চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তথ্য নেই কোনো সংস্থার কাছে

25

এম এ হোসাইন

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অনেক ভবন। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে ভবন হেলে পড়া থেকে ভেঙে পড়ার মতো ঘটনা ঘটছে। ভবনের ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনীয়তা আছে কি-না না জেনেই সেখানে বসবাস করছে লোকজন। সর্বশেষ ১৩ বছর আগে ৫৭টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করেছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এসব ভবন ভেঙে ফেলার জন্য তখন সিটি কর্পোরেশনকে অনুরোধ জানায় সিডিএ। কিন্তু এত বছরে মাত্র তিনটি ভবন অপসারণ করা হয়েছে। যদিও কয়েকটি ভবন মালিকপক্ষ নিজেরাই অপসারণ করে নিয়েছে। তবে তার কোনো সঠিক হিসাব নেই কোনো সংস্থার কাছে।
ভূমিকম্প হলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে আলোচনা হয়। সংস্থাগুলোও বাড়ায় তৎপরতা। তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ কোনো সংস্থা নিতে পারে না। নগরীতে এ মুহূর্তে চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন কতটি সেটাও জানা নেই কোনো সংস্থার। সবশের্ষ ২০০৭ সালে ৫৭টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে সিডিএ। চলতিবছরে এনায়েত বাজারে আরো একটি ভবনকে চিহ্নিত করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা অনেক বেশি। তাছাড়া ভূমিকম্প সহনীয় নয় এমন ভবনের প্রকৃত সংখ্যা জানা প্রয়োজন। ভূমিকম্প সহনীয়তা না থাকলে ঝুঁকির মাত্রা বহুগুণে বাড়তে পারে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কক্সবাজার ট্যুরিজম সিটি আর চট্টগ্রামের পুরাতন ভবনগুলো ঝুঁকিতে আছে। এগুলোর এসেজম্যান্ট করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা হালনাগাদ করা এবং দ্রুত ভবনগুলো ভেঙে ফেলা দরকার। তাছাড়া নগরের প্রতিটি ভবন পরীক্ষা করে দেখতে হবে, এগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধী কি না। তারপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে ৮ দশমিক ৫ মাত্রা ভূমিকম্প হলে চট্টগ্রামের অধিকাংশ ভবন কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় ২০০৭ সালে তৈরি করা সিডিএ’র তালিকা অনুযায়ী, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মধ্যে আবাসিক ভবন ৩৫টি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি, আবাসিক ও বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এমন ভবন ১২টি এবং শুধু বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এমন ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে ৯টি। এর মধ্যে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নগরের লালদীঘি এলাকার তিনটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙা হয়। তিনটি ভবনই বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হতো। সিটি কর্পোরেশন ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণে সর্বশেষ অভিযান চালায় ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে। তারপর থেকে এই অভিযান বন্ধ রয়েছে। পর্যাপ্ত জনবল, যন্ত্রপাতি ও অর্থ সংকটের কারণে ভবনগুলো অপসারণ করা যাচ্ছে না বলে জানায় সিটি কর্পোরেশন। তবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো অপসারণের জন্য মালিকদের বারবার নোটিশ দেয় সিটি কর্পোরেশন। তাছাড়া ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও সচেতনতা কমিটির সভায় বিশেষ রঙ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে সেগুলোতে ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন’ লেখা সম্বলিত সাইনবোর্ড স্থাপন এবং বিল্ডিং কোড হালনাগাদ করে তা বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থান নিতে সিটি কর্পোরেশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী চসিক চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে সাইনবোর্ড স্থাপন করেছিল। তবে অল্পদিনেই উধাও হয়ে গেছে সাইনবোর্ডগুলো। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে ঝুঁকির কথা না জেনেই বসবাস করছেন সাধারণ মানুষ।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, আমরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করি আর এটা ভাঙা বা অপসারণের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। আমরা ৫৭টি ভবনের একটা তালিকা কর্পোরেশনে পাঠিয়েছিলাম। পরবর্তিতে এবছর এনায়েত বাজারে আরেকটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়। সে ভবনটি ভাঙার জন্য মালিক পক্ষ পদক্ষেপ নিয়েছে। নতুন করে ভূমিকম্পে যে দুটি ভবন হেলে পড়েছে সেগুলো পরীক্ষার জন্য আমরা চিঠি দিব। পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের চেয়ে বেশি ভবন আছে স্বীকার করে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, দুইভাবে আমরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করি। শতবছরের বা তার কাছাকাছি ভবনগুলো পরীক্ষার মাধ্যমে আর অন্যটি হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগে হেল পড়লে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে। সর্বশেষ তালিকা করার পর মাঠ পর্যায়ে ভবনগুলোর অবস্থা নির্ণয়ের মতো লোকবল আমাদের নেই। ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এখানে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় আছে, এব্যাপারে তারা উদ্যোগী হয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে।
এদিকে প্রায়শই ছোট-বড় ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে চট্টগ্রাম নগর। এতে বড় কোনো দুর্ঘটনার খবর পাওয়া না গেলেও ভবন হেলে পড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সর্বশেষ শুক্রবার ভোরে রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে চট্টগ্রাম। এই ভূমিকম্পে চান্দগাঁও, চকবাজার, হালিশহরে তিনটি ভবন হেলে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। গতকাল শনিবার বিকালে আবার ভূমিকম্পে কাঁপে চট্টগ্রাম। বিকাল ৩টা ৪৭ মিনিটে ৪ দশমিক ২ মাত্রার এ ভূমিকম্পটি আঘাত হানে।
চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে সিডিএ। তাদের একটি কমিটি আছে, সেখানে বিশেষজ্ঞরা মিলে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে জানালে আমরা এ বিষয়ে উদ্যোগ নেই।
এদিকে চসিক-সিডিএ’র কাছে নগরীর প্রকৃত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কোনো তালিকা না থাকলেও চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের ১ লাখ ৮২ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার ভবনই ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ বিষয়ক ২০১৫ সালের অন্য একটি পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়, যদি ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তবে চট্টগ্রাম শহরের ১৮২ হাজার বিল্ডিং, ১৬২ হাসপাতাল ভেঙ্গে যাবে। এতে ১৭ মিলিয়ন টন আবর্জনা তৈরি হবে যা সরাতে ৬ লক্ষ ৮০ হাজার ট্রাকের ট্রিপ প্রয়োজন হবে। শহরের ১০৩৩ স্কুলের মধ্যে ৭৩৯ বিল্ডিং পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। চট্টগ্রামে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে। যার মধ্যে ৭৩ হাজার থাকবে স্কুলের শিক্ষার্থী।