দলে ‘আতিক্কা নেত্রীদের’ খোঁজ নিচ্ছে আ.লীগ

45

রাহুল দাশ নয়ন

‘হ্যাটট্রিক’ ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। দলটির উন্নয়ন ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অন্যান্য দলগুলো খেই হারিয়ে ফেলেছে। সুবিধাভোগীরা বিভিন্ন দল ছেড়ে আওয়ামী লীগের যোগ দিচ্ছে। এতে আওয়ামী লীগের শক্তি বাড়লেও সাংগঠনিকভাবে তৃণমূলে বিরোধ বেড়েছে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে ভুঁইফোড় সংগঠন। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, লীগ ও শেখ হাসিনার নামেও আনাচে-কানাচে সংগঠনের ছড়াছড়ি। পরে এসব সংগঠনের হাত ধরে অনেকেই মূল সংগঠনেও জায়গা করে নিয়েছে। নিজস্ব বলয় শক্তিশালী করতে এসব অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের কতিপয় প্রভাবশালী নেতা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছেন ক্ষমতাসীন দলের ‘আতিক্কা নেত্রী’রা। যারা পাঁচ বছর আগেও রাজনীতির মাঠে সক্রিয় ছিলেন না। তারা এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতির নিয়ন্ত্রকে পরিণত হয়েছেন। অনেকেই প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের আস্থাভাজন হয়ে মূল দলের নেতাদের উপর ছড়ি ঘুরান। চট্টগ্রামে সরকার দলীয় অধিকাংশ সাংগঠনিক ইউনিটেই পুরানো নেত্রীদের পাশ কাটিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন ‘রূপসী’ নেত্রীরা। কোনোধরনের পারিবারিক, রাজনৈতিক ঐতিহ্য কিংবা সাংগঠনিক ভিত্তি না থাকলেও রূপের বাহার দেখিয়ে কিছু কিছু নেতার কাছে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন এসব নেত্রী। তারা এখন রাজনীতির সামনের সারির বাসিন্দা। তাদের ফেসবুকে ঢুঁ মারলেই দেখা মিলবে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সাথে হাস্যোজ্জ্বল ছবি।
দলের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ভুঁইফোড় সংগঠনকে ‘রাজনৈতিক দোকান’ ও অনুপ্রবেশকারীদের ‘মৌসুমি কোকিল’ নামে আখ্যায়িত করেছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কিন্তু এসব ‘দোকান’ কিংবা ‘মৌসুমি কোকিল’দের দৌরাত্ম্য কমাতে এতদিন কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি ক্ষমতাসীন দলটি। সম্প্রতি হেলেনা জাহাঙ্গীর ও দর্জি মনির নামে দুই ভুঁইফোড় সংগঠনের নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর টনক নড়েছে আওয়ামী লীগের।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ পূর্বদেশকে বলেন, ‘ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে দল থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।এরা দল বা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করেন না। এসব সংগঠন করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল ও ধান্ধাবাজিতে ব্যস্ত। ইতোমধ্যে বিতর্কিত আড়ইশ রাজনৈতিক দোকানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণও শুরু হয়েছে। কেউ পার পাবে না।’
সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে কোনো সংগঠন করতে হলে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ এর অনুমোদন নিতে হয়। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত সংগঠনের ক্ষেত্রে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু ভুঁইফোড় সংগঠনগুলো প্রেস রিলিজ দিয়েই নিজেদের অবস্থানের জানান দেয়।
জানা যায়, উপজেলা, জেলা ও মহানগরে কি পরিমাণ ভুঁইফোড় সংগঠন গড়ে উঠেছে এবং সংগঠনের নেতৃত্বে কারা আছেন এসব বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। পাশাপাশি হঠাৎ করে নেতা বনে যাওয়া ‘আতিক্কা নেত্রী’দের বিষয়ে খোঁজ নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। যারাই অনুপ্রবেশ করেছেন তারা ভুঁইফোড় সংগঠনকেই সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এসব সংগঠনে ঢুকে পড়েছেন জামায়াত-শিবির, বিএনপির নেতাকর্মীরাও। যাদের একসময় রাজনৈতিক অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগ বিরোধী তারাই এখন আওয়ামী লীগের অন্তপ্রাণ কর্মীতে পরিণত হয়েছেন। ফেসবুক রাজনীতি ও প্রেস রিলিজ রাজনীতিতে তারাই সামনের সারির কর্মী। এসব নেতা-নেত্রীদের কর্মকাÐে বিব্রত ত্যাগী ও পুরনো নেতাকর্মীরা। শুধু তাই নয়, সারাদেশে এই ভুঁইফোড় সংগঠন নিয়ে আলোচনার মধ্যে চট্টগ্রামে অন্তত তিনটি নতুন কমিটি হয়েছে এসব সংগঠনের।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক নেতা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রথমে এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের উদ্যোক্তাদের কর্মকান্ড ও সম্পদের খোঁজ নেওয়া হবে। সরকার বা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্যে কারা এসব সংগঠনের পেছনে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, সেটাও খোঁজ নেওয়া হবে।’
সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ‘আতিক্কা নেত্রী’ ও ভুঁইফোড় সংগঠনের কর্মকান্ড। দুঃসময়ে সংগঠন করা নেতাকর্মীরাও অনুপ্রবেশকারীদের মোটেই সহ্য করতে পারছেন না। ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সাথে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত থাকা নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরে পোস্টও দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে নারাজ আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা।
বাঁশখালীর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আনসুর আলী নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘বাঁশখালীতে কয়েকজন নারী দশ বছর আগেও উপজেলায় এসে বাসা ভাড়ায় থাকতো, কেউ বিউটি পার্লার করতো, কেউ পাহাড় থেকে কাঠ কুড়িয়ে বাজারে এনে বিক্রি করে সংসার চালাতো, কেউ প্রাণী সম্পদ অফিসে মাস্টার রোলে অন্যের সনদ নিয়ে নেতাদের সুপারিশে বেতন নিতো। এখন সবাই দেখি রাস্তায়, নেতাদের সাথে বাসায়, থানা বিচারালয়ে, রাজনীতির মিটিংয়ে প্রথম সারির নেত্রী। তারা যদি কোনো অপকর্ম করে ধরা পড়ে এ দায় আওয়ামী লীগকেই বহন করতে হবে। অনেকে পদবি ব্যবহার করছে। এরা দলের কেউ নয় এমন নোটিশ প্রকাশের অপেক্ষায় আছি।