চট্টগ্রামের হালদা নদীর কান্না

19

নজরুল করিম চৌধুরী

এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা। এ হালদার উৎপত্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ি গ্রাম সালদা। সালদার পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে নেমে আসা সালদা থেকে হালদা নামকরণ। এ নদীর ফটিকছড়ি উপজেলার মধ্যদিয়ে রাউজান, হাটহাজারী উপজেলা অতিক্রম করে কালুরঘাট নামক স্থানে কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে মিশে গেছে। হালদা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৫ কিলোমিটার। হালদা নদীর পানির উৎস হচ্ছে মানিকছড়ি, ধুরুং, বারমাসিয়া, মন্দাকিনী, লেলাং, বোয়ালিয়া, চানখালী, সর্ত্তা, কাগতিয়া, সোনাইখাল, পারাখালী ও কাটাখালী খালসহ বেশকিছু ছোট ছড়া। মোটর গাড়ির প্রচলনের পূর্বে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে রাউজান, হাটহাজারী, ফটিকছড়ির লোকের চলাচল ও মালমাল আনা নেওয়ার একমাত্র পথ ছিল এই হালদা নদী। তখন হালদা ২৫ থেকে ৩০ ফুট ক্ষেত্র বিশেষে ৪০ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত গভীর ছিল।
স্টিমারও চলাচল করত চট্টগ্রাম শহর থেকে সাত্তারঘাট এমনকি নাজিরহাট পর্যন্ত। উভয়তীরের সমৃদ্ধ জনপথ হলো নাজিরহাট, সাত্তারহাট, আজিম্যা ঘাট, বৈদ্যেরহাট, রামদাশ মুন্সীরহাট, বড় আলী চৌধুরী হাট, মদুনাঘাট ইত্যাদি। হালদা ছিল এসব এলাকার অধিবাসীদের জন্য এক অফুরন্ত মৎস্য খনি। যাার আশপাশে ডিম সংগ্রহকারী পরিবারের বাস। এখান থেকে রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ প্রভৃতি কার্প জাতীয় মাছের সরাসরি ডিম সংগ্রহ করা হয়। অপার জীববৈচিত্র্য ও মৎস্যসম্পদে ভরপুর এ নদী জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখলেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে তা আজ ধ্বংস হতে চলেছে। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার হালদা নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রকল্প গ্রহণ করলে বছরে শত শত কোটি টাকা আয় করা যাবে। পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহ হবে হালদার দু’পাড়ের রাউজান, হাটহাজারী ও ফটিকছড়ির লক্ষাধিক বাসিন্দার।
হালদার ডিম একটি পরিসংখ্যান : হালদায় হাজার হাজার কেজি ডিম দেওয়ার সেই ইতিহাস এখন কেবলই অতীত। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৪৬ সালে সর্বোচ্চ ৪ হাজার কেজি ডিম দেওয়া হালদা নদী ২০০৪ সালে ডিম দিয়েছে মাত্র ০২ কেজি। সাম্প্রতিক কয়েকটি বছরে হালদায় প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য ডিমের পরিমাণ ১৯৯৭ সালে ০৩ শ কেজি ২০০৫ সালের ১শ ৫০ কেজি ২০০৭ সালে ৩শ ৫০ কেজি ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি ২০১৮ সালে ১ হাজার ৮০০ কেজি এবং ২০২০ সালে ৩ হাজার ৩০০ কেজি। মৎস্য বিশেষজ্ঞদেও মতে, ডিম ছাড়ার উপযোগী প্রতিটি মাছের ওজর সর্বনি¤œ পাঁচ কেজি থেকে সর্বোচ্চ এক মনও হয়। এসব মাছ ডিম দেয় একবারে ৫ লক্ষ থেকে ৪০ লক্ষ পর্যন্ত।
ডিম কমে যাওয়ার কারণ কি : পঞ্চাশ দশকে দেশের মোট চাহিদার ৭০ ভাগেরও বেশি পোনার চাহিদা পূরণ করত হালদা। বলাবাহুল্য এখন তার সিকিভাগও মেলে না, মা মাছ শিকার, হালদা নদীর ৪টি বাঁক কেটে ফেলা, অপরিকল্পিতভাবে সুইচগেইট নির্মাণ এবং হালদা সংলগ্ন এলাকায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে শিল্প, কারখানা গড়ে উঠাকে হালদায় মাছেল ডিম কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। মৎস্য বিজ্ঞানিদের মতে, হালদার অক্রবো বাঁকগুলোতে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে। বাঁকের পানি ওলট-পালটের মাধ্যমে মা মাছের সঙ্গে পুরুষ মাছের শুক্রাণু ভালোভাবে মিশ্রণ হয়। কিন্তু বাঁক কেটে নদীর ¯্রােত বৃদ্ধি পাওয়ায় মা মাছেল নিরাপদ প্রজননস্থল ধ্বংসের পাশাপাশি ডিম সংগ্রহের অসুবিধা দেখা দিয়েছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত হাটহাজারী, রাঙ্গামাটি সড়ক সংলগ্ন সাত্তারঘাট এবং চট্টগ্রাম কাপ্তাই সড়কের মদুনাঘাটের মধ্যবর্তী স্থানে ৪টি বড় ধরনের বাঁক কেটে দেয়া হয়। প্রথম বাঁক ১৯৪৭ সালে হাটহাজারী বাড়িঘোনা এলাকায় দ্বিতীয় বাঁক ১৯৬১-৬২ সালে রাউজানের অঙ্কুরীঘোনা। এভাবে ক্রমান্বয়ে কেটে দেওয়া হয় ডিম ছাড়ার নিরাপদ স্থান সোনাইরখাল মুখ বাঁধ ও গড়দুয়ারা বাঁক। ফলে এসব এলাকায় মাছের ডিম ছাড়া দ্রæত কমে যায়।
ডিম আহরণে সনাতনীপন্থা : হালদা থেকে বর্তমানে যারা ডিম ধরে তারা রেণু ফোটায় প্রাচীন পদ্ধতিতে। এ পদ্ধতিতে মাটির কুয়াতে মৎস্যজীবীরা নদীর ঘোলা পানিতে (যাতে জীবাণু এবং অন্যান্য রাক্ষুসে ও বিরক্তিকর প্রাণী থাকে) ডিম ফুটিয়ে রেণু বের করে। এতে তাদের অর্ধেক ডিম নষ্ট হয়ে যায়। রেণু ফোটানোর পরে ৪ দিন এই রেণুগুলোকে এক কুয়া থেকে অন্য কুয়াতে সুতি কাপড়ে নদীর পানি দিয়ে স্থানান্তর করা হয়। এই খোলা পানিতে স্থানান্তরের সময় অনেক রেণু মারা যায়। আবার নদীর পাড়ের মাটির কুয়া বানাতে গিয়ে অনেক জমি নষ্ট এবং নদী ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়।
একটি মা মাছ একটি মেগা ইন্ডাস্ট্রি : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া একটি পরিসংখ্যানের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে একটি মা মাছে তিন বছর বয়স থেকে পরিপক্কতা লাভ করে অর্থাৎ ডিম দেওয়া শুরু করে। একটি কাতলা মাছ একবার ডিম দেয় (৫ থেকে ২০ কেজি ওজনের) ১৫ লাখ থেকে ৩৫ লাখ। প্রতিটি কাতাল মা মাছ বছরে ৪ ধাপে আয় দেয়। যথা : ডিম থেকে রেণু পোনা বা ঐধঃপযযষরহ বিক্রয় কওে (৪ দিন বয়সের) ধানী পোকা বা ঋৎ বিক্রয় করে (২০-২৫ দিন বয়সের) আঙলি পোনা বা ভরহমবৎষরহম বিক্রয় করে (১-২ মাস বয়সের) এবং এক বছর বয়সে মাছ বা ভড়ড়ফ ভরংয হিসাবে বাজারজাত করে। উক্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী জাতীয় অর্থনীতিতে একটি কাতাল মা মাছ এর অবদান দাঁড়ায় বছরে ৩ কোটি ৩৮ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। এই হিসাবে হালদার একটি মা মাছকে একটি প্রাকৃতিক মেগা ইন্ডাস্ট্রি হিসাবে উল্লেখ করেন অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া।
প্রাকৃতিক মেঘা ইন্ডাস্ট্রি আজ হুমকির মুখে : বিপর্যস্ত হালদা নদী রক্ষায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনজুরুল কিবলিয়া স্যারের ১১ সুপারিশ ও পরামর্শের সাথে আমিও একমত। সুপারিশগুলো হলো হাটহাজারী নদীর হাটের স্থানীয় মরাছড়া খালের বর্জ্য ডাম্পিং স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে। বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠা পোল্ট্রি খামারগুলোর দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। অনন্যা আবাসিক এলাকায় ভরাট হয়ে যাওয়া বামনশাহী খাল পুনঃখনন। শিকারপুর ও মাদার্শা এলাকার ছোট খাল ছড়াগুলো খননের মাধ্যমে পানির প্রবাহ বাধামুক্ত করা। অবিলম্বে হালদা নদীকে পরিবেশগত বিপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা, হালদা নদী ব্যবস্থাপনা সমন্বয় সাধনের জন্য হালদা নদী কমিশন গঠন এবং হালদাকে জাতীয় নদী ঘোষণার মাধ্যমে এই নদী রক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ, জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট ধ্বংসাত্মক কর্মকাÐে আজ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হালদা নদী, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে এই পর্যন্ত মোট ৩৮টি ডলফিনের মৃত্যু ২৫টি ব্রæড কাতাল মাছ মৃত্যু হয়েছে বলে হালদা গবেষকরা জানান। এই ভাবে বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্যা মা মাছ মারা যাচ্ছে কয়েক দিন পরপর।
এভাবে মাছের মরণ হলে দেশের অর্থনৈতিক ও মৎস্য খাতে মহাসংকট দেখা দিবে। তবে বিশেষজ্ঞ মহল বলছে, এই হালদা নদীর মা মাছ রক্ষার্থে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ এলাকার স্থানীয় সাধারণ মানুষ, স্থানীয় প্রশাসন যৌথভাবে হালদা নদীর ওপর নজর দিলে এই হালদার মাছ রক্ষা করা সম্ভব হবলে মনে করেন। হালদা নদীর ওপর মানুষের নানান নির্যাতনের কারণে মা মাছ সময় মতো ডিম দিতেও পারছে না। দেশীয় মাছের প্রাকৃতিক বীজ ভান্ডার হালদা বিশ্বের একমাত্র স্রোতস্বিনী নদী। হালদার মতো বিশ্বের আর কোনও নদীতে ডিম আহরণের নজির নেই। আছে শুধু পোনা আহরণের। তাই অপার সম্ভাবনাময় এ নদীকে ঘিরে সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলে জাতীয় অর্থনীতিতে কোটি টাকা আয়ের পাশাপাশি বিশাল একটি জনগোষ্ঠির বেকারত্ব লাঘব হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাবেক ব্যাংক নির্বাহী