জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা

34

মোহাম্মদ শফর আলী

১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বৃটিশরা এই উপ মহাদেশ শাসন করে। দীর্ঘ সময় বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের ফলে ৪৭ সালে ভারত উপ মহাদেশে ভারত-পাকিস্তান নামের দু’টি দেশ স্বাধীনতা পায়। হিন্দু-মুসলিম দ্বি-জাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে বর্তমান বাংলাদেশ-পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সিন্দু, উত্তর পশ্চিম সিমান্ত প্রদেশ বেলুচিস্তানকে নিয়ে হয় পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশের সিন্দু প্রদেশেই একমাত্র মুসলিম লীগের পক্ষে অর্থাৎ পাকিস্তানের পক্ষে ভোটদেয় এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দীর নেতৃত্বে বাংলায় (অভিবক্ত বাংলায়) সরকার গঠন করেন অর্থাৎ মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রগঠনের পক্ষে।
১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র-স্বাধীনতা লাভ করে। যে বাঙালির ভোটে পাকিস্তান হয় সে বাঙালিদের পাকিস্তানের ৩য় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে পাঞ্জাবীরা পূর্ব পাকিস্তানকে শাসন আরম্ভ করে। বাঙালিদের অবস্থা হলো ফুটন্ত তেলের কড়াই থেকে বাঁচার জন্য আগুনে লাফিয়ে পড়ার মতো। বৃটিশদের থেকে মুক্তি পেয়ে পাঞ্জাবীদের দাসত্বে যাওয়ার মত।
উন্নয়ন, শিক্ষা, চাকুরী, রাষ্ট্র পরিচালনা, সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীতে নিয়োগ সর্বক্ষেত্রে আমরা ধীরে ধীরে সবদিক হারা হতে থাকি। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর সম্পূর্ণ অরক্ষিত-পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় মানুষের পক্ষে গোলামির থেকে মুক্তির জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা কর্মসুচি ঘোষণা করেন। ১৯৬৬ সালে ৫ ফেব্রæয়ারি লাহোর পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মুহাম্মদ আলী পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলোর নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি সম্মেলন ডাকেন-সে সম্মেলনে,বঙ্গবন্ধু ৬ দফা কর্মসুচি প্রকাশ করেন। সম্মেলন শেষে ঢাকা বিমান বন্দরে ফিরে সাংবাদিকদের বলেন, বাঙালিরা দিতে দিতে রিক্ত হয়ে গেছে এখন দেবারমত আর কিছু নেই।” ১৩ এপ্রিল ৬ দফার প্রতি সমর্থন জানান সর্ব প্রথম চট্টগ্রাম থেকে জননেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী ও জননেতা এম, এ, আজিজ।
বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা :
১। ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে-শাসনতন্ত্র তৈরী করতে হবে। প্রাপ্ত বয়স্কদের সরাসরি ভোটে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচীত হইবে।
২। পররাষ্ট্র, দেশরক্ষা কেবল ফেডারেশনের (কেন্দ্রের) নিয়ন্ত্রণে, বাকী সব প্রদেশের নিযন্ত্রনে।
৩। এই দফায় ২টি বিকল্প প্রস্তাব হলো-
ক) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজ বিনিময় যোগ্য মুদ্রা প্রচলন করতে হবে। এই ব্যবস্থায় কারেন্সী থাকবে অঞ্চল বা প্রদেশের নিয়ন্ত্রণে। দুই অঞ্চলের জন্য পৃথক ২টি স্বতন্ত্র-স্টেট ব্যাংক থাকিবে।
খ) একই কারেন্সী থাকবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা থাকবে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু এমন ব্যবস্থা থাকতে হবে যেন, পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে।
৪। টেক্স, খাজনা, কর ধার্য, আদায় ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে। রেভিনিউর অংশ আদায়ে সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেশনের ফান্ডে জমা হবে। এই অর্থ ফেডারেশন সরকারের তহবিল।
৫। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে। পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানেই থাকবে। পশ্চিম পাকিস্তানে মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে থাকবে।
৬। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্যারা মিলিটারী/রক্ষি বাহিনী গঠন করতে হবে। (এর কারণ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে প্রমাণিত)।
বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ঘোষণার পর পরই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান চট্টগ্রামে এক সভায় বললেন-অস্ত্রের ভাষায় কথা বলা হবে। আয়ুব খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো এই ৬ দফা কি তারাই বুঝেছেন। এটা যে ৬ দফা নয় এই ১ দফা বাংলাদেশের স্বাধীনতা। একটি দেশে ২ প্রকার মুদ্রা ২টি ষ্টেট ব্যাংক, বাঙালিদের নিয়ে পৃথক প্যারামিলেটারী গঠন এর অর্থই হচ্ছে স্বাধীনতা। সে সময় যদি সরাসরি স্বাধীনতার কথা বলা হতো তাহলে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে লটকানো সহজ হতো। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের সে সুযোগ দেয়নি।
বঙ্গবন্ধু কেবল ৬ দফা দিয়ে থেমে যায়নি, ছাত্রলীগ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দ্বারা বাংলার ছাত্র যুব, কৃষক শ্রমিক-কে ঐক্য কত করার সাথে সাথে ডিফেন্স ও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতের সরকারের সহিত যোগাযোগ রক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি এবং নির্বাচনের মাধ্যমে একক দল আওয়ামীলীগ, একক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৈরী হয়ে গেলেন মুক্তির অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌছার জন্য।
৬ দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি হয়ে যায়। আয়ুব মুনায়েম বঙ্গবন্ধু ও ৬ দফার প্রতি জনসমর্থন দেখে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চালু করেন। আগরতলা মামলার সাক্ষী এবং বৈরিসাক্ষীদের সাক্ষ্য প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য নানাবিদ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তর এক প্রেস নোট প্রচার করেন-১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তান সরকার কর্তৃক (মোনায়েম খান সরকার) উদঘাটিত পাকিস্তান জাতীয় স্বার্থবিরোধী এক ষড়যন্ত্র লিপ্ত থাকার অভিযোগ দুজন সি,এস,পি অফিসার সহ আটাশ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিগণ ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাই কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আসছিলেন। তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য সংগঠিত হচ্ছে। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজন ষড়যন্ত্রের জন্যে ভারতের আগরতলায় গিয়েছিল। তাঁরা ভারতীয় সামরিক অফিসার লেঃ কর্ণেল মিশ্র আর মেজর মেননের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনার নিয়ে আলোচনা করে। তাঁরা প্রচুর অর্থ আর অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে। প্রমাণ পাওয়া গেছে যে বিভূতি ভূষণ মানিক চৌধুরী সহ কয়েকজন ইতিমধ্যে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে, তদন্ত সমাপ্তির পথে। “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার” শুনানী আরম্ভ হবে। তদন্তে অনেকে নিজ নিজ ভূমিকা সম্পর্কে স্বীকার করেছেন।
আগরতলা আলোচনায় অস্ত্র সংগ্রহের আশ^াস পান, কাগজপত্র দলিল উদ্ধার করা হয়। সরকার ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রে নস্যাৎ করে দিয়েছে। পাকিস্তান বেতার ও সংবাদপত্রে-এই চাঞ্চল্যকর সংবাদটি পরিবেশন করার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে একটি আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। ১৮ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র দপ্তর আর এক প্রেস নোটে বলা হলো এই ষড়যন্ত্র শেখ মুজিবুর রহমানে জড়িত আছে। প্রথম প্রেস নোটে শেখ মুজিবুর রহমান নামোল্লেখ থাকলো না। দ্বিতীয় প্রেস নোটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের ছোট ভাই সামশুর রহমানে খান সি,এস, পি সহ আরো কিছু ব্যক্তি এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন বলে তাঁরা অভিযুক্ত হয়ে বন্দি হলেন। আটক সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিদের দেশরক্ষা আইনে অভিযোগ এর পরিবর্তে ১৮ জানুয়ারি আর্মী, নেভী এবং এয়ারফোর্স এ্যাক্ট অনুসারে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। অভিযুক্তদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট আয়ুব খাঁন ফৌজদারী আইনের সংশোধনী এনে বিশেষ ট্রাইবুন্যাল ১৯৬৮ অডিন্যান্স নং-৫-১৯৬৮ জারি করে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি এস,এ, রহমানের নেতৃত্বে বিচারপতি মুজিবুর রহমান খান বিচারপতি মকসুমুল হাকিম সমন্বয়ে একটি বিশেষ ট্রাইবুন্যাল গঠন করেন। গঠিত ট্রাইবুন্যালের উপর বন্দী আওয়ামীলীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ ৩৫ জনের বিচারের দায়িত্ব অর্পন করা হয়। এই ট্রাইবুন্যালের রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের কোন সুযোগ ছিলনা। সরকারি উকিল (পরে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য) টি এইচ খান এই মামলা প্রস্তুত করেন। এই মামলার বিবাদী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ সকলের মুক্তির লক্ষ্যে মামলা পরিচালনার খরচ যোগালেন আপামর জনসাধারণ। বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা পুস্তিকা আকারে এবং বাংলার বাণী পত্রিকা বিক্রি করে স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা অর্থ সংগ্রহ করে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা টিপিনের অর্থ আগরতলা মামলা পরিচালনার জন্য প্রদান করেন। এই মামলার সাক্ষীদের স্বাক্ষ্য কার্যবিবরণী প্রতিদিন দৈনিক আজাদ, দৈনিক পূবদেশে (ঢাকা) প্রকাশ করা হতো। সরকার তখন “ইত্তেফাক” বন্ধ করে দেন।
এই মামলার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা বাংলায় একক নেতা হিসাবে সামনে চলে আসেন। বঙ্গবন্ধু ইতিপূর্বে তার সংগঠন আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগকে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্ষমতার তৈরী করেন। আগরতলা মামলা চলাকালে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়। বিশ^বিখ্যাত আগরতলা মামলার আসামীদের নাম তুলে ধরলাম (১) শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর, (২) লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন (বরিশাল), (৩) ষ্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান (ফরিদপুর), (৪) সুলতান উদ্দিন আহ্মেদ (ঢাকা), (৫) নুর মোহাম্মদ (ঢাকা), (৬) আহমেদ ফজলুর রহমান পি,এস,পি (কুমিল্লা), (৭) সার্জেন্ট মফিজ-উল্লাহ্ (৮) কর্ণেল (অব.) আবুল বাশার মোঃ আবদুস সালাম (বরিশাল), (৯) হাবিলদার দলিল উদ্দিন (বরিশাল), (১০) রুহুল কুদ্দুছ, সি.এম.পি (খুলনা), (১১) সার্জেন্ট মোহাম্মদ ফজলুল হক (বরিশাল), (১২) ভূপতি ভূষণ চৌধূরী ওরফে মানিক চৌধুরী (চট্টগ্রাম), (১৩) বিধান কৃষ্ণ সেন (চট্টগ্রাম), (১৪) সুবেদার আবদুর রাজ্জাক (কুমিল্লা), (১৫) হাবিলদার ক্লার্ক মুজিবুর রহমান (কুমিল্লা), (১৬) সার্জেন্ট আবদুর রাজ্জাক (কুমিল্লা), (১৭) সার্জেন্ট জহুরুল হক (নোয়াখালী), (ট্রাইবুনালে মামলা চলাকালীন সময়ে কেন্টনমেন্ট তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে এই বীরের নামানুসারে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল নামকরণ করা হয়)। (১৮) মোঃ খুরশিদ (ফরিদপুর), (১৯) শামসুর রহমান খান, সি.এম.পি (ঢাকা), (২) সামশুল হক (ঢাকা), (২১) হাবিলদার আজিজুল হক (বরিশাল), (২২) মাহফুজুল বারী (নোয়াখালী), (২৩) সার্জেন্ট সামশুল হক (বরিশাল), (২৪) মেজর সামশুল আলম (ঢাকা), (২৫) ক্যাপ্টেন আবদুল মোত্তালেব (ময়মনসিংহ), (২৬) ক্যাপ্টেন এম, শওকত আলী মিঞা (বরিশাল), (২৭) ক্যাপ্টেন খোন্দকার নাজমুল হুদা (বরিশাল), (২৮) ক্যাপ্টেন এ.এন.এম. নুরুজ্জামান (ঢাকা), (২৯) সার্জেন্ট আবদুল জলিল (ঢাকা), (৩০) মোঃ মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী (শ্রীহট্ট), (৩১) ফাষ্ট লেফটেন্যান্ট মোঃ সোলায়মান (যশোহর), (৩২) সুবেদার তাজুল ইসলাম (বরিশাল), (৩৩) মোহাম্মদ আলী রেজা (কুষ্টিয়া), (৩৪) ক্যাপ্টেন খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ (ময়মনসিংহ), (৩৫) ফাষ্ট লেফটেন্যান্ট আবদুর রউফ (ময়মনসিংহ)।
১৯৬৯ সালের ১০ ফেব্রæয়ারি বাদীপক্ষের প্রধান কৌশলী মঞ্জুর কাদের ট্রাইবুন্যালে মামলার সত্যতা সম্পর্কে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। ১৩ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত সাওয়াল জাওয়াব চলে, ১৭ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত মুলতবী করা হয়। ১৫ ফেব্রæয়ারি কুর্মিটোলা সেনা নিবাসে পাকিস্তানি সেনার গুলীতে মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক শহীদ হন। আহত হয় ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক।
মামলার ১নং বিবাদী শেখ মুজিবুর রহমান (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু) ট্রাইবুন্যালে তাঁর নি¤œলিখিত বিবৃতি প্রদান করেন, আমি ছাত্র জীবন থেকে পাকিস্তান হাসিলের জন্য আমি অবিরাম কাজ করে আসছি। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পূর্বে আমি ভারত আর বাংলাদেশের মুসলিমলীগের একজন অত্যন্ত সক্রিয় সদস্য ছিলাম। এমনকি আমার লেখা পড়া ব্রেক করে পাকিস্তান দাবি আদায়ের জন্য কাজ করেছি। পাকিস্তান হওয়ার পর মুসলিম লীগ যখন পাকিস্তানের জনগণের আশা আকাঙ্খার প্রতি বিশ^াসঘাতকতা করে তখন আমরা মরহুম হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ গঠন করি। আওয়ামীলীগ একটি শাসনতন্ত্র সম্মত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৪ সালে আমি প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হই। এরপর আমি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হই। দুই বার আমি মন্ত্রী ছিলাম। গণচীনে প্রেরিত পাকিস্তান পার্লামেন্টারী প্রতিনিধি দলে আমি নেতৃত্ব করি।
জনগণের কল্যাণের জন্য একটি শাসনতন্ত্র সম্মত বিরোধী দল গঠনের জন্য ইতিমধ্যেই আমি কয়েক বছর কারা যন্ত্রনা ভোগ করেছি। দেশে সামরিক আইন জারির পর আমার উপর নির্যাতন শুরু হয়। ১৯৫৮ সালের ১২ অক্টোবর আমাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। বিনা বিচারে আমাকে দেড় বছর আটক রাখা হয়। আটক থাকাকালীন সময়ে আমার বিরুদ্ধে ৬টি ফৌজদারী মামলা দায়ের করে। কিন্তু সবগুলো মামলাতেই আমি সসম্মানে খালাস পাই। ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর ১৯৬০ সালের জানুয়ারি মাসে আমি বন্দী মুক্ত হই। মুক্তির সময় আমার উপর বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়। আমি যদি ঢাকার বাইরে যেতে চাই, তাহলে কোথায় যাচ্ছি, তার বিবরণ দিতে হবে লিখিত ভাবে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চকে। একইভাবে ঢাকায় ফিরে লিখিতভাবে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চকে জানাতে হতো। গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন সার্বক্ষণিক আমাকে অনুসরণ করতো।
১৯৬২ সালে আমার নেতা পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করার পর আমাকে নিরাপত্তা অডিন্যান্স বলে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ৬ মাস আমাকে বিনা বিচারে আটক রাখে। আমার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদীর মৃত্যুর পর পাকিস্তানের উভয় অংশে আওয়ামীলীগ পুনরুজ্জীবিত করা হয়। সম্মিলিত বিরোধীদল গঠন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্ব›িদ্বতার জন্য সম্মিলিত বিরোধী দলের পক্ষে থেকে মোহতারেমা ফাতেমা জিন্নাকে মনোনয়ন করা হয়। আমরা নির্বাচনী প্রচারনা শুরু করি। সরকার বক্তৃতার ভিত্তিতে একাধিক মামলা রুজু করে, আমাকে হয়রানি আর নির্যাতন চালাতে থাকেন।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কালিন সময়ে ১৯৬৫ সালে ভারতীয় হামলার বিরুদ্ধে নিন্দা জানানো নেতাদের আমি অন্যতম ছিলাম। সরকারের যুদ্ধ কর্মকাÐের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানোর আমার দল আওয়ামীলীগ ও আমি জনসাধারণের প্রতি আহবান জানাই। আমার দলের তরফ থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে সব ইউনিটকে জানিয়ে দেওয়া হয় সম্ভাব্য সকল প্রকার যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সরকারকে সাহায্য করার জন্য। যুদ্ধের সময় গভর্নর হাউজে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনে প্রদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সাথে এক যুক্ত বিবৃতিতে আমি ভারতীয় হামলার নিন্দা করি।
যুদ্ধ শেষে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান আসলে তার আমন্ত্রনে অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে আমিও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করি। সাক্ষাতকালে আমি আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসন এর বিষয়ে, প্রদেশকে দেশরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ং সম্পূর্ণ করার জন্য তার নিকট আবেদন করি। যুদ্ধকালিন সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান সহ বিশে^র সহিত পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, আমি তাসখন্দ ঘোষনার প্রতি সমর্থন করি।
আমি আমার দল সবসময় বিশ^ শান্তির পক্ষে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সকল আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধান হওয়া দরকার। পরবর্তীতে সমৃদ্ধির জন্য দরকার বিশ^শান্তি। ১৯৬৬ সালে লাহোর সর্বদলীয় একটি জাতীয় সম্মেলনে আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যার শাসনতান্ত্রিক সমাধানের জন্য ৬ দফা কর্মসুচি পেশ করি। ৬ দফায় আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসনের সুপারিশ করা হয়।
আমার দল আওয়ামীলীগ ৬ দফা কর্মসূচি অনুমোদন করেন। দুই অঞ্চলের বৈষম্য রোধ করার জন্য ৬ দফা কর্মসূচি নিয়ে জনগণের নিকট যাই জনসভা করতে থাকি। প্রেসিডেন্ট সহ সরকারি দলের নেতারা আমাকে অস্ত্রের ভাষায় গৃহযুদ্ধের ভয় দেখায়। দেখান। ১২টি মামলা দায়ের করে আমাকে হয়রানী করতে থাকে। ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে আমাকে যশোর থেকে গ্রেপ্তার করে। খুলনা জনসভা শেষে আমি যশোর হয়ে ঢাকায় ফিরছিলাম। চলবে-

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা সহ-সভাপতি,
জাতীয় শ্রমিক লীগ, কেন্দ্রীয় কমিটি