পথ চলার স্বাধীনতা ও দৃষ্টিহীনের অধিকার

213

আমার নাই চোখের আলো। নেই আমাদের দৃষ্টিশক্তি। এ বর্ণিল পৃথিবীর সৌন্দর্য্য দেখার সাধ্য কী আমাদের আছে! এ কাদের কথা বলছি? নিশ্চই যারা দৃষ্টিহীন বা চোখে দেখেনা। পূর্ণ শারিরীক সক্ষমতা নিয়ে এ জগতে তাদের আগমন ঘটেনি। অনেক ক্ষেত্রে জন্মলগ্নে তারা হারিয়েছে চোখের আলো। আবার জন্ম পরবর্তী অনাকাঙ্খিত কারণে অনেকেই হারিয়েছে দৃষ্টিশক্তি। সমাজে দৃষ্টিহীন যারা। তারা সক্ষম মানুষগুলোর সহয়তা চায় মানুষের দাবী নিয়ে। তারাও চায় স্বাধীনভাবে পথ চলতে। বেঁচে থাকতে চায় মানুষের মর্যাদা নিয়ে। এ সহায়তার মাঝেই আছে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধি করার এক অনন্য প্রয়াস।
আজ ১৫ অক্টোবর, বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস। দৃষ্টিহীন মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। দৃষ্টিহীন মানুষের একান্ত আবেদন সক্ষম মানুষের নিকট। জীবন চলতে সহায়তার। দৃষ্টিহীন মানুষের আদায়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯২১ সালে। ইংল্যান্ডোর ব্রিষ্টল শহরে জেমস গিবস নামের একজন ফটোগ্রাফার দুর্ঘটনায় তার দৃষ্টি শক্তি হারান।


স্বাধীন পথ চলার প্রতীক হিসেবে তিনি ব্যবহার করেন সাদা রঙ্গে রঞ্জিত লাঠি। পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন দৃষ্টিহীন ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মার্কিন কংগ্রেসে সর্ব প্রথম ১৫ অক্টোবরকে ‘বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস’ পালনের বিল অনুমোদন করেন। এ ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত হয় ‘ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঋবফবৎধঃরড়হ ড়ভ ইষরহফ (ওঋই)’ সম্মেলন। উক্ত সম্মেলনে ৬৯টি দেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও কর্মরত সংগঠনের সদস্যবর্গের উপস্থিতিতে প্রতি বছর ১৫ অক্টোরকে বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যা ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্ব সম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। ১৯৯৬ সাল হইতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রতিবছর রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ঃ ‘সাদাছড়ি ব্যবহার করি, নিশ্চিন্তে পথ চলি’।
সাদাছড়ি নিরাপত্তা এর শাব্দিক বিশ্লেষণ হলো ‘সাদাছড়ি’ ও ‘নিরাপত্তা’। ‘সাদাছড়ি’ অর্থ হলো দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতীক। স্বাধীন পথ চলার মাধ্যম। ‘সাদাছড়ি’ সমাজের সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করে, তাদেরকে সহায়তার। দৃষ্টিহীন ব্যক্তিগণ এ সাদাছড়িকে নিজের ‘চোখ’ বলে মনে করে থাকে। এ এক পরোক্ষ দৃষ্টিশক্তি। ‘সাদাছড়ি’ দৃষ্টিহীনকে নিয়ে এগিয়ে যায় আপন গন্তব্যে। ‘নিরাপত্তা’ বলতে বুঝায় দৃষ্টিহীন ব্যক্তির সকল প্রকার অধিকার নিরাপত্তা। অর্থ্যৎ দৃষ্টিহীনের শিক্ষার অধিকার, চিকিৎসার অধিকার, সম্পত্তির উত্তারাধিকার, মত প্রকাশ সহ সকল প্রকার মৌল-মানবিক অধিকারের নিশ্চয়তা। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সহ সকল প্রতিবন্ধী রাষ্ট্রের নাগরিক এবং সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর প্রতি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক নয়। দৃষ্টিহীনতার জন্য কোন ব্যক্তিস্বত্ত¡া দায়ী নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় পরিবার হতে শুরু হয় তার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন। আধুনিক সভ্য সমাজের অনেকে এখনো দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের ‘অন্ধ’ বা ‘কানা’ ইত্যাদি নামে ডাকতে শুনা যায়। যা তাদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টি ভঙ্গির বহিঃ প্রকাশ। সভ্যতার শুরু থেকেই সকল মানব সমাজে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর অস্তিত্ব ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত তাদের প্রতি সমাজ নানা ধরনের কু-ধারনা পোষণ করত। প্রাচীন গ্রীসে দৃষ্টিহীনদের বেঁচে থাকার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। গ্রীক সভ্যতার স্পার্টাতে দৃষ্টিহীনদের নির্মমভাবে হত্যা করা হত। এথেন্সে দৃষ্টিহীন শিশুকে মাটির পাত্রে ভরে রাস্তার ধারে ফেলে রাখা হতো। ল্যাসিডামোনিয়াতে দৃষ্টিহীন ও বিকলাঙ্গদের গভীর খাতে ছুড়ে দিয়ে হত্যা করা হতো। অন্যদিকে ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মে অন্ধত্বকে দেবতার অভিশাপ বা পূবজন্মের কৃতকর্মের ফল বলে বিবেচনা করা হয়েছে।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ার বিষয়টি নিজের ইচ্ছাকৃত? কোন ব্যক্তির কর্মফল কী? না, এ হচ্ছে মানবের জন্মগত, অপচিকিৎসাজনিত বা কোন দূর্ঘটনার ফল। আমাদের দেশে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরতার অন্যতম কারণ হল গর্ভকালীন পরিচর্যা, চিকিৎসা সেবা ও পর্যাপ্ত ভিটামিনের অভাব। তাছাড়া ছানি প্রতিসারণজনিত সমস্যা, গøুকোমা, ভিটামিন এ’র অভাব, ট্রাকোমা, চোখে আঘাত, সংক্রামক রোগ, পুষ্টিহীনতা, আর্সেনিক বিষক্রিয়া’ প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক দূর্ঘটনা ইত্যাদি। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর জীবনকাল অতি কষ্টের, অতি দুঃখের। জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা অতিমাত্রায় অন্যের উপর নির্ভরশীল। মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ ও সামাজিক সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা বৈষম্যের শিকার হন।
বাংলাদেশ সরকার সমাজকল্যাণ বান্ধব সরকার। আমাদের সংবিধান মানবাধিকারের অনন্য অসাধারণ দলিল। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ঘ) এ উল্লেখ্য ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্ব জনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃপিতৃহীনতা বা বার্ধক্য জনিত কিংবা অনুরূপ পরিস্থিতি জনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাব গ্রস্থতার ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্য লাভের অধিকার’ নাগরিকের আছে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের আরো উল্লেখ ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’ তাছাড়া ৩ মে, ২০০৮ সালে জাতিসংঘের ৬১তম সাধারন সভায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদ অনুমোদিত হয়। বাংলাদেশ সরকার উক্ত সনদের স্বাক্ষর ও অনুসমর্থন করেছে। এ প্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয় প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। যেমন: অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি, প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কার্যক্রম ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির শিক্ষা কার্যক্রমসহ ব্যাপক কর্মসূচি।
দৃষ্টিহীন শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক ৪ বিভাগে স্থাপিত হয় চযুংরপধষষু ঐধহফরপধঢ়ঢ়বফ ঞৎধরহরহম ঈবহঃবৎ। উক্ত চঐঞ সেন্টারে ব্রেইল পদ্ধতিতে দৃষ্টিহীন শিশু ও শিক্ষা গ্রহণ করে আসছে। স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭৪ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রবর্তন করেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ‘সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রম’। এই কার্যক্রমের আওতায় বর্তমানে দেশের সকল জেলার ৬৪টি বিদ্যালয়ের মাধ্যমে দৃষ্টিহীন শিশুরা ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করছে।
সামাজিক উন্নয়ন সূচকে দ্রæত এগিয়ে যাচ্ছে এ দেশ। সরকার প্রতিবন্ধী সহ সকল অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে প্রনয়ন করছে উপযোগি আইন ও কর্মসূচী। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কল্যাণে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩’ সরকারে এক অনন্য উদ্যোগ। এ আইনের ১৬নং ধারায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির বাঁচিয়ে থাকা, সমান আইনী স্বীকৃতি, স্বাধীন মত প্রকাশ, শিক্ষার অধিকার সহ ১৬ প্রকার অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। তাছাড়া সরকার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তত্ত¡াবধানে ‘প্রতিবন্ধীতা শনাক্তকরন জরীপ কর্মসূচীর ২০১৩’ বাস্তবায়ন করেছে। প্রতিবন্ধীতা শনাক্তকরন কর্মসূচির আওতায় চালুকৃত বিনংরঃব (.মড়া.নফ) এর মাধ্যমে দেশের সকল প্রকার প্রতিবন্ধীর তথ্য হালনাগাদ করা হচ্ছে। যাতে সকল প্রকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে উপযোগী সেবা নিশ্চিত করা যায়। এ ডাটা ব্যাংকের তথ্য মতে সমগ্র দেশে শনাক্তকৃত মোট দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর সংখ্যা ২,৩৩,০৫৪ জন।
বর্তমান বিশ^ সভ্যতা বহুমুখী সংকটে। বিশ^ সমাজে দৃষ্টিহীনের সমস্যার পাশাপাশি, দৃষ্টিমান মানুষের সমস্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে বহুগুণে। দৃষ্টিক্ষমতা ¯্রষ্টার মহাশক্তির এক অনন্য নিদর্শন। কিন্তু তারা বুঝে না, যাদের সবকিছু দেখার ক্ষমতা আছে। তারা অপব্যবহার করছে এ দৃষ্টিশক্তির। এ দৃষ্টিমান ব্যক্তিরাই খুন করছে, নির্যাতন করছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করছে, মানুষের প্রতি জুলুম করছে, ধর্ষণ করছে নারী-শিশুদের। সমাজ ব্যবস্থায় দেখা যাচ্ছে চরম অস্থিরতা। দৃষ্টিহীন অসহায় মানুষগুলো অসহায়ত্ব বেড়ে যাচ্ছে। তারা খুঁজে পাচ্ছে না আস্থার জায়গা। তারাও ধিক্কার দিচ্ছে এ সভ্য সমাজকে।
দৃষ্টিহীন নাগরিক রাষ্ট্রের অতি ক্ষুদ্র অংশ। কিন্তু সমাজের বিচ্ছিন্ন অংশ নয়। তারা আমাদের অতি আপনজন। সমাজের দৃষ্টিহীন অসহায় মানুষদের সহায়তার মাঝে বিরাজ করে মানব শ্রেষ্ঠত্ব। সৃষ্টার কোন সৃষ্টিই উদ্দেশ্যহীন নয়, বরং স্রষ্টাকে উপলব্ধির অনন্য মাধ্যম। জগতের দুর্দশাগ্রস্ত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নিকট উদাহরণ স্বরূপ। দৃষ্টিহীন বা মানবিক সাহায্যার্থী যারা, তাদের স্বাধীন পথ চলায় বাড়াতে হবে সহায়তার হাত। তবেই মানব শ্রেষ্ঠত্ব। বৈষম্য নয়। জয় হোক দৃষ্টিহীনের অধিকার।

লেখক: সহকারী পরিচালক, সমাজসেবা অধিদফতর বিভাগীয় কার্যালয়, চট্টগ্রাম