নেতাদের ‘ইগো’ রক্ষার বিরোধ বিস্তৃত হচ্ছে

35

রাহুল দাশ নয়ন

দিনদিন বিস্তৃত হচ্ছে নগর আওয়ামী লীগের বিরোধ। প্রায় প্রতিটি ইস্যুতেই নেতারা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। কেন্দ্রীয় ও নগর আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়েও নেতারা কর্তৃত্ব ধরে রাখার মিশনে নেমেছেন। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। নগর আওয়ামী লীগের দুটি পক্ষ একে অপরকে কোণঠাসা করতে নানা কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছেন। সর্বশেষ কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মোতাবেক সাংগঠনিক টিমকে চিঠি না দেয়ায় নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের বিরুদ্ধে কেন্দ্রে অভিযোগ দেয়া হয়েছে। যদিও গত ৮ এপ্রিল সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত চিঠি পরদিন (৯ এপ্রিল) ১৫ থানার সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা নেতারা হাতে পেয়েছেন। সাংগঠনিক টিমের দায়িত্বে থাকা পাঁচজন নেতা চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এ ব্যাপারে নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইব্রাহীম হোসেন চৌধুরী বাবুল পূর্বদেশকে বলেন, ‘যে চিঠিগুলো এখন দিচ্ছে সেগুলো আরো আগে দিতে পারতো। আমরা ২২ মার্চ কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর ২৩ মার্চ সাংগঠনিক টিম চ‚ড়ান্ত করি। চারজনের স্বাক্ষরে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরপরেও চিঠি না দেয়ায় আমি সাধারণ সম্পাদককে (আ জ ম নাছির উদ্দীন) ফোন করেছিলাম। উনি চিঠি দিবে বলেও দেয়নি। যে কারণে কেন্দ্রের কাছে আমরা জবাবদিহিতার মুখে পড়বো বলে লিখিতভাবে জানিয়েছি। আমাদের মধ্যে সাংগঠনিক প্রক্রিয়াগত মতের পার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু নীতিগত ও আদর্শিক দিক থেকে এক জায়গায় আছি। এখানে ‘ইগো’ থাকা উচিত নয়। নগর আওয়ামী লীগের যারাই সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হবেন তাদের সাথেই সাংগঠনিকভাবে কাজ করতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
মহানগর আওয়ামী লীগে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দীন বলয়ের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিনের। মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর সংগঠনের কর্তৃত্ব নেন আ জ ম নাছির। এরমধ্যে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে শিক্ষা উপ-মন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে ঘিরে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়। নাছির ও নওফেল প্রকাশ্যে বিরোধে না জড়ালেও পরোক্ষভাবে নগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা এই দুই নেতার সঙ্গী হওয়ায় রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াচ্ছেন। দুই পক্ষের নেতারা একে অপরকে পিছিয়ে রাখতে সবধরনের পদক্ষেপই নিচ্ছেন। ‘ইগো’ সমস্যা থেকেই নেতারা এমন কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নগর আওয়ামী লীগের সম্পাদক মÐলীর দুই নেতা বলেন, দলীয় সভায় যে আলোচনা হয় সেটি মিটিং শেষে নড়ে যায়। পুরো সংগঠনের দায়িত্ব সাধারণ সম্পাদকের হাতে থাকলেও তিনি একপ্রকার ‘ইগো’ সমস্যায় ভুগছেন। নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয় আরেকটি পক্ষ সেগুলোতে সমস্যার সৃষ্টি করে। প্রতিটি পদক্ষেপেই পিছুটান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এগুলো করতে গিয়ে সুশৃঙ্খল সংগঠনে নেতাদের মধ্যে বিরোধ বাড়ছে। এসবের মূলে রয়েছে আগামী সম্মেলন। আগামী সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদটি ভাগিয়ে নিতেই বর্তমান সাধারণ সম্পাদককে বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে। তাছাড়াও ইউনিট সম্মেলনে তথ্য সংগ্রহ ফরম না দিয়ে দলীয় সদস্য সংগ্রহের ভিত্তিতে কাউন্সিলর নির্ধারণ করলে এই জটিলতাগুলো বাড়তো না।
এ বিষয়ে জানতে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। পরে এসএমএস দিলেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে আ জ ম নাছির উদ্দিনের ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও চকবাজারের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা নোমান আল মাহমুদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘২৩ মার্চ সাংগঠনিক টিম পূর্ণাঙ্গ করার পর সবকিছু গুছিয়ে নিতে ১০-১৫ দিন হয়তো চিঠি দিতে সময় লেগেছে। অভিযোগ না দিয়ে নিজেরা আলোচনা করে চিঠি পাঠালে হয়ে যেতো। সাংগঠনিক নিয়ম অনুযায়ী চারজনে সিদ্ধান্ত নিতে পারে চিঠি দিবেন অবশ্যই সাধারণ সম্পাদক। এটা নিয়ে যারা অভিযোগ তুলেছেন তাদের সাধারণ জ্ঞানের অভাব আছে। আমি ৮ তারিখ সই করা চিঠি পরদিন পেয়েছি।’
ইউনিট সম্মেলন শুরুর পর থেকেই নগর আওয়ামী লীগের বিরোধ বাড়তে থাকে। ওয়ার্ড সম্মেলনের উদ্যোগ নেয়া হলে কেন্দ্রে অভিযোগ দেয় নগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। পরে এ সম্মেলন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয় কেন্দ্র। পরবর্তীতে কেন্দ্র থেকে ছয় সদস্যের রিভিউ কমিটি গঠন করা হয়। রিভিউ কমিটিও কয়েকদফা বৈঠক করে ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি। এ কমিটি ১৫টি সাংগঠনিক টিম গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেও সেসব টিমে আহবায়ক কে থাকবে এ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল কর্মকান্ড। যে কারণে গত ২২ মার্চ চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক টিম চট্টগ্রামে এসে নির্দেশনা দেন। এতে নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, সহ-সভাপতি এড. ইব্রাহীম হোসেন চৌধুরী বাবুল, যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরীকে ১৫টি সাংগঠনিক টিম চ‚ড়ান্ত করতে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। কেন্দ্রের নির্দেশনা মতে চার সমন্বয়ক ২৩ মার্চ মাহতাব উদ্দিনের বাসায় বৈঠক করেন সাংগঠনিক টিম পূর্ণাঙ্গ করেন। গঠিত সাংগঠনিক টিমকে চিঠি দিতে গড়িমসি করার কারণেই আবারো নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে একাট্টা হন কয়েকজন নেতা। যদিও গত ৯ এপ্রিল সাংগঠনিক টিমের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
বায়েজিদ থানার দায়িত্বে থাকা সাংগঠনিক টিমের প্রধান ও নগর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ফারুক বলেন, ‘শনিবার আমি চিঠি পেয়েছি। আমি চিঠি গ্রহণ করে রিসিভিং খাতায় ৮নং ক্রমিকে স্বাক্ষর করেছি। আমার আগে জহিরুল আলম দোভাষ, মশিউর রহমান ভাইয়েরা চিঠি নিয়েছেন। নাছির ভাই ৮ এপ্রিল চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। সদস্যরাও চিঠি পাচ্ছেন। এখন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সাথে আলাপ করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’
সদরঘাট থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও নগর আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মশিউর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি চিঠি পেয়েছি। কিন্তু আমার টিমে কে কে আছে সেটা উল্লেখ করা হয়নি চিঠিতে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আপনাকে কনভেনার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ইউনিট কমিটিতে কোন অভিযোগ আছে কিনা সেগুলো দেখে সুপারিশ আকারে দিতে বলেছে। এই চিঠিতে চারজনের স্বাক্ষর থাকার কথা থাকলেও রয়েছে মাত্র সাধারণ সম্পাদকের। সাংগঠনিক কাজ শুরু করতে আমার সাথে কে কে যাবে সেটা জানা গেলে কাজ করতে সুবিধা হতো।’
গত ৮ এপ্রিল নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন স্বাক্ষরিত চিঠিতে সকল সাংগঠনিক টিম সংশ্লিষ্ট থানা এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক/আহবায়ক ও যুগ্ম আহবায়কদের সাথে সমন্বয় করে সাংগঠনিক টিমের দায়িত্বশীল নেতাদের দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে। চিঠিতে দুটি দায়িত্ব উল্লেখ করা হয়। এগুলো হলো- ইতোমধ্যে সম্পন্ন হওয়া ইউনিট কাউন্সিল সমূহে কোন ধরনের অনিয়ম হয়েছে কিনা তা শনাক্ত করে সমাধানের লক্ষ্যে সুপারিশসমূহ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক টিমের নিকট পাঠাতে হবে। নতুন সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কার্যক্রম তদারকি করা, প্রয়োজনীয় ফর্ম সংগ্রহ, বিতরণ এবং অসম্পন্ন ইউনিট, ওয়ার্ড, থানা কাউন্সিলর সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করতেও চিঠিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।