দেবশিশু শেখ রাসেল- জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা

30

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি

তিনি হতে পারতেন নোবেল বিজয়ী বার্ট্রান্ড রাসেলের চেয়েও বড় কোন দার্শনিক। হতে পারতেন বিশ্বসেরা কোন শান্তির দূত। অথবা হতে পারতেন বিশ্বের অবিসংবাদিত কোন মানবতাবাদী নেতা। হতে পারতেন বঙ্গবন্ধুর বিকল্প বিশ্ববন্ধু। হতে পারতেন অনন্য একজন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু নির্মমতা, বর্বরতা তাঁকে কোনোটিই হতে দেয়নি। পরিণত করেছে একটি পরিবারের, একটি জাতির এবং সর্বশেষ বিশ্ব মানবতার দীর্ঘশ্বাস। একটি জাতিসত্তার নির্মাতার রক্ত¯্রােতকে বহন করেও মানবতার চরম ও বর্বর নির্মমতার শিকার হয়েছে একজন শেখ রাসেল। না-ফোটা কুড়ি। ১১ বছরের কম বয়সেই এ পৃথিবী থেকে জীবনের আলো মুছে গিয়েছিল তাঁর। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল। সম্ভাবনার এক অধরা প্রতিভূ। দেবশিশু। বিপর্যস্ত মানবতার এক দুর্ভাগ্যজনক প্রতিনিধি। বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের গর্ভমোছা নিষ্পাপ- নিষ্কলঙ্ক প্রতীক, অনন্য মুজিব শেখ রাসেল।
শোষক পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিস্ফোরণ যখন অত্যাসন্ন, ছয় দফা ঘোষণার প্রায় দুই বৎসর আগে ৩২ নম্বরের অতৃপ্ত, অপূর্ণ গহŸরে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গমাতার পরিশ্রমের আঙিনা আলোকিত করে জন্ম নিয়েছিলেন বাঙালি জাতিসত্তার মহান পুরুষের কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেল। সারা দুনিয়ার শিশুদের প্রতিভু, টগবগে অস্ফুট বয়সের প্রস্ফুটিত শিশু শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদী কণ্ঠ হয়ে সারাদেশ ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনের জন্য চষে বেড়াচ্ছেন। পূর্ব বাংলার মানুষকে নির্মম শোষণ, তাদের প্রতি সীমাহীন বৈষম্য, তাদের অভাব অনটন ও শোষণের বিরুদ্ধে জনগণকে জাগাতে সোচ্চার থেকেছেন। এমনই সংকটময় -শঙ্কাপূর্ণ কুশাসনের বদ্ধ-রুদ্ধ পরিবেশে ৩২ নম্বরের কাঁচা ইট-সিমেন্ট-পাথরের হৃদয় ভেদ করে ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসের ১৮ তারিখের মধ্যরাতে শেখ রাসেলের এ ধারায় আগমন।
বাঙালি জাতিসত্তার অপ্রতিদ্ব›িদ্ব নেতার নেতৃত্বে, জাতীয়তাবাদের বিকাশের যৌবনকালে শেখ রাসেল বেগম মুজিবের ক‚ল ভরিয়ে, নতুন প্রভাতের নতুন সূর্যালোর বার্তা নিয়ে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের নির্মূলের আগমনী হুংকার নিয়ে, জন্ম নিয়েছিলেন। এ জন্মে ছিল যেমন সুখ, সৌরভ, সুষমা এবং বিজয়ের বার্তা, তেমনি ছিল আইয়ুবী স্বৈরশাসকের নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের জাতীয়তাবাদী হুংকার। প্রশান্তির সুখানুভূতি। শেখ রাসেলের জন্ম শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রশান্তি দিয়েছিল, সুখ দিয়েছিল এবং প্রত্যয়ের বার্তা দিয়েছিল। সুখ এবং স্বাচ্ছন্দ্যে আপ্লুত হয়েছিল শেখ পরিবারের অন্য সদস্যরা। বঙ্গবন্ধুর বোনরা, আত্মীয়-স্বজনরা। সেদিনের সকালে ভোরের আলো উজ্জ্বল ছিল। পাখির কলকাকলি মুখরিত ছিল প্রতিবেশ। উত্তাল ছিল পাখ-পাখালি। কুয়াশা ছিল হালকা। মৃদু শিশিরের আচ্ছাদন ছিল। আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ ছিল। আকাশের শ্যামলিমায় রং ছিল, বর্ণ ছিল, চমক ছিল। গভীরতর ছিল আলোর ছটা। মহিমান্বিত ছিল রাতের সীমাহীন নীরবতা। সুমধুর ছিল সকালের আজান। মুক্তির বার্তা এনেছিল বাতাস। শরীর মন প্রাণ জুড়িয়ে ছিল প্রতিবেশ-পরিবেশ।
শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার বয়স ছিল সতের এর কোটায়। আবেগ-উচ্ছ¡াস, আনন্দ আর ভালবাসায় আপ্লুত ছিলেন তিনি। মননের প্রতিটি অনুভূতি উচ্ছসিত- উদ্বেলিত ছিল তার। চঞ্চল-চপল ছিল তার আনন্দে উল্লাসিত মনের প্রতিটি ক্ষণ। তাঁর নিজের অভিব্যক্তি ছিল, ‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্ত গুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার এবং নার্স এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায়, আবার জেগে উঠে। আমরা ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে জেগে আছি। কবে শুনব নতুন অতিথির আগমন বার্তা। অপেক্ষা আর সয়না। মেজো ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন, আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথা ভরা ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল।’ কাক্সিক্ষত ক্ষণ। কাক্সিক্ষত ফল। কাক্সিক্ষত সুসংবাদ। কী যে আনন্দ!
গোটা অক্টোবর মাসের প্রথম ভাগ জুড়েই বাড়িতে চলছিল হইচই। নতুন অতিথি আসবে বলে হাসিনা, জামাল, কামাল, রেহানার অপেক্ষার যেন শেষ হচ্ছে না। হাসুর আব্বা জনতার কাজ নিয়ে সারাদেশে তনময় হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফাতেমা জিন্নাহকে নির্বাচিত করে জয়ী করার জন্য। আইয়ুব খানকে পরাজিত করতে হবে। তার সামরিক শাসনকে, স্বৈরাচারকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে। মানুষকে মুক্তি দিতে হবে। হাসুর মেজো ফুফু চেয়েছিলেন নিভৃতচারিণী রেনুকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে। সেখানে ডাক্তার, নার্স থাকবে। সহযোগিতা থাকবে। সুবিধা থাকবে। কিন্তু সাদা মাটা বাঙালি ঘরের কন্যা, সর্বংসহা, সংবেদনশীল মুজিবের অর্ধাঙ্গিনী চাইলেন, বাড়িতেই বাচ্চা আলোর মুখ দেখুক। কী নিবিড় নিবেদন। তখনো বাড়িটি মাথা তুলে দাঁড়ায়নি। একতলার উত্তর-পূর্ব কোণে হাসিনা যে ঘরটায় থাকে, সেই ঘরে পৃথিবীর আলো দেখবে নবজাতক। এটি মাতা রেনুর ইচ্ছা। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছিল। ভাই বোনদের ভিতরে উচ্ছ¡াস উদ্বেগ- বোন না ভাই আসছে। ১৮ তারিখের মধ্যরাতের দ্বিতীয় অংশ। এ ভাবেই মুজিবের ব্যস্ততার মাঝে শেখ রাসেলের এ ধরায় আগমন। দুদিন পরে শেখ মুজিবুর রহমান ঘরে ফিরে নবজাতকের নাম রাখলেন শেখ রাসেল।
দেশের মানুষের মুক্তি যার রক্তে মিশে ছিল। পাকিস্তানি নব্য শোষক এবং উপনিবেশের বিরুদ্ধে যার সংগ্রাম, আন্দোলন ছিল ধারাবাহিক এবং নিরলস। দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা যিনি মানুষের সুখ-দুঃখ এবং মুক্তির তীব্র তাড়না নিয়ে চষে বেরিয়েছেন সমগ্র পূর্ব বাংলা। সেই চুয়াল্লিশ বছর বয়সী শেখ মুজিবুর রহমান, মানুষের মুক্তির নেশাগ্রস্ত নেতা পুত্র জন্মের সুখবর শুনে সন্তানের নাম রাখলেন রাসেল। বিখ্যাত দার্শনিক, নোবেল জয়ী বার্ট্রান্ড রাসেল।উত্তাল বিশ্বে দার্শনিক বিজ্ঞানী রাসেল ছিলেন পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী নেতাদের একজন। মানুষের বসবাসরত এই পৃথিবীকে সুন্দর, শান্তিময় করতে তিনি গঠন করেছিলেন ‘কমিটি অফ হান্ড্রেড’। মুজিবের চেতনায় তখনকার বিশ্বের শান্তির দূত বার্ট্রান্ড রাসেল আলোড়ন সৃষ্টি করে।
মুজিবের চেতনায় হয়তো জেগেছিল পৃথিবীর মানুষের মুক্তির জন্য যে দর্শন মানবতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে, মানুষের কথা বলে, মানুষের জন্য পথ তৈরি করে দেয়, বিশ্ব শান্তির শাশ্বত বাণী প্রচার করে, মানব ধর্মকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করে, সেই দর্শন ও চেতনার আদর্শ বার্ট্রান্ড রাসেল। তাই নবজাতকের নাম রাখেন রাসেল। শেখ রাসেল একটি স্বপ্নের নাম। শেখ রাসেল একটি অজেয় নক্ষত্রের নাম। যে নক্ষত্রের আলো পৃথিবীতে পৌঁছায়নি। শেখ রাসেল একটি শেখ মুজিব দর্শনের নাম। যার ছোঁয়া থেকে বাংলাদেশ, পৃথিবীর বঞ্চিত হয়েছে। সেদিনের সেই রাত, সেই ক্ষণ, সেই বাতাস, বাতাসের মৃদুমন্দ সমীরণ, আকাশের তারা, সবুজ গাছে, পাখিদের কলকাকলি, ভোররাতের আজান, সবই ছিল মহিমান্বিত, সুমধুর সুর সংগীত, সুখ-শান্তির বার্তাবহ।
বঙ্গবন্ধুর জেলখানার স্বপ্ন জুড়ে ছিল অন্যান্য ছেলে মেয়েদের সাথে একজন রাসেলের শিশু বেলার আচারিক অনুভূতিগুলো। তাই শিশু রাসেলের প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ, ‘দূর থেকে দেখি রাসেল, রেহানা ও হাচিনা চেয়ে আছে আমার রাস্তার দিকে। ১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না- যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। একটু পরে ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল, আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ওর ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি।
বঙ্গবন্ধু তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কারাগারের রোজনামচায় উল্লেখ করেছেন, ‘৮ ফেব্রæয়ারি দুই বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো।’ কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ওতো বোঝেনা আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কী বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে সেই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে । শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা।
রাসেল জেলখানায় গিয়ে কান্নাকাটি করত। বেগম মুজিব প্রতি ১৫ দিন পর একবার ছেলেমেয়েদের নিয়ে জেলখানায় মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করতে যেত। বেগম মুজিব একজন আদর্শ এবং দায়িত্বশীল মা ছিলেন। তিনি ছেলের অবস্থা বুঝে রাসেলের কান্না থামাতে নিজেই বাবা সেজে রাসেলকে আব্বা বলে ডাকতে বলতেন।
রাসেল মাকে আব্বাও ডাকতেন। সন্তান ভোলানোর অপূর্ব কৌশল মায়ের! বঙ্গবন্ধু মুক হয়ে যেতেন। তাঁর হৃদয় ক্ষরণ হতো, তাঁর ভাষা রুদ্ধ হয়ে যেত। সবকিছু সামলিয়ে নিতেন তিনি। আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনকে তীব্র ভৎর্সনা করতেন। এই পিতা-পুত্রের সংগ- সুখ এবং ভালোবাসাকে বাধাগ্রস্ত করে তাঁকে জেলে রাখার জন্য। যে শিশু পুত্রকে নিয়ে তিনি দেশ-বিদেশ সফর করেছেন। অত্যন্ত তৃপ্তির সাথে বিদেশ জয় করেছেন। স্বাধীনতা অর্জনের পরে তিন বছর সাত মাসে ১৪০ টি দেশের স্বীকৃতি এনেছেন। ক‚টনীতিতে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করেছেন। ফিরে এসে এই সন্তানের সাথে, সন্তানকে কোলে তুলে নিতে পারবেন কিনা তার কোন নিশ্চয়তা ছিল না। এই বন্দি জীবনে রাসেল বারবার তাঁর বাবার কথা জিজ্ঞেস করেছে। আপ্লুত হয়েছে। হতাশ হয়েছে। উদাস হয়েছে। নীরব থেকেছে। আবার স্বাভাবিক হয়েছেন। কি অদ্ভুত, অনাকাক্সিক্ষত, অসমতার জীবন!
পৃথিবীতে যে ভালোবাসা কোনদিন বিচ্ছিন্ন করা যায় না। যে ভালোবাসাকে অর্থে মূল্যায়ন করা যায় না। যে ভালোবাসাকে বিনিময় করা যায় না। যে ভালোবাসার জন্য মায়া মমতার পৃথিবী। সেই ভালোবাসা পিতা-পুত্রের, মা-বাবার, পিতা-কন্যার ভালোবাসা। শেখ মুজিবুর রহমান সেই ভালোবাসাকে বিচ্ছিন্ন করে, বঞ্চিত করে দেশের জন্য কাজ করেছিলেন। সন্তানদের সময় না দিয়ে দেশকে ভালোবেসে, দেশকে সময় দিয়েছিলেন। দেশের জন্য যারা বর্বরতা দেখিয়েছে, তাদের হাতে বন্দী থেকে দেশের ভালোবাসাকে তিনি মহিমান্বিত করেছেন। গৌরবান্বিত করেছেন। ইতিহাসের অংশ- অঙ্গ করেছেন। দেশের মানুষের হাজার বছরের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। এই সন্তানদের বঞ্চিত করেই হয়েছেন তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাঙালি জাতির পিতা।
১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখ পর্যন্ত উত্তাল সময়টিতে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ঘোষণা, সর্বদলীয় ছাত্রদের ১১ দফা, ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান, আইয়ুব খানের পতন, উত্তাল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পরিপক্ক হয়। আন্দোলন যতই পরিপক্ক হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ততই দৃশ্যমান হতে থাকে। এই উত্তপ্ত, উর্বর, অনিরুদ্ধ সময়ের জাতক শেখ রাসেল। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হত আটান্ন বছর।
বাবার স্নেহ বঞ্চিত, সোহাগ স্পর্শ পরশ থেকে দূরত্বে অবস্থান করা বঞ্চিত শিশু শেখ রাসেল। শিশু বয়সেই মার সাথে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং অন্যান্য জেলে নিয়মিত যাওয়া আসা করা সময়ের ভ্রæন কুড়ি এই রাসেল। ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারের সর্বশেষ প্রদীপ। নির্মমতার সর্বকনিষ্ঠ উদাহরণ ।
শেখ রাসেলের দুর্ভাগ্য ছিল খুব কম সময় পিতা মুজিবকে, তাঁর স্পর্শকে অনুভব করতে পারা। দু’বছর বয়স থেকেই শেখ রাসেল কারাগার চিনেছেন। মায়ের সাথে নিয়মিত বাবাকে দেখতে গিয়েছেন। বাবাকে জড়িয়ে ধরেছেন। বাবাকে ছাড়তে চান নি। এভাবেই শিশু রাসেলের শিশুকালের দুই, তিন, চার, পাঁচ বছর কেটে গেছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শেখ রাসেলের বয়স ছিল সাড়ে ছয় বছর। সাড়ে ছয় বছরের একটি শিশু আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আবার ২৮৯ দিনের জন্য বাবার সংগ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছে। পাকিস্তানের কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফিরে আসবেন কিনা কোন নিশ্চয়তা ছিল না। তাঁকে মৃত্যুর মুখোমুখি করা হয়। মৃত্যুদÐ দেয়া হয়। ভাবুন তো, ছয় বছর বয়সী একজন শিশুর অনুভ‚তিতে তা কোন ধরনের সাড়া জাগাতে পারে!
একজন রাসেলের এই বঞ্চনা শিশু অধিকার ক্ষুণœ করেছে। মানবতাকে ক্ষুণœ করেছে এবং মানুষ হিসেবে পাকিস্তানি বর্বরদের হিং¯্রতাকে তুলে ধরেছে। সন্তানের প্রতি বাবার ভালবাসার প্রকাশ চিরন্তন। কিন্তু একজন রাসেল বারবার বাবার ভালোবাসা থেকে, সঙ্গ থেকে, স্পর্শ থেকে, ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এই বঞ্চনা আইনের শাসনের ছিলনা। ছিল বর্বরতার।
বর্বরদের বংশধররা, অনুসারীরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোর বেলায় তার চরম প্রকাশ ঘটিয়েছিল, যা মানবতার ইতিহাসে জঘন্যতম, নিকৃষ্টতম, বর্বরতম। এ বর্বরতার ঘৃণা ও নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। শেখ রাসেল শেখ পরিবারের ভালোবাসার প্রতীক। সমগ্র বাঙালি সমাজের ভালোবাসার প্রতীক। শেখ রাসেল নির্মমতার শিকার। বিশ্বমানবতাকে ভ‚লুণ্ঠিত করার নির্মম নজির। ১৫ আগস্টের হায়েনাদের হিং¯্রতার, পশুত্বের, বর্বরতার নিকৃষ্টতম উদাহরণ। সমগ্র জাতি সর্বশেষ খুনির বিচারের রায়ের কার্যকারিতা দেখতে উন্মুখ হয়ে আছে। মাত্র ১০ বছর ৯ মাস বয়সে পৃথিবীর সুখ, সমৃদ্ধি স্বপ্ন আলো থেকে হায়েনারা কেড়ে নিয়েছে তাঁর জীবন প্রদীপ। বাঙালি জাতিসত্তার এটি একটি বড় দায়। আমরা এই দায়মুক্ত হতে পারিনি।
আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও হৃদয়ানুভূতি দিয়ে তাঁকে স্মরণ করি। তাঁর ৫৮ তম জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি জাতির জনক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ ১৫ আগস্টের নির্মমভাবে নিহত হওয়া তাঁর স্বজনদের।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক- বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ অধ্যায়ন কেন্দ্র চট্টগ্রামের প্রধান সমন্বয়ক