পদ্মা সেতু : স্বপ্নের বাস্তবায়ন

13

জিনাত কিবরিয়া

মাওয়া প্রান্ত থেকে মাদারীপুর পদ্মার দুই পাড়ে স্বপ্নের সেতু পদ্মা সেতু নির্মিত হয় যার দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। সেতু হয়ে এপার থেকে ওপারে যেতে সময় লাগে সর্বোচ্চ মাত্র ১০ মিনিট। ভাবতে গর্ববোধ হয়, এই সেতু নির্মান করতে বিদেশী বিশেষজ্ঞ, সরকারের সচিব থেকে শুরু করে সেতু বিভাগ কিংবা প্রকল্প পরিচালক, বাঙালি কর্মকর্তা আর ইঞ্জিনিয়ারগণ সম্পন্ন করলেন এক প্রায় অসম্ভব একটি প্রকল্প। পদ্মা সেতু চারটি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে- ১. প্রকল্পে ৩ মিটার ব্যাসের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্যরে ষ্টিল পাইলের ব্যবহার করা হয়েছে। ২. সবচেয়ে লম্বা ষ্টিলের স্প্যান বসানো হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। ৩. সর্বোচ্চ ক্ষমতার রিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে, যার নাম ̔ডবল কারভেচার ফ্রিকশন পেন্ডুলাম রিয়ারিং’। ৪. নদী শাসন কাজের একক সর্ববৃহৎ দরপত্র। তিনটি বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহারের বেলায় পদ্মা সেতু পৃথিবীতে প্রথম। পদ্মা সেতুর প্রযুক্তিতে সাতটি বিষয় আছে, যা বাংলাদেশে প্রথম। এমন একটা দুরূহ কাজ পৃথিবীর ২০টি দেশের বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় নানা সংস্থা আর হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে সুসম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ।
গত ২৫ জুন ২০২২ ইং শনিবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করলেন। ফলে বাংলাদেশে সড়ক পথে যোগাযোগের নতুন অধ্যায় শুরু হলো। ঢাকাসহ পুরো দেশের সঙ্গে যুক্ত হলো দক্ষিন ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ জেলা। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ইতিহাস লিখতে গিয়ে আমার দাদার একটি উপযুক্ত ও মূল্যবান কথা মনে পড়ে গেলো। আমার দাদা বলতেন, ‘শত্রæ থাকা ভালো,শত্রæ থাকলে উন্নতি হয়’। এই সময়ে এই উক্তিটি আমার এত উপযুক্ত মনে হয়েছে কারন স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্ধোধনের দিন মাননীয় প্রধানমনত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ̔২০০১ সালে আমি পদ্মা সেতুর জন্য ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছি। পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়া (বি এন পি) ক্ষমতায় এসে তা বন্ধ করে দিয়েছেন।
এদিকে পরবর্তীতে আমরা (আওয়ামীলীগ) ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালে স্বপ্নের সেতু নির্মানে কাজ শুরু করি। তখন তারা বলেছিলো, আওয়ামীলীগ নাকি কোনদিন পদ্মাসেতু নির্মান করতে পারবে না’। পদ্মা সেতু নির্মানের নানা ষড়যন্ত্রের কথা আরও উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি-ষড়যন্ত্রের কথা বলে টাকা বন্ধ করে দিল। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিতর জিদ চাপলো, উনি তখন জনসমক্ষে বললেন, নিজের অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মান হবে। তখন অনেক বড় বড় জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা বলেছিলেন, ‘নিজের টাকায় পদ্মা সেতু হবে না’। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, তদন্তে দুর্নীতির কোন প্রমান মেলেনি। তখন প্রধানমন্ত্রী উপলব্ধি করলেন, বাংলাদেশকে তিনি থামিয়ে রাখবেন না। যে সেতু প্রাণের সেতু,সে সেতুর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য জড়িত, যে সেতুকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল টাকা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে, সে সেতু তিনি বাস্তবায়ন করবেনই। তাই তিনি সাহসিকতার সাথে, আর্থিক বাধা, ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জ, মহামারি, ষড়যন্ত্র-নানা রকমের প্রতিক‚লতার বিরুদ্ধে এই সেতু নির্মানের কাজ শুরু করেন। ১৯৯৮ সালে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। নির্মাণ শেষ হলো ২০২২ সালে এসে। সেতুটি নির্মানে ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
এই সেতুর সফলতা সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি কথা বার বার মনে পড়ছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষনে বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’। তাছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু যখন দেশ শাসনের দায়িত্ব নেন অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী হন তখন বিদেশী সাংবাদিক জাতির পিতাকে বলেছিলেন, ‘আপনার তো কোন সম্পদ নেই, কীভাবে এই দেশ গড়বেন?’ বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন, ‘আমার মাটি আছে, আমার মানুষ আছে, তা দিয়েই আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলবো’।
বঙ্গবন্ধুর সে কথা যেন বৃথা যায় নি কারন বাস্তবে পদ্মার দুই পাড়ের মানুষেরা বলছেন, আমরা ভিটে মাটি দিয়েছি পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য; কিন্তু তাঁরা গৌরবের সঙ্গে বলছেন, আমাদের ভিটেমাটিতে তো পদ্মা সেতু হয়েছে। পক্ষান্তরে কেঊ জমি দিয়ে, কারো মেধায়, কেউ শ্রমিক হিসেবে শ্রম দিয়ে প্রায় সাড়ে সাত বছরের চেষ্টায় পদ্মা সেতুর দুই পাড়ের সেতু বন্ধ তৈরি করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় পদক্ষেপ, পরিকল্পনা এবং অবশেষে এদেশের মানুষের সহযোগিতায় তাঁর সরকার এই স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন। রাজনৈতিক কারনে যারা এই পদ্মা সেতুর বিরোধীতা করেছিলেন,অভিশাপ দিয়েছিলেন,বাস্তবে সেই বিরোধীতা যেন সুফল বয়ে এনেছে আর অভিশাপ যেন আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে, পর্যটনে, যাত্রী পরিবহনে এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ইতোমধ্যেই শত কোটি টাকার উপর টোল আদায় হয়েছে। আশা করা যায়,আগামী তিন দশকের মধ্যেই টোল আদায়ের মাধ্যমে সেতু ব্যয়ের টাকা ফেরত পাবে দেশ।
লেখক: প্রাবন্ধিক