ড. গাজী সালেহ উদ্দিন করোনায় ঝরেপড়া এক নক্ষত্র

19

 

আজকের এই লেখার ভূমিকা কিভাবে শুরু করবো বুঝে উঠে পারছিনা। কারণ সম্পূর্ণ সুস্থ সবল মানুষ, দুই ডোজ টিকা নেবার পরও, কোভিড-১৯ সংক্রমণে কয়েকদিন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে, প্রতি ডোজ একলক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা মূল্যের ‘একটেমরা’ ইনজেকশন প্রয়োগ করেও মৃত্যুকে ঠেকানো যায়নি। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধেও চেতনাকে লালন করি এবং সৃজনশীরতাকে চর্চা করি, তারা প্রত্যেকেই স্যারের প্রয়াণে অত্যন্ত দুঃখিত, শোকাহত, একই সাথে করোনায় এমন দ্রæত মৃত্যু দেখে বিস্মিত। নভেল করোনা নামক বিশ্ব মহামারি সৃষ্টিকারী অনুজীবটি কত যে ভয়াবহ এমন টববগে সতেজ মানুষের মৃত্যুর মাধ্যমে আবারও দেখিয়ে দিল। বলছিলাম, আমার ত্রৈমাসিক ত্রিকাল পত্রিকার প্রধানউপদেষ্টা ড. গাজী সালেহ উদ্দিন স্যারের কথা। ত্রিকাল সাময়িকী সম্পাদনা করতে গিয়ে শ্রদ্ধেয় ড. গাজী স্যারের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে। সেই হিসাবে তাঁর বাসায় আসা যাওয়া ছাড়াও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। অনুধাবন করতে পেরেছি তিনি কত উচ্চমানের মানুষ। অভিভূত হয়েছি একজন অসাধারণ মানুষ, সাধারণ মানুষের সাথে সম্পৃক্ত হবার সক্ষমতা দেখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মত সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের শিক্ষক হবার সত্তে¡ও ছোট-বড়, উঁচু-নিচু, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবশ্রেণির গণমানুষের সাথে মিশে যাবার যাদুকরী ক্ষমতা। তিনিই পুনরায় প্রমাণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কবিতার অংশ বিশেষ ‘উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে, তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে’।
শ্রদ্ধেয় গাজী সালেহ উদ্দিন স্যার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ছিলেন এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন ও প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিবের হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রামের বধ্যভ‚মি রক্ষা, খেলাঘর আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠাসহ অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল বিভিন্ন সামাজিক সংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামে গাজী স্যার সামনের সারিতে ছিলেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীর বিচারে তাঁর লেখা ‘প্রামাণ্য দলিল, মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ বইয়ের তথ্যকে দালিলিক সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। উচ্চ আদালত কর্তৃক সারা দেশে বধ্যভূমি সংরক্ষণের যে নির্দেশনা রয়েছে, সেটি আদালতে তাঁরই রিট করার প্রেক্ষিতে হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য ওয়ান-ইলেভেন সময়ে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হলে তিনি প্রতিবাদ জানান। যার প্রেক্ষাপটে তৎকালীন উপাচার্যসহ র‌্যাব কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। শুরুতেই যে কথা বলছিলাম, সুস্থ সবল এমন ব্যক্তির মৃত্যু মেনে নেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ১৯ জুলাই সিআরবি’তে আন্দোলনে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রেখেছেন। ২৬ জুলাই ফেসবুকে নিজের আইডি থেকে সিআরবি’তে হাসপাতাল নির্মানের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দেন। এরপর হাসপাতাল ভর্তির কয়েক দিন আগেও সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ প্রসঙ্গে ত্রিকাল পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক শ্যামল বৈদ্য সবুজের সাথে দীর্ঘ সময় কথা বলেন। এই সময় গাজী স্যার একটি প্রশ্ন নিক্ষেপ করে জানতে চেয়েছিলেন, ‘আচ্ছা বলতো, সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল হলে তোমার ক্ষতি কি, আর না হলে তোমার লাভ কি?’ এই বিষয়ে মতামত জেনে অবশেষে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত জানিয়ে বললেন, তোমরা বিভিন্ন প্রকার রাজনীতি বুঝনা। জেনে রেখো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে প্রকৃত তথ্য গোপন রেখে হাসপাতাল নির্মাণের অনুমোদন নিয়েছে। এখানে কখনো হাসপাতাল নির্মাণ হবেনা। তবে এই হাসপাতাল নির্মাণকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি হবে।
শ্রদ্ধেয় ড. গাজী সালেহ উদ্দিন স্যার ছিলেন আমার ত্রিকাল পত্রিকার অভিভাবক। বিভিন্ন সময় উপদেশ পরামর্শ দিয়ে ত্রিকালকে সমৃদ্ধ করতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি সমাজে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা মূল্যবোধসম্পন্ন আলোকিত মানুষ গড়ার জন্যে সম্পূর্ণ অবৈতনিক ব্যতিক্রমধর্মী ‘নৈতিক স্কুল’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। গত কয়েক মাস আগে এই নৈতিক স্কুলে শিশু সাহিত্যিক ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল স্যার এসেছিলেন। জনপ্রিয় ইত্যাদি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের পরিচালক ও উপস্থাপক হানিফ সংকেত, এই স্কুল সম্পর্কে ইত্যাদিতে প্রচারের জন্যে চিত্রধারণ করতে এসেছিলেন। এই সকল বিষয় সচিত্র ত্রিকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় স্যার খুবই খুশি হয়েছিলেন। এছাড়া প্রতি সংখ্যায় তিনি আমাদের পরামর্শ দেয়ার পাশাপাশি নিজেই ত্রিকাল পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে সবার কাছে জনপ্রিয় ও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। আমরা যখন যেভাবে সাহায্য সহযোগিতা চেয়েছি, তাঁর কাছ থেকে সেভাবে উদার হস্তে পেয়েছি। একবার কথার প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছেন, আমার এই পর্যন্ত কয়টা বই প্রকাশিত হয়েছে? দৈনিক পত্রিকায় আমার লেখাগুলো বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে কিনা জানতে চান। না হলে বাছাই করে বই আকারে প্রকাশ করার পরামর্শ প্রদান করেন। এই বিষয়ে চট্টগ্রাম টিচার্স কলেজের অধ্যাপক সর্বজন শ্রদ্ধেয় আমার প্রিয় শামসুদ্দিন শিশির স্যারের সাথে কথা হলে, তিনি নিজেই ‘উচ্চ শিক্ষার উচ্চতার পরিমাপ ও মূল্যায়ন’ নামে একটি বই প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য শামসুদ্দিন শিশির স্যারও ত্রিকাল পত্রিকার উপদেষ্টা। এইদিকে বই প্রকাশনার সকল প্রস্তুতি শেষ, এখন ছাপার অপেক্ষায় আছে। কয়েকদিনের মধ্যে হয়ত বই হাতে পাব, কিন্তু পড়ার জন্যে গাজী সালেহ উদ্দিন স্যারকে পাব না।
গাজী স্যারের মত এমন বহুমাত্রিক শিক্ষক, লেখক, সংগঠক, পরামর্শক সকল বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তিত্ব সচরাচর খুবই দেখা যায়না। সকল আন্দোলন সংগ্রামে সর্বাগ্রে নেতৃত্ব দিয়ে জয়ী হয়ে এসেছেন। এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে জয়ী হয়ে, কিন্তু করোনা যুদ্ধে মাত্র কয়েকদিন লড়াই করে জয়ী হয়ে আসতে পারেননি। ¯্রােতের বিপরীতে চলতে পারা এমন দুর্দান্ত মনোবলযুক্ত অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল সাহসী শিক্ষাবিদ গত ৬ জুলাই রাত সাড়ে আটটার সময় ৭৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একইসাথে বলা যায় চট্টল আকাশ থেকে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ঝরে গেল। যে নক্ষত্রের আলোর আর কোন দিন প্রতিফলিত হবেনা। চিরকাল রয়ে যাবে সেই নক্ষত্রের আলোর অভাব। চট্টগ্রামবাসী হারালো একজন গুণী ব্যক্তিত্ব, আমরা ত্রিকাল পত্রিকা হারালাম একজন অভিভাবক।

লেখক: সম্পাদক ত্রিকাল পত্রিকা