নদ-নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা-এর মানে কী?

64

ঢাকার উপকণ্ঠেই তুরাগ নদ, যেটি এখন দূষণ আর দখলে বিপর্যস্ত হয়ে অনেকটাই মৃত্যুর কাছে। নদটিকে দখল ও দূষণ থেকে বাঁচানোর উদ্যোগের অংশ হিসেবে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিলো পরিবেশবাদী একটি সংগঠন।
এ প্রেক্ষিতে দেয়া আদেশে হাইকোর্ট তুরাগ নদকে ‘জীবন্ত সত্তা (লিভিং এনটিটি)’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরশেদ।
আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলছেন, আদালতের ঘোষণা অনুযায়ী তুরাগসহ নদ-নদীগুলো এখন থেকে মানুষ বা প্রাণী যেমন কিছু আইনি অধিকার পায় তেমনি অধিকার পাবে। নদীর কিছু আইনি অধিকার তৈরি হবে এ রায়ের ফলে। ফলে নদী নিজেই তার ক্ষতির বা দখলের বিষয়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবে। তবে নদী তো আর নিজে যেতে পারবে না। সেক্ষেত্রে কেউ তার প্রতিনিধি হয়ে ক্ষয়ক্ষতিগুলো আদালতকে জানালে তার প্রতিকার পাবে।
তিনি বলেন, আদালতের রায়ে আমাদের দেশের নদীগুলোকেও জীবন্ত সত্তা, জুরিসটিক পারসন বা লিগ্যাল পারসন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং মূলত এর মাধ্যমে মানুষের মত নদীর মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হল।
নদী বিষয়ক গবেষক মোহাম্মদ এজাজ বলেছেন, নদী রক্ষার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। তিনি ঢাকা অঞ্চলের প্রায় দেড়শ নদ-নদী নিয়ে গবেষণা করছেন।
তিনি বলেন, মানুষের যে বেঁচে থাকার অধিকার নদীর ক্ষেত্রে কি সেটি হবে নাকি নদী কোনো বাধা ছাড়াই প্রবাহিত হবে-এখনো তা পরিষ্কার নয়। তবে এটা ইতিবাচক যে নদীর একটি আইনি ভিত্তি তৈরি হলো যার ওপর ভিত্তি করে কথা বলা যাবে। আগে নদীর কোনা বৈধ অধিকারই ছিলো না। নদী হিসেবে তার বাঁচার অধিকার না থাকায় যেভাবে খুশীকে নদীকে হত্যা করা হচ্ছে। এখন এ রায়টি আসার অর্থ হলো এটি নদীর জন্য খুবই ভালো একটি বিষয়।
মোহাম্মদ এজাজ বলছেন, বিশ্বের অন্য যেসব দেশে নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে আদালত সেখানে নদীর অভিভাবক নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটি হয়নি।
যদিও আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলছেন, এখন যে কেউ নদীর ক্ষতির বিষয়টি আইনজীবীর মাধ্যমে বা আইনজীবীরা নিজে থেকেও নদীর ক্ষতি, দখল বা বাধার বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন করবেন নদীর অধিকারের আইনি অধিকারের ভিত্তিতে।
পরিবেশ আন্দোলন বাপা’র ইকবাল হাবিব বলেছেন, অনেক রকম আদালতের রায় দিয়ে নদীর দখল, দূষণ, পাড়গুলো দখল কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছিলো না। তো কিছু কিছু দেশে নদীকে মানবিক অধিকার বা তাকে একটি প্রাণতুল্য বর্ণনার মধ্য দিয়ে যদি এই মানবিক অধিকারগুলো তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া যায় অর্থাৎ মানুষকে বা একটা প্রাণকে যেভাবে আমরা আইনগত দিক থেকে রক্ষা করি সেই প্রটেকশনের আদলে যদি এর সাথে যুক্ত করা যায় তাহলে এই গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলো রক্ষা করার সুদৃঢ় বন্ধন পাওয়া যায়। এই রায়ের মূল উদ্দেশ্য সেই ধারণা থেকে।
গবেষক মোহাম্মদ এজাজ বলছেন, বিশ্বব্যাপী এ ধারণার সূচনা হয়েছে কলম্বিয়া থেকে ২০১৭ সালে। দেশটির সাংবিধানিক আদালত ‘রিয়ো এট্রাটো’ নামক একটি নদীকে এ অধিকার দেয়। নদীটি সোনা আর কয়লার খনির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াতে সেখানকার আদিবাসী সম্প্রদায় ও অন্যদের জন্য ব্যাপক সমস্যা হচ্ছিলো। এ পরিস্থিতি থেকে নদীটিকে রক্ষার জন্যই আদালত একে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করে এর বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।
নিউজিল্যান্ডের একটি নদীকে সেখানকার মানুষ খুবই পবিত্র মনে করতো ও একে ঘিরে নানা উপাসনাও করতো। সেটিকেও জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হয়েছে। আবার পার্শ্ববর্তী ভারতের উত্তরপ্রদেশে গঙ্গা ও যমুনাকে রাজ্য থেকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করলেও পরে তা উচ্চ আদালতে স্থগিত হয়। আবার মধ্যপ্রদেশের রাজ্য আদালত থেকে নর্মদা নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা দেয়া হয়েছে কারণ নদীটি খাওয়ার পানির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মোহাম্মদ এজাজ বলছেন, বাংলাদেশের মূলত নদ নদী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দখল ও দূষণের কারণে। আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলছেন, তুরাগ নদী নিয়ে বিচারিক তদন্তে প্রায় ৩৬টি অবৈধ দখলের চিত্র বিভিন্ন প্রতিবেদনে এসেছে। সেসবের ওপর ভিত্তি করেই হাই কোর্টে এ রিটের শুনানির সূচনা হয়েছিলো।
মনজিল মোরশেদ ও মোহাম্মদ এজাজ দুজনই বলছেন, তুরাগকে কেন্দ্র করে রায়টি আসলে আদালত একে সব নদ নদীর জন্যই প্রযোজ্য ঘোষণা দিয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে, ‘অবৈধ দখলদারদের দ্বারা প্রতিনিয়তই কম-বেশি নদী দখল হচ্ছে। অবৈধ স্থাপনা তৈরি করায় সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে নদী। এসব বিষয় বিবেচনা করে তুরাগ নদীকে লিগ্যাল/জুরিসটিক পারসন হিসেবে ঘোষণা করা হল’।
একই সঙ্গে আদালত বলেছে, ‘অবৈধভাবে নদী দখল করে স্থাপনা হচ্ছে আবার হাইকোর্টের নির্দেশে সেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করছে প্রশাসন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কদিন পর সেখানে আবারো অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। এ যেনো কানামাছি খেলা’।
তবে এ রায়ের অবশিষ্ট অংশ আজ ঘোষণার কথা থাকলেও রবিবার এ বিষয়ে একটি গাইডলাইন দেয়া হবে বলে জানিয়েছে আদালত।
বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে দেশের মোট নদ-নদী প্রায় সাতশ, যার মোট আয়তন ২৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি। যদিও প্রচলিত আছে যে দেশের মোট নদী ২৩০টি যার মধ্যে ৫৭টি আন্তর্জাতিক। এর মধ্যে ৫৪টি ভারতের ও তিনটি মিয়ানমারে উৎপত্তি।