দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাসে আমরা কোন পথে হাঁটছি

8

পারভীন আকতার

অধুনা বিশ্বে সবসময় একটা না একটা কথা নিয়ে মানুষের উত্তেজনার শেষ নেই। হয়তো আছে এর মাঝে অনেক মজাদার কিংবা নির্মম কোন উপস্থাপনা। পৃথিবীর যতটুকু মানুষ সভ্যতার আলো দেখছে উল্টো পিঠে আরো অনেক বেশি অন্ধকারে রয়ে গেছে। চড়াদামের বাজারে দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস তারই প্রতিধ্বনি।পয়সা কিন্তু এহাতওহাত হতেই আছে। এখন শপিংমলের গেলে যেকোন একটা ফ্লোরে দেখা মিলে খাবার দাবারের পসরা সাজিয়ে রেখেছে। বাড়তি অর্থ গুনে সময় নিয়ে খেতে হয় বাহারী খাবার। মাঝে মাঝে রুচির পরিবর্তন দরকার।কিন্তু সামনে কঠিন সময়! বড় বড় শপিংমলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা তৈরি হচ্ছে।হাতে অর্থ না থাকলে ফ্যাশন করা যায় না।তাই কীভাবে দিন অতিবাহিত করতে হবে তার আগাম প্রস্তুতিতে ছোটখাটো বিষয়ও যেন বাদ না পড়ে তা মাথায় রাখা সমীচীন। মিতব্যয়ী হতে হবে আমাদের।যুগের চাহিদা নয় নিজের চাহিদা, স্বস্তি, ইচ্ছে এবং মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিন। অল্পতে সন্তুষ্ট থাকার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
এদিকে ইউক্রেন আর রাশিয়ার যুদ্ধ থামানোর জন্য কেউ নেই। শক্তিধর দেশগুলো কেবল পক্ষ বিপক্ষকে উসকে দিতে ব্যস্ত। কেউ পাঠাচ্ছে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র আবার কেউ বা সৈন্যসামন্ত। দুর্ভিক্ষ কেন হবে না? উন্নত দেশগুলো পুরোটাই রাজত্ব করছে আর শোষণ করছে অনুন্নত দেশগুলোকে। নিজেরা ভালো জিনিস ব্যবহার করে দরিদ্র দেশে বিক্রি করছে ইয়াবা, মাদক, প্লাস্টিকের চাল, এবং নানারকম বাজে ইলেকট্রনিকস সামগ্রী ইত্যাদি। ডলারের দাম বাড়ানো হচ্ছে হুড়োহুড়ি করে। সোনার দাম বাড়ছে। টাকার মান কমছে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়তেই আছে। তা কমানোর কোন রাস্তা যেন কারো জানা নেই। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ বের করতে না পারলে দেশ এতো আমলা পুষে কেন জানা নাই। নিত্যপণ্যের দাম হাতের নাগাল থেকে বের হয়ে গেছে অনেক আগেই। তেল, অকটেন, গ্যাসের দামও আকাশছোঁয়া। মানুষ কী করে এমন কঠিন সময় পার করছে তা ভাবুন দয়া করে রাষ্ট্রীয় সরকারগণ। কৃষিখাতে উদাসীনতা, অপচয়, হিংসা, যুদ্ধ আর প্রযুক্তির উপর অত্যধিক গুরুত্ব আর অযাচিত ব্যবহার দুর্ভিক্ষের আসল কারণ। কৃষির উপর সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া দরকার যা অবহেলিত। চাষবাস করলে মনে হয় জাত চলে যায় এমন ভাবে আজকালকার শিক্ষিত সমাজের। অথচ না খেয়ে বাঁচবে কী করে তা কেউ ভাবে না। কৃষকরাই যেন সবার পেটে খাবার জোগান দেয়ার মালিক। রেডিমেড খাওয়া আর কত খাবেন! এবার মাঠে নামুন দয়া করে।
পৃথিবীর খাদ্য উৎপাদন করা, টেকসই অর্থনীতির ভিত রচনা দেশগুলোই এক প্রকার নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কে কার থেকে বড় আর শক্তিশালী তা প্রদর্শন করিয়ে পৃথিবীতে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। এটা ঠিক নয়। পৃথিবীর ক্ষমতা, সম্পদ ক্ষণস্থায়ী। কী হবে এসব নিয়ে লম্ফঝম্প করে? উন্নত রাষ্ট্রগুলো দুর্ভিক্ষের কথা না ভাবে তাহলে অনুন্নত দেশগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক হবে। লোনের বোঝা কমাতে হবে। এখন আপাততঃ উন্নয়নের বৃহৎ প্রজেক্টগুলো বাতিল করে দিতে হবে।খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও মজুদ বাড়াতে হবে। ভূমিহীনকে পতিত ভূমি দিয়ে নিজেদের খাদ্য কিছুটা হলেও নিজেদের জোগাড় করার উৎসাহ দিতে হবে। কৃষিকাজে উৎসাহিত করতে হবে।নবায়নযোগ্য সম্পদ ব্যবহার করে উন্নয়ন কাজে এগিয়ে নিতে হবে।
বর্তমান যুগটাই এমন চারদিকে কেবল নাই নাই হাহাকার ভাষণ। খাদ্যের দুর্ভিক্ষের চেয়ে সঠিক পরিকল্পনার দুর্ভিক্ষ উদ্ভাবনী শক্তির দুর্ভিক্ষ আরো প্রকট। ইচ্ছের মূল্য দেয়ার অবতারণা এই কারণেই।আসলে আমাদের আবাদি জমির কি অভাব? শ’য়ে শ’য়ে বিঘা জমি এখনো অনাবাদি। অথচ আমরা হাহাকার করছি নাই নাই করে। কতটা ভাবছি আমরা ভাসমান চাষাবাদ করতে?কতটা ভাবছি ঝুলন্ত প্রক্রিয়ায় চাষাবাদ করার পরিকল্পনা করতে? বর্তমানে প্রযুক্তির কারিশমায় অনেক অসাধ্য সাধন করা হচ্ছে। আমরা এভাবে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে পারি। জায়গা কিন্তু সবার নাই। কারো কারো আছে কেবল। এ দেশে এতো ভাসমান মানুষের ব্যাপ্তি যারা কি না অনাবাদি পতিত জমিতে থেকে খেয়ে আবাদী করতে সক্ষম! অনেককাল আগে কি আমাদের পথপরিক্রমা জনশ্রæতিতে পরিণত ছিল? ধীরে ধীরে সভ্যতার ডিমান্ডে এগিয়ে গেছে মানুষ। ঐ যে বললাম বোরকা থেকে রুচির পরিবর্তন করে শালীন পোশাক! মানুষ ক্রমাগত পরিবর্তনে বিশ্বাসী। আগেরকার যুগ আর বর্তমান যুগের সাথে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এখন ঘরে বসেই ছোট্ট মোবাইল স্ক্রিনে পুরো দুনিয়ার খবর, ছবি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিশ্ব পরিস্থিতি সব শোনা ও দেখা যায়। মানুষের মেধা খুলছে প্রকাÐতায়। সময় টিকিয়ে রাখে ভালো কাজটি। স্বর্ণযুগ বলতে একটা কথা শুনেছি। বুদ্ধিশুদ্ধি হওয়ার পর বুঝলাম সেই স্বর্ণযুগের হেতু কী ছিল। বারভূঁইয়াদের সময়, ঈসাখাঁ’র সময়। মোগলদের দাপটের সময়কার কথা কে না জানে এখন! বর্তমান আমরা একটি মাঝারি গুছের ভালো জায়গায় দাঁড়িয়ে। অভাব অনটন থাকলেও উন্নয়নধারা অব্যাহত আছে। এদেশের প্রায়ই সব জেলায় কমবেশি উন্নয়ন হয়েছে। রাজনৈতিক অস্বস্তিশীলতা, অস্থিরতার কারণে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে করেন বিজ্ঞজনগণ। কাকের চেয়ে বক সেয়ানা আবার বকের চেয়ে কাক সেয়ানা এই দু’টানায় পড়ে মাঝখানে কষ্ট পাচ্ছে অসহায় নাগরিকগণ। তাই সময় থাকতে সাবধানতা ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া আশু জরুরী। দুর্ভিক্ষ আসবে, খরায় চৌচির হবে ভূমি। প্রযুক্তি নিয়ে আমরা বসে আছি কেন তবে? এইতো সময় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে মাঠে নেমে পড়ার। আশা করি আমাদের আর সময় নষ্ট করা উচিত হবে না।
লেখক : শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক