নগরীর অপরাধজগতে মেরুকরণের আভাস

37

সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের কাউন্সিলর পদে প্রার্থিতাকে কেন্দ্র করে মতবিরোধের মত নির্বাচন পরবর্তী সময়েও অপরাধজগতে মেরুকরণের আভাস মিলেছে। পুলিশের তালিকায় কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদার কিংবা অপরাধীচক্রের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত কয়েকজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ায় এখন তাদের প্রশ্রয়ে কিংবা বলয়ে থাকাই উঠতি বয়সীদের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে উঠেছে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সুবিধাজনক অবস্থান ও নিরাপদ ভবিষ্যতের হিসেব-নিকেশ করছে উঠতি বয়সী অপরাধীরা।
নির্বাচন পরবর্তী মেরুকরণ ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এরই মধ্যে নগরীর অপেক্ষাকৃত অপরাধপ্রবণ পাহাড়তলী ও লালখানবাজার এলাকায় একাধিক সংঘর্ষের ঘটনার পর সর্বশেষ গত ২৪ ফেব্রæয়ারি সরকারি কমার্স কলেজে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বলয় থেকে ছিটকে পড়া দু’পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে। তবে কলেজ ছাত্রলীগের নেতা ও পুলিশের পক্ষ থেকে ঘটনাটিকে জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠদের মধ্যে ‘সামান্য ভুল বোঝাবুঝি’ বলে দাবি করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওইদিন দুপুরের পর কলেজ ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় দুই পক্ষের মধ্যে এই হাতাহাতি ও মারধরের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় কয়েকজন আহত হয়েছে। তবে খবর পেয়ে দ্রুত সদরঘাট থানা পুলিশের একটি দল কলেজ এলাকায় গিয়ে অবস্থান নিলে ঘটনা বেশি দূর গড়ায় নি। প্রসঙ্গত, কমার্স কলেজ ক্যাম্পাস সিটি কর্পোরেশনের পাঠানটুলী ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে গত ১৪ জানুয়ারি এই ওয়ার্ডের মগপুকুর পাড় এলাকাতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে আজগর আলী বাবুল নামে স্থানীয় এক মহল্লা সর্দার নিহত হয়েছিলেন। তিনি একসময় ওই ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আব্দুল কাদেরের অনুসারী ছিলেন। তবে নিহত বাবুল নির্বাচনের আগে কাদেরের পক্ষ ত্যাগ করে বর্তমান কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম বাহাদুরের সাথে প্রচারণা চালান।
অপরাধজগতের সাথে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিগত ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে মহানগর পুলিশ কিশোর অপরাধী চক্রের (কিশোর গ্যাং) ৪৮ জন পৃষ্ঠপোষক বা নেতার তালিকা করে। তাদের কয়েকজন গেল সিটি নির্বাচনে বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেছেন। কেউ আবার নির্বাচনের আগে কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে এলাকায় ফিরেছেন। তারা সকলেই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। মাসখানেক আগে সমাপ্ত সিটি নির্বাচনে তাদের কয়েকজন ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন পেলেও কেউ কেউ ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হয়েও জয়লাভ করেছেন। নির্বাচনের পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নির্বাচিত কাউন্সিলরের বলয়ে ভিড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছে এলাকাভিত্তিক উঠতি বয়সী অপরাধীরা। অবশ্য নবনির্বাচিত সেসব জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যেকেই এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের ‘গডফাদার’ হিসেবে পুলিশের করা তালিকায় নিজেদের নাম থাকাকে ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’ ও ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ বলেই মন্তব্য করেছেন।
সনাক-টিআইবি মহানগর শাখার সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, সমাজ-রাষ্ট্র বা নির্বাচন-গণতন্ত্র সবকিছু যেভাবে চলছে তা মোটেও আশাব্যঞ্জক ও সুখকর নয়। অন্যায়-অনাচার ও অপরাধের পথ পরিহার করে একটা ন্যূনতম ইতিবাচক পরিবর্তনের পথে আমাদের ফিরতেই হবে। অন্যথায় চলমান অব্যবস্থাপনা দীর্ঘমেয়াদে ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য কোনভাবেই সুফল বয়ে আনবে না।
র‌্যাব-পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের আগে র‌্যাবের হাতে অস্ত্রসহ চকবাজার এলাকায় গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ নামধারী এক নেতা কারাগারে অন্তরীণ থেকেই ওই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে দাঁড়ান। অস্ত্র মামলায় র‌্যাব তার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিটও দাখিল করেছে। নির্বাচনের কয়েকদিন আগে তিনি জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে এলাকায় ফিরেন। এরপর নিজের গ্রæপে উঠতি বয়সীদের ভেড়ানোর কাজে তিনি তৎপর রয়েছেন বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। একইভাবে যুবলীগের সুনির্দিষ্ট কোনও পদে না থাকলেও নিজেকে ‘যুবলীগের নেতা’ বলে পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ চান্দগাঁওয়ের একজন জনপ্রতিনিধি। নগরীর বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, শমশেরপাড়া, কালুরঘাট ও পাঁচলাইশ এলাকায় ওই জনপ্রতিনিধির প্রশ্রয়ে একাধিক অপরাধীচক্র সক্রিয় থাকার অভিযোগ রয়েছে। জায়গাজমি দখল, নির্মাণাধীন ভবন থেকে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগও রয়েছে তার প্রশ্রয়ে থাকা অপরাধীচক্রের বিরুদ্ধে। বিগত ২০১৯ সালের ৫ এপ্রিল চান্দগাঁও থানার ফরিদের পাড়া এলাকায় চাঁদা দাবি করে না পেয়ে ড্রিল মেশিন দিয়ে আমজাদ হোসেন নামের একজনের পায়ে ছিদ্র করে দেয় ওই জনপ্রতিনিধির অনুসারীরা। নগরীর লালখান বাজার ও পাহাড়তলী ওয়ার্ডেও দুই জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে পুলিশের খাতায়। তারা সকলে সিটি নির্বাচনে জয়লাভ করার পর উঠতি বয়সী অপরাধীরা তাদের ক্ষমতার বলয়ে প্রশ্রয়লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে খবর মিলছে। এলাকাভিত্তিক কিশোর কিংবা উঠতি বয়সীরা মনে করছে, আগামীতে নিজেকে সুবিধাজনক অবস্থানে রাখার জন্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বলয়ে থাকাটাই তুলনামূলক নিরাপদ হতে পারে। তাই তাদের মধ্যে এখন পক্ষ অদল-বদলের হিড়িক পড়েছে।