জটিলতা কেটেছে, ডানা মেলছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

85

এম এ হোসাইন

নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল রেলওয়ের জায়গা। টাইগারপাস এলাকায় ৭০ শতাংশ জায়গা নিয়ে জটিলতা তৈরি হওয়াতে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল। অবশেষে রেলওয়ের জায়গা ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এতে করে এলিভেটেড এক্সেপ্রেসওয়ে নির্মাণে সকল বাধা কেটেছে। ফলে দ্রæততার সাথে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ শেষ করার দিকে এগোচ্ছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ ইতিমধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি সম্পন্ন হয়েছে। বন্দর এলাকার নিমতলা পর্যন্ত কাজ প্রায় শেষ করা আছে। আগ্রাবাদ, দেওয়ানহাট, শেখ মুজিব সড়ক ও টাইগারপাস এলাকায় নির্মাণ কাজ চলমান আছে। তবে টাইগারপাস ওভারব্রিজের পাশের কোনো কাজ করতে পারেনি বাস্তবায়ন সংস্থা সিডিএ। জায়গাটি নিয়ে সিডিএর সাথে রেলওয়ের জটিলতা তৈরি হওয়াতে সেখানে পাইলিং কিংবা মাটি পরীক্ষার মতো প্রাথমিক কাজও করতে পারেনি সংস্থাটি। অবশেষে সেই জটিলতার অবসান ঘটেছে।
রেলওয়ে থেকে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা ৭০ শতাংশ জায়গা নিয়েছে সিডিএ। প্রাথমিকভাবে ১০ বছরের জন্য জায়গাটি ইজারা দেয়া হয়েছে সিডিএকে। এজন্য ৩ কোটি ৪ লাখ ৯২ হাজার টাকায় পরিশোধ করেছে সিডিএ। গত সোমবার সিডিএর সাথে রেলওয়ের একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছে। জায়গাটির উপর দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ ও ল্যান্ডিং পয়েন্ট তৈরি করা হবে। দশ বছর পর আবার জায়গাটির ইজারা নবায়ন করতে হবে সিডিএকে।
সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের নকশাগত বেশকিছু পরিবর্তন হয়েছে। যে কারণে প্রকল্পটির সব প্যাকেজের মধ্যে কিছু কিছু অংশের কাজ সময়মতো শুরু করা সম্ভব হয়নি। পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে কাজ শুরু করে শেষ পর্যায়ে নিয়ে এলেও রেলওয়ের জমি বরাদ্দ পেতে বিলম্ব হওয়ায় প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি পিছিয়ে পড়েছে। রেলওয়ের জমি বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এখন আর কোনো জটিলতা নেই। আমরা আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।
সিডিএ ২০২১ সালের ৪ মে দেওয়ানহাট থেকে টাইগারপাস জংশন পর্যন্ত প্রায় ৭০ শতক জায়গা জমি বরাদ্দের আবেদন করে রেলওয়ের কাছে। একই বছরের ৯ ডিসেম্বর সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে আরো একটি চিঠি দেন। সেই চিঠিতে দেওয়ানহাট-টাইগারপাস অংশে ক্লিয়ার হাইটস নির্মাণের অনুমতি এবং লালখান বাজার মৌজার বিএস দাগের সাতটি অংশে ৬৯ দশমিক ৮২১ শতক জায়গার ওপর দিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের অনুমতি এবং ভূমি অধিগ্রহণ চাওয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত নকশার ওই জমির একটি বড় অংশ রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) এসপি অফিস ও জিআরপি সার্কেল অফিসের জন্য আগেভাগেই বাণিজ্যিক বরাদ্দ দিয়ে রাখে রেলওয়ে। তাছাড়া সিডিএর সর্বনি¤œ সাড়ে ৮ মিটার উচ্চতা রেখে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ করার বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে রেলওয়ে। এরপর গত বছরের ২৩ নভেম্বর সিডিএর সঙ্গে আলোচনায় বসে বাংলাদেশ রেলওয়ে। আলোচনার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হওয়াতে এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ৭০ শতাংশ জমি দিতে রাজি হয় রেলওয়ে। এরপর গত ৬ ফেব্রæয়ারি এ সংক্রান্ত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সাক্ষরের মাধ্যমে জমি বুঝে নেয় সিডিএ।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী বলেন, লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য রেলওয়ে ৭০ শতক জায়গা দীর্ঘমেয়াদি লিজ দিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে। প্রাথমিকভাবে ১০ বছরের লিজ বাবদ ৩ কোটি ৪ লাখ ৯২ হাজার টাকা দেওয়া হবে। ১০ বছর পর সেটি নবায়ন করবে সিডিএ। যে জায়গা সিডিএকে দেওয়া হয়েছে সেখানে কিছু জায়গা রেলওয়ে ব্যবহার করলেও প্রায় পরিত্যক্ত ছিল।
শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটির র‌্যাম্প ও লুপসহ মোট দৈর্ঘ্য হবে ২০ কিলোমিটার। চার লেনের এই এক্সপ্রেসওয়ের প্রশস্ততা হবে ৫৪ ফুট। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ৯টি এলাকায় ২৪টি র‌্যাম্প (গাড়ি ওঠানামার পথ) থাকবে। নগরীর টাইগারপাসে চারটি, আগ্রাবাদে চারটি, বারিক বিল্ডিং মোড়ে দুটি, নিমতলী মোড়ে দুটি, কাস্টমস মোড়ে দুটি, সিইপিজেডে চারটি, কর্ণফুলী ইপিজেডে দুটি, কাঠগড়ে দুটি, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় দুটি র‌্যাম্প থাকবে।
মূল শহর থেকে শাহ আমানত আন্তজার্তিক বিমানবন্দরের যাত্রাপথের দূরত্ব কমাতে সিডিএ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ২০১৭ সালের ১১ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-র‌্যাঙ্কিনকে। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রæয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের পিলার পাইলিং কাজের উদ্বোধন করেন। প্রকল্পের কাজ শুরুর কয়েকমাসের মাথায় নিরাপত্তা এবং পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির আশঙ্কায় আপত্তি তোলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সিডিএকে কাজ বন্ধ রাখার জন্য চিঠিও দেয়া হয়। এরপর আপত্তি তোলে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। এসব বিপত্তি শেষ না হতেই পিডিবির খুঁটি সরাতে গড়িমসি, বৃষ্টিসহ নানা প্রতিবন্ধতা দেখা দেয় প্রকল্প বাস্তবায়নে। তাছাড়া প্রকল্পের শুরু থেকেই আপত্তি ছিল নগর পরিকল্পনাবিদদের। সর্বশেষ রেলওয়ের জায়গা নিয়ে জটিলতায় পড়তে হয় সিডিএকে।
শুরুতে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সালের জুন থেকে বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন করা হয়। তারপর আরও এক বছর বাড়ানো হয়। সবশেষ তা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। একই সাথে এক্সপ্রেসওয়ের অ্যালাইনমেন্ট পরিবর্তন, নতুন করে ভূমি অধিগ্রহণ, টোল প্লাজা নির্মাণ, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনসহ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে কন্ট্রোল টাওয়ার নির্মাণ, বিভিন্ন পয়েন্টে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ, সাউন্ডপ্রæফ ব্যারিয়ার স্থাপন ও বৈদ্যুতিকপুল স্থানান্তরসহ বিভিন ক্ষেত্রে ধারণার চেয়ে খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্প ব্যয় ৩৬ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ১২শ কোটি টাকা খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে।