‘নিজেদের সংখ্যালঘু ভাববেন না’

35

এই দেশে জন্মগ্রহণ করে কেন নিজেদের সংখ্যালঘু বলবেন, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সেই প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জন্মাষ্টমী উপলক্ষে গতকাল বুধবার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে তিনি হিন্দুদের সংখ্যালঘু না ভাবার আহ্বান জানান।
গণভবনের মাঠে এ শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে শ্রী শ্রী জন্মাষ্টমী উদ্যাপন পরিষদ বাংলাদেশ, মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি এবং হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট্রের নেতারা ছাড়াও সারাদেশ থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রতিনিধিরা যোগ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে আমার একটা অনুরোধ থাকবে। আপনারা জানি না কেন বারবার নিজেদেরকে সংখ্যালঘু সংখ্যালঘু বলেন। আপনারা কি এই রাষ্ট্রের নাগরিক না? আপনারা কি এই দেশের মানুষ না? এটা আপনার জন্মভূমি না? এটা আপনাদের জন্মভূমি। তাহলে আপনারা নিজেদেরকে ছোট করে এইভাবে সংখ্যালঘুভাবে দেখবেন কেন? এখানে সকলের সমান অধিকার রয়েছে। আমি সব সময় এটা শুনি, আমার কাছে খারাপ লাগে আপনারা নিজেদের কেন এভাবে খাটো করে দেখবেন। বাংলাদেশ আমাদের সকলের’।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা বলি এই দেশ সকলের। আমি আপনাদের সকলকে বলবো নিজেদের ওই সংখ্যালঘু সংখ্যালঘু না বলে- এই মাটি আপনাদের, এই দেশ আপনাদের। এই জন্ম ভূমি আপনাদের। কেন নিজেদের মধ্যে এই বিশ্বাস থাকবে না? অন্তত আওয়ামী লীগ সরকার যতদিন ক্ষমতায় আছে, কখনও আমরা ওই রকম ব্যবধান করে আমরা দেখি না’।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘যখন মহান মুক্তিযুদ্ধে সকলে অংশগ্রহণ করেছে, যখন বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে, এক ভাইয়ের রক্ত আরেক ভাইয়ের রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। সেই রক্তকে ভাগ করতে যাইনি, ভাগ হতে পারে না। এই বাংলার মাটিতে যেহেতু আমরা সকলে এক হয়ে বুকের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, কাজেই এখানে সকল ধর্মের সমান অধিকার থাকবে’।
তিনি বলেন, ‘আমাদের শরণার্থীরা যখন ভারতে আশ্রয় নিল তখন তো তারা দেখেনি কে হিন্দু আর কে মুসলমান। সকলের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করেছে। আমরা সব সময় বিশ্বাস করি, যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। ইসলাম ধর্মও সে শিক্ষা দেয়। আমরা মনে করি সব ধর্মেই এ কথা বলা আছে। প্রত্যেকটা ধর্মই শান্তির বাণী শুনিয়েছে’।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রণয়নের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা যে সংবিধান আমাদের দিয়েছিলেন, সেই সংবিধানে কিন্তু সেই কথাই বলে হয়েছিল’। সংবিধানের চার মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। যার যার ধর্ম সে স্বাধীনভাবে পালন করবে’। খবর বিডিনিউজের
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘যে কারণে বাংলাদেশের একটা ধর্মীয় (উৎসবে) সকলে এক হয়ে কাজ করতে পারে। আজকে আমরা যে ¯েøাগান দিচ্ছি- ধর্ম যার যার উৎসব সবার, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। আজকে কিন্তু সেটা আমরা প্রমাণ করেছি যে প্রতিটি অনুষ্ঠান আমরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই কিন্তু উদ্যাপন করছি। সেটা আমরা করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের সবসময় ওইটাই লক্ষ্য থাকবে যে আমাদের প্রত্যেকটা ধর্ম, আমাদের ঈদ বলেন, আপনাদের পূজা বলেন বা বৌদ্ধ পূর্ণিমা বলেন অথবা বড়দিন আমি বলবো পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশেই মনে হয় এতো সুন্দর, এতো আন্তরিক পরিবেশে প্রত্যেকটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান আমরা মিলেমিশে উদ্যাপন করি। এখানে কিন্তু আর কোনো দ্বিধাদ›দ্ব থাকে না, সবাই মিলেই সবার অনুষ্ঠানে যাই’।
বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই নববর্ষটা সকলে মিলেই উৎসব আয়োজন করি, উৎসব পালন করি। আমাদের দেশে কিছু কিছু … লোক থাকে, অনেকে জ্ঞান পাপী আছে। কিছু কিছু বলে যে পহেলা বৈশাখ এটা নাকি হিন্দুয়ানী। সম্রাট আকবর এই পহেলা বৈশাখ, হালখাতা খোলা এবং উৎসবটা আয়োজন করেছিল। তাহলে এখন সেটাকে অন্য ধর্মের বলে ঠেলে দিলে হবে কি করে?
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের উপর নিপীড়নের বিষয়টিও তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘অবশ্য বিএনপি-জামায়াতের চরিত্রটাই এ রকম। আপনারা জানেন তারা কিভাবে অত্যাচার করে। বিভিন্ন ঘটনার পর… বিভিন্ন মন্দির ভাঙা হয়েছে, কিভাবে অত্যাচার করা হয়েছে। নানাভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর চরম অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে। তখন আমরা ছুটে গিয়েছি সকলের কাছে। ঢাকেশ্বরী মন্দির পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়েছিল। এমনকি বৌদ্ধ ধর্ম, খিস্ট ধর্ম তারাও রেহাই পায়নি’।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপির কাজই ছিল এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালানো। আমরা তো আক্রমণের শিকার মুসলমানরা তো আছি। এভাবে সবসময় একটা বিভেদ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা তারা নিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ কখনও এতে বিশ্বাস করে না’।
তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন উন্নয়নের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা। এসময় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্য নানা ধরনের সুবিধা সৃষ্টির কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমি যেমন মসজিদভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের একটা ব্যবস্থা নিলাম। সেই সাথে সাথে কিন্তু আমরা মন্দিরেও সেই ব্যবস্থা নিয়েছি এবং আপনারা জানেন যেন প্রতিটি উপজেলায় হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট্রের আওতায় মন্দিরভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম আমরা চালু করে দিয়েছি। সারাদেশে ৬৪৫০টা মন্দিরে মন্দিরভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিবছর ১ লাখ ৯১ হাজার ২৫০ জনকে প্রাক-প্রাথমিক, বয়স্ক ও ধর্মীয় গ্রন্থ বিষয়ক শিক্ষা প্রদাণ করা হচ্ছে। আমরা যেমন ইমামদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি, সেই সাথে সাথে সারাদেশে পুরোহিত, সেবাহিতদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট্র করে দিয়েছি। একইসঙ্গে খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট আইনও করে দেওয়া হয়েছে’।
কল্যাণ ট্রাস্টে সরকার সিড মানি দিয়েছে উল্লেখ করে এর পাশাপাশি অর্থ-বিত্তদেরও অর্থ দেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।