ছাইভস্মে চাপা ‘স্বপ্নগুলো’

27

বাতাসে পোড়া গন্ধ, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কিছু মানুষ হাতড়ে ফিরছে কিছু; আসলে আগুনে সব গিলে খাওয়ার পর চলছিল ‘উচ্ছিষ্ট’ খোঁজা। আধাপোড়া কিছু পাওয়া গেলে সেসব বিক্রি করে অন্তত দুই-একদিনের খোরাক তো হতে পারে। গত শুক্রবার রাতে পুড়ে যাওয়া মিরপুরের চলন্তিকা বস্তিতে গতকাল শনিবার আরেক দল মানুষেরও দেখা মিলল, যাদের ছাইভস্মে চাপা পড়া স্বপ্নের ‘অবশিষ্টাংশ’ খোঁজারও যেন শক্তি নেই। আগুনে সব হারিয়ে নিঃস্ব তারা।-খবর বিডিনিউজের
শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে মিরপুর-৭ নম্বরে রূপনগর থানার পেছনে চলন্তিকা বস্তিতে লাগা আগুন রাত সাড়ে ১০টার দিকে যখন নিয়ন্ত্রণে আসে, ততক্ষণে বস্তির প্রায় সব ঘরই পুড়ে ছাই।
চলন্তিকা মোড় থেকে রূপনগর আবাসিক এলাকা পর্যন্ত ঝিলের ওপর কাঠের পাটাতন দিয়ে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে গড়ে তোলা বস্তিতে কয়েক হাজার পরিবারের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বসবাস করতেন বলে এলাকাবাসীর ধারণা।
শনিবার চলন্তিকা বস্তিতে দেখা হয় মর্জিনার সঙ্গে। আগামী ১ সেপ্টেম্বর তার বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে। বাবা-মা মেয়ের বিয়ের জন্য ৫০ হাজার টাকা ছাড়াও খাট, আলমারি, শোকেসসহ বিয়ের বিভিন্ন আসবাবপত্র ঘরে এনে রেখেছিলেন। শুক্রবারের আগুন মর্জিনাদের সবই কেড়ে নিয়েছে।
মর্জিনার চিরকশাচালক বাবা মহসিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘প্রথম মেয়ের বিয়ে দিতে অসুস্থ শরীর নিয়া দিনরাত খাইটা এইসব জোগাড় করছিলাম। এখন আমার মেয়ের কি হবে?’
মহসিন জানান, আগুন লাগার সময়ও তিনি রিকশা চালাচ্ছিলেন। খবর পেয়ে বস্তিতে এসে দেখেন সব শেষ। তিনি বলেন, ‘আমি টাকা বাইর কইরা আনতে চাইছিলাম, কিন্তু কাছেই যাইতে পারি নাই।’
আগুনে সর্বস্ব হারিয়েছেন গার্মেন্টকর্মী মরিয়ম বেগমও। কয়েক মাস আগে ছয় লাখ টাকা খরচ করে গড়ে তোলা তার স্বামীর ডেকোরেশনের দোকানটিও ছাই হয়েছে। নিঃস্ব মরিয়ম এখন দুই মেয়ের পড়ালেখা কীভাবে চলবে, সেই চিন্তাতেই অস্থির।
‘ওই ব্যবসা (ডেকোরেশনের) শুরু করতে গিয়া অনেক ধারদেনা হইছে। এখন ওই চিন্তাই সবচেয়ে বড়।’ – বলেন মরিয়ম।
মিরপুরের আরামবাগের ছয় নম্বর রোডের শেষ মাথায় বস্তির কাছে শত শত নারী পুরুষ রাস্তায়, বা খোলা আকাশের নিচে বসে থাকতে দেখা গেছে।
দুপুর সাড়ে ১১টার দিকে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজ্জব হোসেন বস্তিবাসীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেন। অগ্নিকান্ডে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর রজ্জব বলেন, ‘এখনও ক্ষয়ক্ষতির হিসাব চূড়ান্ত করতে পারিনি। আমরা চেষ্টা করছি সরকারের পক্ষ থেকে কী সহযোগিতা তাদের করা যায়।’
চলন্তিকা বস্তির পাশে বঙ্গবন্ধু বিদ্যানিকেতনে শুক্রবার রাতে খোলা হয়েছে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র। আগুনে সর্বস্ব হারানোদের অনেকে সেখানে ঠাঁই নিয়েছেন।
তাদের একজন রোকেয়া বেগম বলেন, ‘আমাদের যাদের যাওনের কোনো জায়গা নাই, এইখানে ঠাঁই পাইসি। রাইতে এইখানে জায়গা না পাইলে রাস্তায় থাকতে হইত।’
বস্তিতে আগুন লাগার পরপরই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ১০ হাজার লিটার ধারণক্ষম ১০টি পানির ট্যাংকে এক লাখ লিটার পানি সরবরাহ করে। পাশাপাশি একটি টাওয়ার লাইট এবং মেডিকেল টিম নিয়োজিত হয়। শনিবার সকাল থেকে সেখানে অস্থায়ী বাসস্থান, খাবার ও ভ্রাম্যমাণ শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়।
মেয়র আতিকুল ইসলাম বেলা ২টার দিকে ওই আশ্রয়কেন্দ্রে আসেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ডিএনসিসির বিভিন্ন ধরনের সেবা পরিদর্শন করেন। এছাড়া ডিএনসিসির স্বাস্থ্য ক্যাম্পে গিয়ে ডাক্তার, নার্স ও রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন।
অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ডিএনসিসি আরামবাগ মাঠে প্যান্ডেল করে রান্না ও খাবারের বন্দোবস্ত করেছে। মেয়র সে এলাকাও পরিদর্শন করেন। পরে তিনি বলেন, ‘যদি ফায়ার হাইড্রেন্ট বসিয়ে দিতে পারতাম, তাহলে বস্তিবাসীরাই আগুন নিভিয়ে ফেলতে পারত। যদি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা লাগে, তা সিটি করপোরেশন অবশ্যই করবে। ক্ষতিগ্রস্তদের খাবার আমরা তিন বেলাই চালিয়ে যাব। কাজ করব কালেকটিভ ওয়েতে।’
অগ্নিকান্ডের কারণ অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তারা প্রতিবেদন দেবে। আজ পুরো বস্তিকে বিভিন্ন জোনে ভাগ করে হাউজ টু হাউজ তল্লাশি করা হয়েছে। আমরা কোনো মৃতদেহ পাইনি।’
নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি ফখরুলের : শনিবার দুপুর ১টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেখানে তিনি বলেন, অতীতেও মিরপুরে এমন ঘটনা ঘটেছে। এ অগ্নিকান্ডের পেছনে কোনো ব্যক্তি জড়িত কিনা, তা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে দেখতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।