গ্রামীণ সংস্কৃতির বাতাবরণে রামুর বর্ষবরণ আয়োজন

5

সুপ্রতিম বড়ুয়া

নববর্ষ উৎসবে এসেছে এখন নতুনত্ব। প্রথম দিনে একে অন্যকে বার্তা পাঠান। আদান-প্রদান হয় নানা ধরনের শুভেচ্ছা কার্ড। জাপানিরা তাদের ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে আসছেন প্রাচীনকাল থেকে। বাঙালিরা তাই করে। রাত বারোটার ঘণ্টা বাজতেই সবাই রাস্তায় চলে আসেন। হৈ-হুল্লোড় করে কাটিয়ে পার করেন রাতটি। হোটেলগুলোয় হয় নাচ-গানের আয়োজন। এ রাতের খাবারও হয় আলাদা। প্রিয়জনদের সঙ্গে সবাই চলে যান দর্শনীয় স্থানে। সেখানে বসেই তারা উদযাপন করেন নতুন বর্ষের প্রথম দিন। আতশবাজির শব্দ আর গানের তালে যেন দুলতে থাকে দুনিয়া। আর সবার মুখে থাকে একটাই কথা শুভ নববর্ষ বা হ্যাপী নিউ ইয়ার। একই আদলে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা আর বর্ণাঢ্য আয়োজনে কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলায় উদযাপিত হয়ে গেল ব্যতিক্রমী বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। বাঙালির সবচেয়ে বড় সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে নাচে গানে আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে বরণ করেছে রামুবাসিরা। রামুবাসিদের জন্য এবারের পহেলা বৈশাখের আয়োজন যেন অন্যরকম আবহ। ঈদের ছুটির পরপরই পহেলা বৈশাখ। আর তাই সরকারি বেসকারি চাকরিজীবী, পেশাজীবীরা ছুটি পেয়ে ঈদের পাশাপাশি বৈশাখ উদযাপন করছেন। ঈদের পরপরই পহেলা বৈশাখ হওয়ায় এবার পহেলা বৈশাখের দিনটি একটু বেশিই ব্যতিক্রম। রামু সাংস্কৃতিককর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান যেনো পরিণত হয় রামুবাসির মিলন মেলায়। অনুষ্ঠানের শুরুতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণে বর্ণিল আনন্দ শোভাযাত্রা বের করা হয়। এবারের শোভাযাত্রায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর পাশাপাশি স্কুল-কলেজের নান্দনিক উপস্থিতি সবাইকে মুগ্ধ করে তোলে। বর্ণাঢ্য এই শোভাযাত্রাটি রামু চৌমুহনী হয়ে অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে এসে শেষ হয়। পরে সেখানে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ও বৈশাখী অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন মাননীয় সাংসদ সাইমুম সরোয়ার কমল। সংক্ষিপ্ত উদ্বোধনী পর্বের পর রামুর প্রসিদ্ধ সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর আয়োজনে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। উল্লেখ্য প্রত্যেকটি আয়োজন ছিল গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য কে তুলে ধরার একটা অনন্য প্রয়াস। রামুর সাংস্কৃতিককর্মীরা সবসময় নববর্ষে আয়োজন ব্যতিক্রমী করে থাকে এবারও তাদের ব্যত্যয় ঘটেনি। তাদের আয়োজনটার পুরোপুরিই গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সচিত্র লক্ষ্য করার মতো। অন্যদিকে বৈশাখী মেলাকে ঘিরে রামু এলাকায় বসে হরেক রকম পণ্যের দোকান। এসব দোকানগুলোতে মাটির তৈরি খেলনাসহ লোকজ সংস্কৃতির হরেক রকম পণ্য দেখা গেছে। সকাল থেকেই বৈশাখী মেলায় যেনো মানুষের ঢল নামে। গ্রামাঞ্চল থেকে বিভিন্ন যানবাহনে করেও আনন্দপ্রিয় মানুষদের ছুটে আসতে দেখা যায় সার্বজনীন এ উৎসবে। পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে সমগ্র রামুতে পরিণত হয় উৎসবের নগরীতে। আর তাই যে কোনো অনাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে গ্রাম জুড়েই ছিলো ব্যাপক নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি। বৈশাখ উদযাপন করতে আসা একজন দর্শক বলেন, বৈশাখ আমাদের প্রাণের উৎসব। বছরের এই দিনটি আমরা খুব উৎসাহ-উদ্দীপনায় পালন করি। বান্ধবিদের নিয়ে বৈশাখীর সাজে মেলায় এসেছি। এখানে এসে দারুণ লাগছে। কারণ বর্ষবরণকে ঘিরে এখানে বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হয়েছে, যা একটি ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছে। পরিবারের সাথে আসা একজন শিশু বলেন, মেলায় অনেক মাটির পুতুল ও খেলায় আছে। পুতুল কিনেছি, আরো কিনবো। এখানে ঘুরতে এসে খুব ভালো লাগছে। পুলিশের একজন সদস্য বলেন, আমাদের পরিবার ছাড়াই ঈদ উদযাপন করেছি।এখন আবার বৈশাখ উদযাপন করছি। কাজের মাঝে আমাদের উৎসব। সবাই আনন্দ পেলে, তা দেখে আমরা আনন্দ পাই। একজন সাংবাদিক বলেন, বাঙালি জাতীয়বাদীতে উদ্বুদ্ধ করা আমাদের মূল লক্ষ্য। শুধুমাত্র পহেলা বৈশাখে এটি সীমাবদ্ধ না থাকে।বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য যাতে সারাবছর মানুষ ধারণ করে, তার চেষ্টা করতে হবে। আমরা যত জাতীয়তাবাদীতে উদ্বুদ্ধ হবো, তত আমরা বিভিন্ন অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়তে পারবো। একজন পুলিশ সদস্য বলেন পহেলা বৈশাখকে ঘিরে আমরা প্রতিটি যায়গায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা কেরেছি, যাতে বাঙালি নির্বিঘ্নে দিনটি উদযাপন করতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি মনিটরিং করা হচ্ছে। যাতে কেউ স্যোশাল মিডিয়াম গুজব কিংবা রটিয়ে সা¤প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছড়িয়ে দিয়ে যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটনাতে না পারে, সেই বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি। আমাদের আয়োজনটি বাঙালির সংস্কৃতির আয়োজন। নতুন প্রজন্মদেরকে আমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যই কিন্তু আমাদের এই আয়োজন। সংস্কৃতির অংশ হিসেবে আমরা বিভিন্ন দেশীয় খেলাধুলার আয়োজন করে পুরস্কৃত করেছি। নতুন প্রজন্ম এখন বেশিই আধুনিক। তারা যে কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। সময়ের চিরায়ত আবর্তনে নববর্ষ নতুন স্বপ্ন, নতুন অনুপ্রেরণা নিয়ে আমাদের মাঝে সমাগত। নতুনকে বরণ করা মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। তাইতো নববর্ষকে বরণ করতে দেশব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল।
বাংলা নববর্ষ আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আনন্দের সমাহার নিয়ে আমাদের জীবনে নববর্ষের আগমন ঘটে। তাই বিগত দিনের ভুল-ভ্রান্তি, ব্যর্থতা ও হতাশাকে দূরে ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। নতুন ও ইতিবাচক পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে।’ তিনি বলেন, করোনা অতিমারি ও বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের ফলে বাংলাদেশেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব পড়েছে। আমাদের আশপাশের অনেক মানুষই কষ্টে দিনাতিপাত করছে। নববর্ষে আমরা একে অন্যের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই এই হোক বাংলা ‘নববর্ষ এর প্রত্যাশা। আজ আমরা যে সময়কে পেছনে ফেলে নতুন দিনের আলোয় উদ্ভাসিত হতে যাচ্ছি, সে সময়ের যাবতীয় অর্জন আমাদের সম্মুখ যাত্রার শক্তিশালী সোপান হিসেবে কাজ করছে। তাই নতুন বছরের এই মাহেন্দ্রক্ষণ সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নতুন নতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে উন্নতির নতুন শিখরে আরোহণের সোপান রচনা করার অনুপ্রেরণা। নতুন বছরে মানুষে-মানুষে স¤প্রীতি, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরো জোরদার হোক, সকল সংকট দূরীভূত হোক, সকল সংকীর্ণতা পরাভূত হোক এবং সকলের জীবনে আসুক অনাবিল সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি এই প্রার্থনা করি। পরিশেষে রামুর সাংস্কৃতিককর্মীদের ব্যতিক্রমী নববর্ষ আয়োজনের জন্য সাধুবাদ জানাই।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক