দু’বছর পর ‘সংযমী’ পহেলা বৈশাখ তবুও বর্ণাঢ্য তবুও আনন্দময়

8

নিজস্ব প্রতিবেদক

মুক্তবুদ্ধি ও বাঙালি সংস্কৃতির চর্চাকে পরম্পরায় ছড়িয়ে দিয়ে প্রাণের উচ্ছ্বাসে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিয়েছে নগরীর সব শ্রেণিপেশার মানুষ। পৃথিবীতে বিরল এই অসাম্প্রদায়িক উৎসবে মেতেছে অবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই। করোনাজনিত কারণে দু’বছর পর খানিকটা সীমিত পরিসরে হলেও মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ বর্ণিল আয়োজনে এবার উদযাপিত হয়েছে পয়লা বৈশাখ। নগরীর সিআরবির শিরীষতলা, ডিসি হিল, শিল্পকলার অনিরুদ্ধ মুক্তমঞ্চ আয়োজন ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। চারুকলা থেকে বের হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় করা এবং প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে সাম্প্রদায়িকতা ও পশ্চাৎপদতাকে দূরে সরিয়ে দেয়ার বার্তা পৌঁছে দেয়া হয় সকলের কাছে। বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত অনুষ্ঠানের কথামালা পর্বে বিদগ্ধজনরা পয়লা বৈশাখের মত বিশ্বে বিরল অসাম্প্রদায়িক উৎসব আয়োজনকে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। নানা বিধি-নিষেধের কারণে এবার পহেলা বৈশাখকে সংযমের উৎসব বলে মন্তব্য করেছেন সংস্কৃতিকর্মীরা।
বৈশ্বিক অতিমারী করোনার সংক্রমণ, নিরাপত্তাজনিত নানা ইস্যু ও পবিত্র রমজানের কারণে এবার বাংলা নববর্ষ বরণ অনুষ্ঠানের আয়োজনে নগর পুলিশের পক্ষ থেকে বেশকিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এরপরও নানা শ্রেণিপেশার মানুষ বর্ণিল সাজে দলে দলে যোগ দিয়েছেন বর্ষবরণের আয়োজনে। প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল নগরীর সিআরবির শিরীষতলা। ডিসি হিলেও লোকসমাগমের কমতি ছিল না। তবে আয়োজকদের দৃষ্টিতে পবিত্র রমজান, করোনা সংক্রমণ ও নিরাপত্তাজনিত কারণে পুলিশের পক্ষ থেকে সময় বেঁধে দেয়াসহ নানা সীমাবদ্ধতা না থাকলে জনসমাগম আরও অনেক বেশি হত।
গত বৃহস্পতিবার সকাল আটটায় নগরীর শিরীষতলায় পয়লা বৈশাখ উদযাপনের চতুর্দশ আয়োজন শুরু হয় ‘ভায়োলিনিস্ট চিটাগংয়ের’ বেহালা বাদনের মধ্য দিয়ে। নববর্ষ উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে দিনব্যাপী এই আয়োজনে উদীচী, সঙ্গীত ভবন, সুরাঙ্গন বিদ্যাপীঠ, সুর সাধনা সঙ্গীতালয়, রেলওয়ে সাংস্কৃতিক ফোরাম, স্বরলিপি সাংস্কৃতিক ফোরাম, সৃজামী, অদিতি সঙ্গীত নিকেতনসহ বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীরা সম্মিলিত গান পরিবেশন করেন। বোধন আবৃত্তি পরিষদ, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, শব্দনোঙ্গর, তারুণ্যের উচ্ছ্বাসসহ কয়েকটি সংগঠনের শিল্পীরা বৃন্দ-আবৃত্তি পরিবেশন করেন। ওড়িশী এন্ড টেগোর ড্যান্স মুভমেন্ট সেন্টার, নৃত্যনীড়, রাগেশ্রীসহ বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীরা মঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করেন। এই আয়োজন উপভোগ করতে হাজির হয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদসহ বিশিষ্টজনরা। নববর্ষ উদযাপন পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ মালেক এবার একুশে পদক পাওয়ায় মঞ্চে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে দুপুর একটার দিকে অনুষ্ঠানের পর্দা নামে।
নববর্ষ উদযাপন পরিষদের সহ সভাপতি ডা. চন্দন দাশ বলেন, নানা বিধি নিষেধ ও সংশয় থাকার পরও সীমিত পরিসরে হলেও আমরা সুন্দরভাবে সব আয়োজন সম্পন্ন করেছি। আসলে বাঙালি জাতি কখনোই রক্ষণশীলতা-পশ্চাৎপদতার কাছে পরাভব মানে নি। এবারও বর্ষবরণের আয়োজনে মানুষ প্রমাণ করেছে যে, বাঙালি তার জাতিসত্তার আবহমান ঐতিহ্যের প্রতি অকুতোভয় ও আজম্ম শ্রদ্ধাশীল।
অন্যদিকে নগরীর ডিসি হিলের মুক্তমঞ্চে সম্মিলিত পয়লা বৈশাখ উদযাপন পরিষদ আয়োজন করে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। অনুষ্ঠানমালা শুরু হয় সকাল সাতটায়। মুক্তমঞ্চে ছন্দানন্দ সাংস্কৃতিক পরিষদ, গুরুকুল সংগীত একাডেমি, নটরাজ নৃত্যাঙ্গন একাডেমি, গুরুকুল, ঘুঙুর নৃত্যকলা কেন্দ্র, সঞ্চারী নৃত্যকলা একাডেমি, নৃত্য নিকেতন, দি স্কুল অব ফোক ডান্স, বোধন আবৃত্তি পরিষদ, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, স্বরনন্দন প্রমিত বাংলা চর্চা কেন্দ্র ও বিভাস আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রসহ ৩২টি সংগঠনের শিল্পীরা সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সকাল ১০টায় মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করেন। নগরীর বাদশা মিয়া সড়কে ক্যাম্পাস থেকে শোভাযাত্রা নিয়ে নগরীর কাজির দেউড়ি ঘুরে আবার ক্যাম্পাসে যান তারা। চবি উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেণু কুমার দে এবং চারুকলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক লিটন মিত্র চৌধুরী শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন।
চারুকলা ইনস্টিটিউটের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী জহির রায়হান অভি বলেন, রমজানের কারণে এবার প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু বিধিনিষেধ দেয়া হয়। সেজন্য আমরা সীমিত পরিসরে শোভাযাত্রা করেছি। এরপরও ইলিশ মাছ, মুরগী, টুনটুনি পাখি, ঘোড়ার প্রতিকৃতি এবং সিংহ, পেঁচাসহ বিভিন্ন প্রাণির মুখোশ এবং রঙ-বেরঙের সরাচিত্র স্থান পেয়েছে শোভাযাত্রায়। এছাড়া পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে পুরো বাদশা মিয়া সড়ক আলপনার রঙে ভরিয়ে তোলা হয়েছে।
জেলা শিল্পকলা একাডেমি থেকেও বর্ষবরণ উপলক্ষে সকালে শোভাযাত্রা বের হয়। শিল্পকলার অনিরুদ্ধ মুক্তমঞ্চে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শিশু একাডেমি, ফুলকি স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয়েছে। নগরীর হাজারী লেনে কাউন্সিলর জহর লাল হাজারীর ব্যবস্থাপনায় চলছে দুই দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা।
বৈশাখী কথামালায় বক্তারা বলেন, পয়লা বৈশাখ বা বাংলা বর্ষবরণ তো শুধু একটি নিখাদ সার্বজনীন উৎসবই নয়। এটি বাঙালির একটি সম্মিলনের আয়োজন। এই উৎসব মানবিকতার কথা বলে। আজ সমাজে মানবিকতার খুবই অভাব। আমরা আজ সমাজে বা রাষ্ট্রে দেখতে পাচ্ছি- প্রায় প্রতিদিন খুন, ধর্ষণের মত পাশবিক ঘটনা ঘটে চলেছে। বাঙালির এই সম্মিলিত উৎসব থেকে আমরা এসব অনাচারের প্রতিবাদ এবং মানবিক সমাজ নির্মাণের কথা বলতে চাই। সকল বিভেদ-বৈষম্যের ঊর্ধ্বে ওঠে বলতে চাই আমরা সবাই মানুষ। এই মানুষের মানবিকতার সংস্কৃতি যেদিন সারা দেশে সকলের চিন্তায়-মননে ছড়িয়ে দিতে পারব, সেদিনই স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে।