দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে ‘চরম ধীরগতি’

51

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীদের জন্য সেবক নিবাস প্রকল্প ও জলাবদ্ধতা নিরসনে বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে চলতি বছরের জুনে। প্রকল্প দুইটি বাস্তবায়ন ব্যয় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ শেষের দিকে হলেও কাজের অগ্রগতি কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। এখনও মূল কাজও শুরু করতে পারেনি সংস্থাটি। চরম ধীরগতিতে এগোচ্ছে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রকল্প দুইটির বাস্তবায়ন কাজ। তবে কাজে ধীরগতির জন্য সেবকদের অন্যত্র সারানো ও খাল খনন প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতাকে দায়ী করা হচ্ছে। জটিলতা কাটিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শেষ করতে লাগতে পারে আরও তিন বছর সময়। আগামী মার্চেই প্রকল্প দুইটির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখবে করপোরেশন। এমনটাই জানিয়েছেন প্রকল্প দুটির পরিচালক।
অন্যদিকে প্রকল্পের মেয়াদ যত বাড়ছে তত জটিলতাও বাড়ছে। বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্পটি অনুমোদন হয়েছিল আরও ৬ বছর আগে। কিন্তু এখনও কাজই শুরু করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। প্রথমবার মেয়াদ বাড়ানোর পর এখন দ্বিতীয়বারের মত মেয়াদ বাড়তে যাচ্ছে প্রকল্পটির। প্রকল্পটির ভূমি অধিগ্রহণ শেষ করতে হলে সরকারের বরাদ্দের সাথে চসিককে দিতে হবে ২শ ৯ কোটি টাকা। যা এই মুহূর্তে সিটি করপোরেশনের পক্ষে সম্ভব না। তাই মন্ত্রণালয়ের কাছে পুরো প্রকল্পটি সরকারি বরাদ্দে করার জন্য সিটি মেয়র তদবির শুরু করছেন বলে জানিয়েছেন প্রকল্পটির পরিচালক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম।
তাছাড়া সেবাক নিবাস প্রকল্পে সেবকরাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাদের অন্যত্র সরিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু তারা নিজেদের এলাকা ছাড়তে কোনোভাবে রাজি নন। তাই পাশেই অস্থায়ী ঘর তৈরি করে তাদের সরিয়ে কাজ শুরু করা হবে। তাদের জন্য রাস্তার উপর অস্থায়ী ঘর তৈরি করা হয়েছে। সেখানে পানি-গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন দেওয়া শেষ হলে তাদের স্থানান্তর করা হবে। তারপরই মূলত প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে। এদিকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ড্রয়িং ডিজাইন শেষ করেছে এবং দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ফলে মেয়াদের নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন বলতে এই টুকুন অগ্রগতি পেয়েছে প্রকল্পটি। প্রকল্প পরিচালক তত্ত্বাবধায় প্রকৌশলী মুনিরুল হুদা বলেন, সেবকরা নিজেরাই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বাধা। তাদের সরাতে আমাদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। অস্থায়ী ঘরগুলোতে সার্ভিসলাইন দেওয়া শেষ হলে তাদের সেখানে সরিয়ে নেওয়া হবে। তারপর নতুন ভবনের কাজ শুরু হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে কমপক্ষে আরও তিন বছর সময় লাগবে।
বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্প : চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ১৯৯৫ সালে যে ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছিল তাতে তিনটি নতুন খাল খননের প্রস্তাব ছিল। এর মধ্যে একটি বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত। অপর দুটি হলো নয়াখাল থেকে শীতলঝর্ণা এবং মুরাদপুর থেকে বহদ্দারহাট। পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে ওই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা থাকলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ২০১৪ সালে নগরের বহদ্দারহাটসহ আশপাশে প্রধান সড়ক-উপসড়ক ও এলাকায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে চসিক বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্ষন্ত একটি নতুন খাল খননের উদ্যোগ নেয়। এরজন্য সরকার (ভ‚মি অধিগ্রহণের ২২৪ কোটি টাকাসহ) ৩২৬ কোটি ৮৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়। প্রকল্পে ২৪৫ কোটি ১৩ লক্ষ টাকা সরকার এবং ৮১ কোটি টাকা চসিকের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করার কথা। ২০১৪ সালের ২৪ জুন প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। তবে প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় ২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট। ওই সময় প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, নতুন খালটি নগরীর বারইপাড়াস্থ চাক্তাই খাল থেকে শুরু করে শাহ্ আমানত রোড হয়ে নুরনগর হাউজিং সোসাইটির মাইজপাড়া দিয়ে পূর্ব বাকলিয়া হয়ে বলিরহাটের পার্শ্বে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়বে। খালটির দৈর্ঘ্য হবে আনুমানিক ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার এবং প্রশস্থ ৬৫ ফুট। খালটির মাটি উত্তোলন, সংস্কার ও নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে খালের উভয় পাশে ২০ ফুট করে ২টি রাস্তা ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ করার কথা রয়েছে। এই প্রকল্পের অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে। ওইদিন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বরাবর ভ‚মি অধিগ্রহণের অনাপত্তি ছাড়পত্রের আবেদন করে চসিক। পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে ২০১৬ সালের ৩ জানুয়ারি জেলা প্রশাসনের কাছে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রমের জন্য পত্র দেয় চসিক। ওই সময় জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় ‘এলাইনমেন্ট’ জটিলতায়। কারণ ডিপিপিতে যেসব জায়গায় ভূমি অধিগ্রহণের কথা বলা হয়েছে, সেখানে অধিগ্রহণ অযোগ্য স্থাপনা ছিল (মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান ইত্যাদি)। যার কারণে গৃহায়ণ লিমিটেড নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে ‘এলাইনমেন্ট’ ঠিক করে সংস্থাটি। যে কাজ প্রকল্প অনুমোদের আগে করার কথা, প্রকল্প পরিচালকের গাফিলতি ও অদূরদর্শীতার কারণে সে কাজ করতে হয়েছে প্রকল্প অনুমোদনের পর। এ কারণেই ভূমি অধিগ্রহণের পুরোপুরি অর্থ ছাড় হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ওই সময় প্রকল্পের বিপরীতে সর্বমোট ৬৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ছাড় দেয়া হয়। যার পুরোটাই জেলা প্রশাসনকে দিয়েছিল সিটি কর্পোরেশন। পুরো অর্থ দিতে না পারায় ভূমি অধিগ্রহণ সম্ভব হয়নি।
পরবর্তীতে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পের ব্যয় চারগুণ বাড়িয়ে সংশোধন প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর একনেকে তা অনুমোদন হয়। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লক্ষ্য ৫৬ হাজার। যা প্রথমবারের তুলনায় চারগুণের বেশি। দ্বিতীয় দফা প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয় ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত। আর মাত্র ৫ মাস বাকি থাকলেও প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি বলতে যে দুইটি এলএম মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, সেই অংশে দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করেছে সিটি করপোরেশন। তাই সেখানে কাজ শুরু করবে সংস্থাটি। আগামী ২১ জানুয়ারি ওয়াজ্জারপাড়া এলাকা থেকে খাল খনন প্রকল্প উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।
সেবক নিবাস প্রকল্প : ২০১৮ বছরের ৩০ জুলাই নগরীর পরিচ্ছন্নকর্মীদের জীবনমান উন্নত করার লক্ষ্যে চসিকের গৃহীত ২৩১ কোটি ৪২ লাখ ৬৮ হাজার টাকার ‘পরিচ্ছন্নকর্মী নিবাস’ শীর্ষক প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন হয়। এ প্রকল্পে সরকারি তহবিল (জিওবি ফান্ড) থেকে ১৮৫ কোটি ১৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা প্রদান করা হবে। বাকি ৪৬ কোটি ২৮ লাখ ৫৩ হাজার চসিকের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত। প্রকল্পের আওতায় পরিচ্ছন্ন কর্মীদের জন্য ১৪ তলা বিশিষ্ট ৭টি ভবন নির্মাণ করা হবে। এতে ১ হাজার ৩০৯টি ফ্ল্যাট থাকবে। এর মধ্যে ৩৩ নং ওয়ার্ডস্থ বান্ডেল কলোনিতে ৩টি, ফিরিঙ্গবাজারে ১টি, ২৭ নং ওয়ার্ডস্থ ঝাউতলায় ২টি এবং সাগরিকায় চসিকের নিজস্ব জায়গায় ১টি ভবন নির্মাণ করা হবে। ভবনগুলোতে বসবাসকারী পরিচ্ছন্নকর্মীদের প্রতিটি পরিবারের জন্য দুইটি বেডরুম, একটি রান্নাঘর, দুইটি বাথরুম থাকবে। প্রতিটি ভবনে দুইটি লিফট থাকবে। এছাড়া পরিচ্ছন্নকর্মীদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের জন্য প্রতিটি ভবনের নীচতলা স্কুল ও সাংস্কৃতিক কাজে ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা হবে।