ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ প্রয়োজন

9

মুহাম্মদ মুসা খান

(১) টিআইবি গত ৩১ আগস্ট একটি জরিপের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হচ্ছে, সেবা খাতে দুর্নীতির শিকার হচ্ছে প্রায় ৭১ শতাংশ পরিবার (খানা)। এই রিপোর্ট ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট এক বছরের। আরও মজার তথ্য আছে জরিপে, বলা হয়েছে ৭২ দশমিক ১ শতাংশ মনে করেন ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না। অর্থাৎ আমাদের দেশের ৪ ভাগের ৩ ভাগ মানুষ মনে করেন ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না।
একটু লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে, যে পরিবারে ঘুষ খাওয়ার লোক আছে , সেই পরিবারের অভিভাবককে প্রশ্ন করলে জানা যাবে যে, ঘুষ খাওয়া নিয়ে তাঁদের কোনো অভিযোগ নাই। কারণ চাকরি পেতে তাঁদের প্রায় অনেককে মোটা অঙ্কের টাকা এককালীন ঘুষ দিতে হয়েছে, এখন ঘুষ না খেলে সেটা উঠবে কী করে! (অবশ্য বিসিএস-এ এখনও স্বচ্ছতার সাথে নিয়োগ দেয়া হয়, তবুও অনেকে পথভ্রষ্ট হয়)। এ যেন দেশে ঘুষের দুষ্টচক্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বুঝা যাচ্ছে ঘুষ একবারেই ‘মামুলি ঘটনা’ আমাদের দেশে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি গত রমজানে এমনও দেখেছি, সেবাদানকারি এক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ঘুষের টাকা পকেটে নিয়ে আমার সাথেই যোহরের নামাজ আদায় করেছেন। ঘুষ এতই মামুলি যে ৩১ আগস্ট রিপোর্টটির খবর পত্রিকায় প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই বলছেন, দুর্নীতির শিকার পরিবারের সংখ্যা ৭১ শতাংশ নয়, বাস্তবে এটি আরও অনেক বেশি হবে।
যে খাতগুলোর ওপর টিআইবির জরিপে দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে সেগুলো হলো, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমিসেবা, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, আইনশৃঙ্খলা সংস্থাসহ মোট ১৭টি সেবা খাত। এই সেবাগুলো এত দরকারি যে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের এই সেবা গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়ে। এগুলো অত্যাবশ্যকীয়। আসলে এগুলোই সবচেয়ে দুর্নীতিমুক্ত খাত হওয়ার কথা ছিল।
আমরা জানি, সরকারের পক্ষ থেকে টিআইবির এই রিপোর্টকে ‘সঠিক নয়’ বলেই ধরে নেয়া হবে। কারণ অতীতেও টিআইবির রিপোর্টকে মিথ্যা বলা হয়েছে। আমরা মনে করি, টিআইবির রিপোর্ট পুরোপুরি সঠিক না হলেও একেবারে মিথ্যাও নয়। (তবে প্রত্যেক সেবাখাত বা বিভাগে সৎ মানুষ এখনও অল্প সংখ্যক হলেও আছে। যারা ঘুষ না নিয়ে সেবাদান করেন। ব্যক্তিগত ভাবে আমি অনেকজনকেই জানি, যারা ঘুষ গ্রহণ করেন না এবং ঘুষ খাওয়াকে নিকৃষ্ট কাজ মনে করেন)। স্মরনযোগ্য যে, দুই বছর আগে (১৮ আগস্ট’২০) স্বাস্থ্যখাতের ঠিকাদার মিঠুর বিভিন্ন দূর্নীতি নিয়ে নিউজ টুয়েন্টি ফোর টেলিভিশনের সচিত্র রিপোর্ট ও।মাছরাংগা টিভির প্রতিবেদন- আমাদেরকের হতবাক করে দিলেও অপরাধী চক্রের কিছু হয়নি। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় স্বাস্থ্যখাতের সীমাহীন দুর্নীতির বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। মূলত বেপরোয়া এই দুর্নীতিবাজরা করোনা সংকটেও দুই নম্বর এন ৯৫ মাস্ক ও পিপিই সরবরাহ দিয়ে ডাক্তারদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল।
(২) করোনা সংকটে টেস্ট কেলেংকারীর সাহেদ, জেকেজি হেলথ, সাহাবুদ্দিন মেডিকেল, দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারচক্র বা ক্যাসিনো হোতাদের কর্মকাÐ, পরিবহন সেক্টরের চাঁদাবাজি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বালিশ কেলেঙ্কারি, কয়লা কেলেঙ্কারি, বিআরটিএ, পাসপোর্ট অধিদফতরসহ বিভিন্ন খাতের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে একটু চিন্তা করলে সহজে বুঝা যাবে যে, একশ্রেণির প্রতারক-অপরাধীদের দাপটে গোটা দেশ যেন অসহায়। অথচ ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন দেশকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে। কিন্তু তাঁর অর্জনগুলো ধরে রাখা সম্ভব হবে না, যদি অপরাধীদের লাগাম টানা না যায়। হাঁ, একথা সঠিক যে, অপরাধ আগেও ছিল। বিএনপি বা এরশাদের আমলেও অপরাধ-প্রতারণা ছিল, এখনও আছে। তাছাড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে অপরাধের রেকর্ডও বেশি। তাই বলে কি অপরাধ চলতেই থাকবে! এর লাগাম টানা কি অসম্ভব! এসব অপরাধীরা ক্রমাগত অপরাধ করার এমন সাহস-শক্তিই বা কোথা থেকে পান!
(৪) আমরা লক্ষ্য করেছি যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বড় বড় অপরাধীরা অপরাধ করার জন্য ‘রাজনীতিকে’ ব্যবহার করছেন (জানিনা আমাদের রাজনৈতিক নেতারা তা লক্ষ্য করেছেন কিনা!) করোনা সংকটের আলোচিত সাহেদও রাজনীতিকে অপরাধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন (অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় নাই, একথা যথার্থ নয়)। অথচ তিনি ছিলেন মাত্র এসএসসি পাশ। ‘রাজনীতির সীল’ গায়ে লাগার পরই তিনি হয়ে গেলেন ‘মহাক্ষমতাধর’ একজন। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায় তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল। বড় বড় সব নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে তাঁর ছবি। তাঁর ডাক পরে টিভি টকশো’তে। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের জ্ঞান (?) দেন। জি কে শামীম, মেজর তারেক, ক্যাসিনো হোতা- সবার ব্যাকগ্রাউন্ড যদি খুঁজতে যান, সবখানেই ‘রাজনীতি’র কানেকশন পাওয়া যাবে (এর জন্য রাজনীতি বা মূল নেতৃত্বকে হয়তো দায়ী করা যাবে না)। আবার দুর্নীতি/টেন্ডারবাজির পেছনেও দেখা যায়- দুর্নীতিবাজরা রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়েছেন। যা হয়তো অনেকেই জানেন।
(৫) প্রশ্ন আসতে পারে, রাজনীতিকে কেন অপরাধীরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে? এর উত্তর খুবই সিম্পল। কালক্রমে আমাদের দেশে ‘রাজনীতি’ প্রায় সব কিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে গেছে। এ কারণে ‘আইন ও নিয়ম-নীতি’কে ক্ষেত্র বিশেষে অনেকের অগোচরেই গৌণ করে ফেলা হয়। এই সংস্কৃতি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্তরায়- এটা থিওরি( মনগড়া কথা নয়)। আমরা যদি রাজনৈতিক দার্শনিকদের থিওরি বিশ্লেষণ করি তাহলে বুঝা যাবে যে, রাজনীতি কোন কালেই ‘সাংবিধানিক আইনের’ চেয়ে ‘বেশি গুরুত্বের’ স্থানে ছিল না। প্লেটো-এরিস্টটল হতে শুরু করে আধুনিক রাজনীতি বিজ্ঞানীরাও সাংবিধানিক আইনকেই সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। কারন ‘আইন হলো সভ্যতার প্রতীক’। শুধুমাত্র ‘ম্যাকিয়াভেলি’ রাজনীতিতে সফলতার জন্য ‘ধূর্ততার’ আশ্রয় নিতে বলেছিলেন (যা সমালোচিত ছিল সর্বকালেই)। আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে কখন থেকে যে- ‘প্রভাব’ ও ‘তদবির’ শব্দ দুটি মিশে গেছে, সেটা হয়তো আমরা কেউ খেয়ালই করিনি। আজ অপরাধীরা নিজের পরিচয় দেয়ার পূর্বেই বলেন, ‘আমি অমুক দলের অমুক পদে আছি’। আর এই পরিচয় পেয়েই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পর্যন্ত একটু হলেও চিন্তিত হয়ে পড়েন। (এই দৃশ্য হিন্দি-তামিল ফিল্মে অহরহ দেখা যায়)।
(৬) উন্নত দেশ সমূহে এসব রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি দেখা যায় না। সেখানে রাজনৈতিক নেতারা প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করতে চান না। সেসব দেশেও অপরাধ হয়, কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব না থাকার কারনে অপরাধ করে কেউ রেহাই পায় না। অপরাধ করলেই শাস্তি পেতেই হবে। আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলে। উন্নত দেশের উদাহরণ দেখে আমাদেরকেও সব ক্ষেত্রে ‘রাজনৈতিক দাপট’ দেখানো মানুষদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এক সময় ছিল মানুষ রাজনৈতিক নেতাদের শ্রদ্ধা করতেন। কারন নেতারা নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বাদ দিয়ে জনগণের সুখের জন্য রাজনীতি করতেন। বঙ্গবন্ধুও সবসময় জনগণের কথা চিন্তা করে দূর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। আর এখন অনেকেই নিজের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি স্ত্রী-পুত্রের, এমন কি নাতি-পুতিদের সুখের কথাও মাথায় রেখে সম্পদ আহরণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। ফলে জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সাথে। দেখা গেছে, অপরাধে জড়ানোর আরেকটি অন্যতম কারন হলো ‘সম্পদ অর্জনের নেশা’ বা লোভ। অথচ মৃত্যুর সময় একটি টাকাও কেউ সাথে নিতে পারেন না। আর যে বংশধরের জন্য সম্পদ রেখে যান, তাঁরা মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তির জন্য দোয়া-আশীর্বাদ টুকুও করেন না। তাছাড়া আমাদের দেশের আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অনেক সময় অপরাধী পার পেয়ে যায়, যা অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারন। এখনও অনেক অপরাধী জামিন নিয়ে জেলের বাইরে অবস্থান করছে। তাই আজ সময় এসেছে অপরাধের ‘মূল’ খুঁজে বের করা। এবং সে মূল উৎপাটন করা।
(৭) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্বক্ষণিক দেশের মংগল চিন্তা করেন, এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত নাই। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় ভুল মানুষ দায়িত্ব পেয়ে যাওয়ায় তাঁর ‘শুভ চিন্তা’- ‘ভালো কাজ’ বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে, দেশের অর্জন গুলো দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না। একথা স্বীকার্য যে, দুর্নীতি নামক এক মহাব্যাধি আজ দেশের অগ্রগতিতে চরম অন্তরায়। এই দুর্নীতির সাথে জড়িত আছেন কিছু মুখোশ পড়া অপরাধী, যারা ‘রাজনীতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন’। এসব মুখোশধারীদের খুঁজে বের করা কঠিন নয়। প্রতারক-অপরাধী চিহ্নিত করার জন্য আমাদের গোয়েন্দাদের স্পেশাল কিছু দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। তাঁদের কাছ থেকে তালিকা পাওয়ার পর চালাতে হবে শুদ্ধি অভিযান (এখনও হচ্ছে)। তাছাড়া আইন করতে হবে যে, সরকারের কোন মন্ত্রী-এমপি এবং তাঁদের সন্তান সরকারের কোন বিভাগের সাথে কোন প্রকার ব্যবসা করতে পারবেন না। যদি ব্যবসা করতে চান, তাহলে তাঁকে মন্ত্রী-এমপি হতে পদত্যাগ করেই ব্যবসা করতে হবে। তাহলেই রাজনীতির প্রভাব কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি করা সম্ভব হবে না। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবেন, মন্ত্রী-এমপিরা দেশ চালাবেন। মোটকথা হলো, দেশকে অপরাধ-দূর্নীতি ও সন্ত্রাস মুক্ত করার অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। এই অভিযানকে সামাজিক ‘আন্দোলনে’ পরিণত করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের সামাজিক ভাবে বয়কট করতে হবে। বড় দায়িত্বের জন্য সঠিক ও সৎ লোক নির্বাচন করতে হবে। জননেত্রী শেখ হাসিনা এই কাজ করতে পারবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। তিনি যদি শক্ত হাতে এসব অনিয়ম দমনের কর্মসূচি হাতে নেন, তাহলে দেশের অধিকাংশ মানুষের সমর্থন পাবেন। আর এটা করা গেলেই অর্জিত সাফল্য সমূহ স্থায়িত্ব লাভ করবে।
লেখক: কলামিস্ট ও সমাজকর্মী