১৯৭৫ এর নভেম্বরের দিকে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেছিলেন। ঘাতকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান হলে, খালেদ মোশারফের পক্ষে ঢাকায় সমাবেশের উদ্যোক্তাদের অন্যতম ছিলেন এই বীর যোদ্ধা। ৭ নভেম্বর পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে যখন খালেদ মোশারফ নিহত হন, তখন মৌলভী সৈয়দ, এ.বি.এম. মহিউদ্দীন চৌধুরী চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধে নানা কর্মসুচি শুরু করেন। পঁচাত্তরের অক্টোবরে সামরিক আইনে গ্রেফতারের হয়ে যায় এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, ছয় মাস পর তিনি জামিনে মুক্তি লাভ করে। অতঃপর ১৯৭৬ সালের ৭ নভেম্বর দেশদ্রোহিতার অভিযোগে মৌলভী সৈয়দকে ১ নং ও এ.বি.এম. মহিউদ্দীন চৌধুরীকে ২ নং আসামি করে মোট ১৬ জন বিপ্লবী নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা-১, মামলা-২, মামলা-৩ নামে পরিচিত ৩টি মামলা দায়ের করা হয়। সহ পুরো দলটি ভারতে আশ্রয় নেয়। কিছু দিন পর মহিউদ্দিন চৌধুরীও ভারতে চলে যান এবং মৌলভী সৈয়দের সঙ্গে যোগ দেন। এখানে বসেই তাঁরা ‘মুজিব বাহিনী’ নামে একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার কাজে হাত দেন। মৌলভী সৈয়দ বাহিনীর প্রধান ও মহিউদ্দিনর চৌধুরী ডেপটি প্রধানের দায়িত্ব নেন। শুরু করলেন খুনী চক্রকে সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ শেষে অনেক যোদ্ধাই দেশে ফিরে কর্মকাÐ শুরু করেন। কিন্তু ১৯৭৭ সালের মাঝামাঝিতে ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে যায়। ভারতের জাতীয় নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর দল পরাজিত হলে মোরারজী দেশাই সরকার গঠন করেন। এতে সশস্ত্র প্রতিবাদের পরিকল্পনায় ছেদ পড়ে। প্রশিক্ষণরত নেতাকর্মীদের পুশ ব্যাক করার পরিকল্পনা নেয় নব গঠিত ভারত সরকার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভিন্ন সীমান্ত পথে মুজিব বাহিনীর সদস্যদের পুশ ব্যাক করতে শুরু করে। মৌলভী সৈয়দ ও সহকর্মীদের ভারতীয় সামরিক বাহিনী আটক করে ময়মনসিংহ বর্ডার দিয়ে ১৯৭৭ সালে ৬ আগস্ট পুশব্যাক করে। বাংলাদেশের সীমানার প্রবেশের সাথে সাথে সেদিন মৌলভী সৈয়দ সহ তার অনেক সহকর্মী গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে তাদের ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয়। ওই বছরের ১১ আগস্ট বিনা বিচারে মৌলভী সৈয়দকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
চট্টগ্রামসহ এই জনপদের মানুষের কাছে মৌলভী সৈয়দ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের হিরো। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী হিসেবে ঘুরেফিরে তাঁর নাম উঠে আসে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল-মুজিবপ্রেমে অন্ধ মৌলভী সৈয়দ ছিলেন অতিমাত্রায় সাহসী। তিনি সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন দেশের সীমানার ভিতরেই। ভারত বর্ডার ক্রস করে দেশের ভিতরে ঢুকে অপারেশনে অংশ নিতেন তিনি। যখন কালো মুজিব কোট বদলে আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা খুনি মুশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানের জন্য উদগ্রীব ছিলেন, অনেক আওয়ামী লীগ মন্ত্রী, এমপির বাসার ড্রয়িং রুম থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ফেলা হয়, তখন চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দ অস্ত্র আর গ্রেনেড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশের বিভিন্ন স্থানের সামরিক চৌকিতে। স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান বিচারের নামে প্রহসন করে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিলেন। সংগ্রামের মাধ্যমে যার জীবন শুরু, সংগ্রাম করেই জীবন দিয়ে গেলেন বীর শহীদ মৌলভী সৈয়দ। চিরকুমার শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ বীর প্রসবিনী চট্টলার বীরপুরুষ, প্রতিবাদের আইকন। অসামান্য দেশপ্রেমের অধিকারী এই বীর পুরুষটি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশসেবায়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভালবাসা ছিল নজিরবিহীন। চট্টগ্রামের প্রয়াত জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে রাজনৈতিক দীক্ষায় অনুপ্রাণিত মৌলভী সৈয়দ ছাত্রাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য লাভ করেন। তার সামনে চট্টগ্রামের কেউ পড়লে তিনি ডাক ছাড়তেন, কোথায় আমার মৌলভী সৈয়দ। বঙ্গবন্ধু মৌলভী সৈয়দকে পুত্রসম স্নেহ করতেন এবং আমার মৌলভী সাব বলে ডাকতেন।
ভারতের মাটিতে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ফেরার জীবন : মহিউদ্দিন চৌধুরী ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে এর আগে চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হয়েছিল। এ অবস্থায় গ্রেপ্তার এড়াতে মহিউদ্দিন চৌধুরী চৌদ্দগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ভারত চলে যান। ভারতে গিয়ে মৌলভী সৈয়দ আহমদের সাথে যোগাযোগ করে সহযোদ্ধা সাথীদের নিয়ে ভারতের আগরতলায় ‘মুজিব বাহিনী’ নামে একটি বিপ্লবী বাহিনী গঠন করেন। ঐ বাহিনীর প্রধান মৌলভী সৈয়দ ও ডেপুটি প্রধান এ.বি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তাঁরা সেখানে ভারত সরকারের সহযোগিতায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করেন। উক্ত ক্যাম্প থেকে বিপুল সংখ্যক যোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশে প্রেরণ করেন। কিন্তু ১৯৭৭ সালের মাঝামাঝিতে ভারতে সরকারের পরিবর্তনের ফলে তাঁদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ভারতে নতুন গঠিত সরকার ভারতে আশ্রিত বিপ্লবীদের সকলকে পুশব্যাক করতে শুরু করে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে মহিউদ্দিন চৌধুরী গোপনে আগরতলা থেকে কোলকাতায় গিয়ে ফেরার জীবন শুরু করেন। কোলকাতায় অবস্থান করে মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রতিনিয়ত দেশের খবরা-খবর সংগ্রহ করতেন সহযোগীদের কাছ থেকে। রাজনৈতিক মামলার কারণে ফেরার ঐ জীবন-জীবিকার তাগিদে তিনি কলকাতার ওয়েলিংটন মোড়ে সাঙ্গুভেলি নামের একটি রেস্তোরাঁয় দৈনিক পাঁচ টাকা বেতনে কাজে যোগ দেন। রেস্তোরাঁর মালিক অজিত বড়–য়া ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর বন্ধু। তাঁর আদি বাড়ি চট্টগ্রামে। এ চাকরিতে তাঁকে মাঝে-মধ্যে টি বয়ের মতো কাজও করতে হয়েছে। এর পাশাপাশি বাড়তি রোজগার করতেন শিয়ালদহ রেলস্টেশনে পত্রিকা বিক্রি অর্থাৎ হকারের কাজ করে। এর আগে কলকাতায় তাঁকে সাব-কন্ট্রাকটরির কাজও করতে হয়েছে। সকাল-সন্ধ্যা শ্রম দিয়ে অর্জিত অর্থ দিয়ে নিজে চলেছেন। সাথে থাকা ফেরার বিদ্রোহী সতীর্থদেরও চালিয়েছেন। তাঁদের খাইয়েছেন তাঁরই কষ্টার্জিত অর্থে। শুভার্থী শ্যামল সেনকে বারাসাতে লন্ড্রি দোকান প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক সহযোগিতা দেন। একান্ত সহযোগী এই শ্যামল সেন যুদ্ধের আগে ও পরে নানাভাবে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে যে সহযোগিতা দেন তা তিনি এখনও কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করেন। অবিশ্বাস্য, অথচ সত্য ঘটনা। কলকাতা থেকে বাসে করে একদিন তিনি বর্ধমান যাচ্ছিলেন কাজে। একই বাসে প্রসববেদনা কাতর হত-দরিদ্র এক দেহাতী মহিলা যাত্রীও ছিল। পথিমধ্যে মহিলার প্রসববেদনা বেড়ে যায়। তার প্রসববেদনা লক্ষ্য করেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ড্রাইভারকে বাস থামানোর অনুরোধ জানালে ড্রাইভার বাস থামায়। মহিলার এই অবস্থা দেখে বাসযাত্রীরা সবাই একে-একে নেমে গিয়ে অন্য বাসে সওয়ার হয়। কিন্তু মহিউদ্দিন চৌধুরী ঐ মহিলার পাশে থেকে বাসের অভ্যন্তরেই মহিলার সন্তানপ্রসবে সহযোগিতা দেন। শিশুটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নিজ হাতে নাভি কাটেন। পরে বাস থেকে শিশুটিকে নিয়ে নেমে পানি দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে মায়ের কোলে তুলে দেন।
একদিনের আর একটি ঘটনা আরও রোমাঞ্চকর। সাঙ্গুভেলি রেস্তোরাঁয় কাজ করার সময় একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজন করছিলেন। হঠাৎ দেখতে পান রাস্তায় এক কুকুরের মুখে একটি হাঁড়ি। তাকে ধাওয়া করছে পথ-শিশুরা। হাঁড়ি নিয়ে কুকুরটি দৌঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি ভেসে আসছে শিশুর কান্নার আওয়াজ। স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছিল কান্নার আওয়াজ। এ সময় দ্রæতগতিতে চলে যায় একটি ট্রাম। বিকট আওয়াজে ভয় পেয়ে হঠাৎ কুকুরটির মুখ থেকে পড়ে যায় হাঁড়িটি। কিন্তু কান্নার আওয়াজ আসছেই। দাঁত মাজতে-মাজতে কৌতুহলী মন নিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী দেখতে যান হাঁড়িটি। রোমহর্ষক ঘটনা। হাঁড়িটির ভেতরেই চলছিল এক নবজাতকের বাঁচার জন্য আহাজারি। বেদনায় কাতর হয়ে পড়েন তিনি। কালবিলম্ব করলেন না। তিনি ধীরে সুস্থে হাঁড়িটি ভেঙ্গে বের করলেন রক্তাক্ত সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটিকে। দ্রæত ফিরে আসেন রেস্তোরাঁয়। উনুনের তাপ দিয়ে শিশুটির কান্না থামাতে সমর্থ হন। মুখে তুলে দেন মধু। পরে সোজা শিশুটিকে নিয়ে যান কলকাতার মাদার তেরেসা প্রতিষ্ঠিত অনাথ আশ্রমে। মাদার তেরেসার হাতে সমর্পণ করলেন শিশুটিকে। নোবেলবিজয়ী মাদার তেরেসা নিজ হাতে গ্রহণ করে নেন সৃষ্টির এই সেরা জীবকে। পরে দোকানের অন্যান্য কর্মচারীরা পরিচয়হীন অচ্ছ্যুৎ এক শিশুকে নিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর এ ঘটনা শুনে ‘রাম-রাম’ বলে জিগির তোলে।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে বেঁচে যাওয়া কলকাতার হতভাগ্য পিতৃ-মাতৃ পরিচয়বিহীন ঐ শিশুটি বেঁচে আছে, না ইহজগত ত্যাগ করেছেÑ সে ব্যাপারে কৌতূহলী মনে পরবর্তীতে একবার তার খোঁজ নিতে তিনি গিয়েছিলেন সেই আশ্রমে। আশ্রম কর্তৃপক্ষ তাঁকে জানান, ঐ শিশুটি বড় হয়েছে। তাকে কলকাতার সেন্টপল স্কুলে পড়ানো হচ্ছে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান তিনি। জন্মযুদ্ধে জয়ী শিশুটির ঘটনা মহিউদ্দিন চৌধুরীর জীবনে ভোলার নয়। স্মরণীয় হয়ে আছে।
কলকাতায় মহিউদ্দিন চৌধুরীর ফেরার জীবন কাটে প্রায় দু’বছর। তাঁর মতো প্রায় দেড় শতাধিক ফেরারি বিভিন্ন গ্রæপ হয়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করতেন। সেখানেও মারপিটে জড়িয়ে পড়তেন। স্থানীয়রা মহিউদ্দিন চৌধুরীকে নকশাল গ্রæপের সদস্য বলে মনে করত। কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সান্নিধ্য লাভ করেন। জ্যোতি বসুর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সাব-কন্ট্রাকটারির কাজ করে তিনি কিছু অর্থ উপার্জন করেন। সেখানে তিনি আগরতলার অধিবাসী এবং ‘মানিক চৌধুরী’ নামে পরিচিত হলেও জ্যোতি বসুর জানা ছিল তিনি বাংলাদেশী।
ঐ সময়ে দেশে সামরিক গোয়েন্দারা তালিকা তৈরি করে গ্রেপ্তার অভিযান শুরু করে। এরই মধ্যে ভারতে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়। আসে মোরারজী দেশাই সরকার। মুজিব হত্যার বদলা নিতে যাঁরা বদ্ধপরিকর হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন, দেশাই সরকার তাঁদের সহযোগিতা দেয়নি। উল্টো অনেককে ধরে পুশব্যাকের মাধ্যমে মোশতাক সরকারের পেটোয়া বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। এদের মধ্যে চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দ আহমদ ও শিশির দত্ত অন্যতম। ঢাকার জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে গোয়েন্দাদের অমানুষিক নির্যাতনেও নিজের নাম ও পরিচয় গোপন রেখেছিলেন মৌলভী সৈয়দ আহমদ। এক পর্যায়ে তাঁর বাবাকে বাঁশখালী থেকে ঢাকায় আনা হয় এবং তাঁর সামনে মৌলভী সৈয়দকে আনা হয়। জানতে চাওয়া হয় এই যুবককে চেনেন কিনা। নির্যাতনে রক্তাক্ত পুত্রকে দেখে পিতা কেঁদে ওঠে বলেন, ‘এতো আমার ছেলে মৌলভী সৈয়দ’। তখন অফিসার বলেন,‘ আপনি বাড়ি চলে যান। আপনার ছেলেকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে’। দু’দিন পরই অসীম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা মৌলভী ছৈয়দ জীবিত ফিরে আসতে পারেন নি, আসে মৌলভী সৈয়দের লাশ। লাশ হেলিকপ্টারযোগে বাঁশখালীতে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং সেনা-পুলিশের কড়া প্রহরায় দাফন করা হয়।
লেখক : গবেষক ও প্রকাশক