দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির দায় সিন্ডিকেটের

26

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশে ভোজ্যতেল, ডাল, চাল, আটা, চিনি, পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। অন্যদিকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান। বাজার সংশ্লিষ্টসহ সাধারণ মানুষের আশঙ্কা, রমজানকে সামনে রেখে বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। তবে এর আগেই সয়াবিন তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কুক্ষিগত করে রেখে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলার ঘটনায় জড়িত সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। অপরদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা যেনো ফায়দা নিতে না পারে সেজন্য আগামী দু-একদিনের মধ্যে টাস্কফোর্স গঠন করে নিত্যপণ্যের দামে লাগাম টানতে চায় সরকার
গতকাল রোববার হাই কোর্টের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ সংক্রান্ত রিট আবেদনের শুনানিকালে বলেন, সয়াবিন তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য বৃদ্ধির দায় অসাধু সিন্ডিকেটের। যারা দ্রব্যমূল্য কুক্ষিগত করে রেখে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলে, সেই সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। একইসঙ্গে সয়াবিন তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে দায়ের করা রিটের আদেশের জন্য আজ সোমবার দিন ধার্য করেছেন আদালত।
আদালত রিটকারী আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, সামনে রমজান মাস আসছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে পারে অসাধু চক্র। শুধু সয়াবিন তেল নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের কথা রিটে অন্তর্ভুক্ত করুন। এমন আদেশ দিতে হবে যেন দেশের প্রত্যেক নাগরিকের উপকার হয়। টিসিবির নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিতরণে নীতিমালা করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন আদালত।
এর আগে গত ৬ মার্চ সয়াবিন তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মনিটরিং সেল গঠন এবং নীতিমালা তৈরি করতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন এডভোকেট সৈয়দ মহিদুল কবীর। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল প্রতিকার চাকমা।
এদিকে নিত্যপণ্যের ওপর ভ্যাট-শুল্ক কমানো এবং সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে দুই একদিনের মধ্যে টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়া বন্ধে টাস্কফোর্স কাজ করবে জানিয়ে তিনি অস্বাভাবিক দাম নেওয়া বন্ধে প্রয়োজন অনুযায়ী ‘অ্যাকশনে’ যাওয়া ও তদারকি বাড়ানো এবং অবৈধ মজুত বন্ধে ‘হস্তক্ষেপ’ করার কথাও জানান।
গতকাল রোববার সচিবালয়ে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি ও বাজার পর্যালোচনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সুযোগ নিয়ে কোনো অসাধুতা যেন প্রশ্রয় না পায়। এ জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়োজিত করতে। আমরা দু’এক দিনের মধ্যে টাস্কফোর্স গঠন করব, যাতে কেউ সুযোগটা না নিতে পারে। বিভিন্ন জিনিসের সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, কেউ তার চেয়ে বেশি নিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে যাওয়ায় কিছু ব্যবসায়ী সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে সবার সঙ্গে আলাপ করেই দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা কোথাও মজুতদারি করতে দেব না, কোনো সুযোগ নিতে দেব না। সিদ্ধান্ত হয়েছে, যেখানে এই অবৈধ মজুতের চেষ্টা করবে সেখানে আমরা হস্তক্ষেপ করব।
টিপু মুনশি বলেন, সংকট মোকাবিলায় টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি মানুষকে ছয়টি পণ্য দেওয়ার চেষ্টা করছি। এর কমপক্ষে চারটি পণ্য গ্রামাঞ্চলেও পাঠাব, সেটার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঢাকা শহরে ১৫ লাখ লোককে কীভাবে দেওয়া যায়, সেটার যাতে অপব্যবহার না হয় সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
লাইনে দাঁড়িয়েও অনেক মানুষ টিসিবির পণ্য পাচ্ছে না, এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আগে যেখানে দেড়শ ট্রাক ছিল এখন সেখানে সাড়ে ৪০০ ট্রাক নামিয়েছি। রাতারাতি তো বাড়ানো সম্ভব নয়। রোজা সামনে রেখে এক কোটি মানুষকে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। মেশিন চাপলেই যে চলে আসবে, তা তো নয়। আমরা ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের চেষ্টা করছি। আরও আলোচনা হয়েছে প্রয়োজনে আমরা আরও ব্যবস্থা নেব। আমরা পুরোপুরি বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি, যা করণীয় আমরা করব।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ছাড়াও বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক এবং বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা সভায় অংশ নেন।
এছাড়া পবিত্র রমজান উপলক্ষে সাধারণ মানুষের কথা ভেবে দ্রব্যমূল্য হাতের নাগালে রাখতে আরো নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এসব উদ্যোগ হলো, * কারোনা মহামারিকালে সরকার নি¤œ আয়ের মানুষের মাঝে নগদ অর্থ ও খাদ্যসহায়তা বিতরণ করে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার এক কোটি মানুষকে সাশ্রয়ীমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে। * ট্রেডিং কর্পোরেশন বাংলাদেশ বা টিসিবি গত ৬ মার্চ থেকে ঢাকায় এই কার্যক্রম শুরু করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোর মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, তেল, ডাল, চিনি, খেজুর ও ছোলা। এর আগে মাত্র দুটি পণ্য টিসিবির ট্রাকে বিক্রি করা হতো। * বিতরণ বাড়াতে টিসিবির ট্রাকের সংখ্যা ২০০ থেকে ৮০০ তে বৃদ্ধি করার উদ্যোগ ও নেওয়া হয়েছে। * ১৫ মার্চ থেকে ঢাকার বাইরে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে টিসিবির নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রয় শুরু করা হবে। এ লক্ষ্যে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন প্রতিটি ওয়ার্ড কাউন্সিল থেকে তালিকা সংগ্রহ করছে। তালিকার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। * দ্রব্যের দাম ভোক্তাদের কাছে সহনীয় রাখতে ভোজ্যতেল, চিনি ও ছোলার ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে সরকার। * ভোজ্যতেল সয়াবিনের উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ প্রত্যাহার করা হয়েছে।
অপরদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, নিত্যপণ্যের বাজারসহ গোটা দেশকে এখন দুর্বৃত্তদের আস্তানায় পরিণত করেছে বর্তমান সরকার। ক্ষমতাসীন দলের সশস্ত্র ক্যাডাররা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতদের মতো আস্তানা গড়ে তুলেছে। গতকাল রোববার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব।
বিবৃতিতে মির্জা ফখরুল বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইন শৃঙ্খলার অবনতিসহ চারদিকে যে ভয়ানক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটির জন্য দায়ী বর্তমান আওয়ামী সরকার। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে না পেরে সাধারণ মানুষের আহাজারি আর হাহাকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। দুঃশাসনের যাতাকলে পিষ্ঠ জনগণের কথা আড়ালে রাখার জন্যই সরকার নিজেদের ক্যাডারদের দিয়ে দেশব্যাপী সন্ত্রাসের পরিকাঠামো তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, মিথ্যাচার আর অসত্য ভাষণকে অবলম্বন করে ক্ষমতাসীনরা মনে করছে তারা চিরদিন টিকে যাবে। মানুষের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। সারাদেশে এই অবৈধ সরকারকে প্রতিরোধ করার জন্য জনগণ সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। সরকার অত্যন্ত সুকৌশলে নিজের দলের দুর্বৃত্তদের লালন-পালন করে আসছে। আইন, প্রশাসন, বিচার সবকিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণে বলে দুর্বৃত্তরা জনপদের পর জনপদে বিরোধী দলসহ সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে।