ধর্ষণ বাড়ছে সম্মিলিত প্রতিরোধ দরকার

36


প্রতিনিয়ত ধর্ষণ বাড়ছে, বাড়ছে ধর্ষণের পর হত্যা? একই সঙ্গে বাড়ছে নিষ্ঠুরতা? আর এই ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় তেমন আনা যাচ্ছে না বললেই চলে? এর কারণ, অনেকেরই আছে ক্ষমতার যোগ, রাজনৈতিক পরিচিতি। তাই তারা অপ্রতিরোধ্য?
আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে শিশু ধর্ষণের ঘটনা। গত ছয় মাসে ৪৯৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। সর্বনিম্ন আড়াই বছরের শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৭ থেকে ১২ বছরের শিশুরাই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বেশি। চলতি জুলাই মাসেই কেবল গত ৭ দিনে ৪১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যার মধ্যে ৬ শিশুকে গণধর্ষণ, ৫ প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণ এবং তিনজন শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া ১০ শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
ধারাবাহিকভাবে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে থাকায় এবং এসব ঘটনার নৃশংসতায় সবাই অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এসব ঘটনা আমাদের সমাজে শিশুদের অসহায় অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া, দুর্বল চার্জশিট, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা এবং সর্বোপরি সামাজিক মূল্যবোধের ব্যাপকমাত্রায় অবক্ষয়ের কারণেই সমাজে শিশু ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্যমতে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে মোট ৪৯৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে যা ২০১৮ সালের ১২ মাসে ছিল ৫৭১ জন। গত বছরের তুলনায় এ বছরের প্রথম ৬ মাসে দেশে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে ৪১ শতাংশ হারে, যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৯৬ শিশু। যেখানে কি না গত বছরের প্রথম ছয় মাসে এ সংখ্যা ছিল ৩৫১ জন। এপ্রিল এবং মে এ দুই মাসেই শিশু ধর্ষণ হয়েছে ২৪১ টি যা কি না মোট ধর্ষণের অর্ধেকেরও বেশি।
যেভাবেই ধর্ষণ হোক না কেন, তা এক প্রকার যৌন অত্যাচার এবং তা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। বাংলাদেশ দÐবিধির ৩৭৫ ধারা মোতাবেক যদি কোনো ব্যক্তি নিম্নোক্ত পাঁচ প্রকারের যেকোনো অবস্থায় কোনো নারীর সঙ্গে যৌন সহবাস করে, তবে ওই ব্যক্তি ধর্ষণ করেছে বলে গণ্য হবে। প্রথমত তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে; দ্বিতীয়ত তার সম্মতি ব্যতিরেকে; তৃতীয়ত তার সম্মতিক্রমে, যে ক্ষেত্রে তাকে মৃত্যু বা আঘাতের ভয় প্রদর্শন করে তার সম্মতি আদায় করা হয়; চতুর্থত তাঁর সম্মতিক্রমে, যে ক্ষেত্রে লোকটি জানে যে সে তার স্বামী নয় এবং নারীটি এ বিশ্বাসে সম্মতিদান করে যে পুরুষটির সঙ্গে সে আইনানুগভাবে বিবাহিত অথবা সে নিজেকে আইনানুগভাবে বিবাহিত বলে বিশ্বাস করে এবং পঞ্চমত তার সম্মতিক্রমে বা ব্যতিরেকে, যে ক্ষেত্রে সে ১৪ বছরের কম বয়স্ক হয়।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের অপরাধের যেসব শাস্তির বিধান রয়েছে তা হচ্ছে, ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষণকারীর জন্য রয়েছে মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড এবং এর অতিরিক্ত কমপক্ষে এক লাখ টাকা অর্থদন্ড। একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে ধর্ষণকালে বা ধর্ষণের পর যদি তার মৃত্যু ঘটে, তবে ওই দলের সবার জন্যই এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডেরও বিধান রয়েছে। কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানো বা আহত করার চেষ্টা করলে ধর্ষণকারী যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবে।
ধর্ষণের মামলা নিয়ে যেসব নারী আদালতে দাঁড়িয়েছে তাদের অনেকেরই অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। অভিযুক্তের আইনজীবীরা দ্বারা তারা এমন জেরার মুখে পড়েন যা তাদের মর্যাদাকে আরো ভুলুণ্ঠিত করে।
আদালতে প্রশ্ন করা হয়, কেন তাকে রেপ করা হলো? কেন সে ওখানে গিয়েছিল? অন্যদের তো ধর্ষণ করা হয়নি, তাহলে তোমাকে কেন করলো? মানে দোষটা চাপানো হয় নারীর ওপরে। বিচারকের হাতে অনেক ক্ষমতা আছে। তিনি চাইলে এ ব্যাপারগুলো কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
ধর্ষণ প্রতিরোধে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সুধীসমাজসহ সবার একযোগে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন ধর্ষণকে যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করা। মনে রাখা প্রয়োজন, যে সমাজে নারীরা বেশি মাত্রায় ধর্ষণের শিকার হয়, সেই সমাজে নারীরা দেশ-জাতির উন্নয়নে স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে না। অথচ নারীদের পিছিয়ে রেখে বা তাদের ধর্ষণ করে কোনো সমাজের ঠিকমতো উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধিত হতে পারে না। তাই সমাজ, দেশ ও জাতির উন্নয়ন, অগ্রগতি ঘটানোসহ সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে এবং একটি সুখী, সুন্দর ও সাফল্যময় দেশ ও জাতি গঠনে ধর্ষণকে কঠোর হস্তে দমন করা অপরিহার্য, যেন ভবিষ্যতে এ পথে আর কেউ পা বাড়াতে না পারে।
সমাজের অনেক বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, স্কুল-কলেজ -মাদ্রাসা -বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পুলিশ, উকিল, মোক্তার, বিচারক, লেখক, মিডিয়াকর্মী, ইমাম, পুরোহিতদের মাঝেও যখন ধর্ষকের পরিচয় আমরা পাই, তখন তার পরিচয় শুধুমাত্র ধর্ষক! আর এই প্রবণতা কেবল বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীব্যাপী। অস্ট্রেলিয়াতে কিছুদিন আগে চার্চের পোপ শিশু যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন, সম্প্রতি দেখলাম, জাতিসংঘের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (কানাডিয়ান) দুটি শিশুকে যৌন হয়রানির অভিযোগে চাকুরিচ্যুত হয়েছে।
উন্নত দেশের সঙ্গে আমাদের উপমহাদেশের পার্থক্য অন্য দেশে ধর্ষকের বিচার খুব দ্রæত প্রক্রিয়ায় হয় এবং নিশ্চিতভাবেই হয়, আর আমাদের মতো দেশে বিচার প্রক্রিয়া এতোটাই ধীর যে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ক্ষমতা ও অর্থের বিনিময়ে ধর্ষক সমাজে মিশে যায়, আবারও ধর্ষণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে আর নিপীড়িত পরিবারটির জন্য হয়ে উঠে ভয়ংকর হুমকিদাতা!
বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড রাইটস গভর্নেন্স অ্যান্ড চাইল্ড প্রটেকশন ডিরেক্টর আবদুল্লা আল মামুন বলেন, দেশে শিশু ধর্ষণ বাড়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ একইসঙ্গে কাজ করছে। এই কারণগুলো একটি অপরটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ধর্ষণের ঝুঁকি ও ভয়াবহতা বাড়াচ্ছে। এর মধ্যে প্রধানত অশ্লীলতা ও তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নানা প্রকারের যৌনতা প্রবেশ করেছে। একইসঙ্গে মাদক, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, আইনের ধীরগতি ও বৈষম্যমূলক প্রয়োগ এবং নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ধর্ষককে নানাভাবে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য তাঁর।
ধর্ষণ রোধে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষাও জরুরি সাথে ধর্মীয় শিক্ষারও প্রয়োজন।
লেখক- প্রাবন্ধিক