গণপরিবহনে দ্বিগুণ ভাড়া আদায়, প্রশাসন নীরব

86

প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে বাড়ির পথে ছুটছেন অনেকেই। কিন্তু অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন ঈদে ঘরমুখো যাত্রীরা। আর এ ঈদ যাত্রার খুশিকে মলিন করে দিচ্ছে কিছু বাস চালক-হেলপার। দীর্ঘদিন ধরে নগরীর শাহ আমানত সেতু তথা নতুন ব্রিজ থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের যাত্রীদের বৃহস্পতিবার ভাড়া বেশি নেয়ার প্রবণতা থাকলেও এখন কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে সেটিকে আরো জোরদার করে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ যাত্রীদের। শুধু নতুন ব্রিজ এলাকা নয়, অক্সিজেন মোড়, কাপ্তাই রাস্তার মাথা ও অলংকার মোড়েও একই চিত্র। আর এতো অভিযোগের পরেও প্রশাসনকে নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন জানালেন, বিআরটিএ’র নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া নিতে পারবে না কেউ। আর অতিরিক্ত ভাড়ার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগও করেনি।
গত রবিবার অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পেয়ে দূরপাল্লার কাউন্টারগুলোতে অভিযান চালায় বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসময় তিনটি পরিবহনকে মোট ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এস এম মনজুরুল হক। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শেষ হওয়ার তিন ঘণ্টা পরেই ৬৮টি রুটে বাস চলাচল বন্ধ রেখে ধর্মঘটের ডাক দেয় আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতি। পরে রাত ১০ টায় জেলা প্রশাসকের সাথে বৈঠকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেন তারা। এতে করে যেন তারা আরও সুযোগ পেয়ে যায়। ফলে ঈদ যাত্রাকে কেন্দ্র করে প্রত্যেক রুটের ভাড়া দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত হয়ে যায়। কিন্তু ওইদিনের পর থেকে বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেটদের মাঠে কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। তাহলে কার ইশারায় তারা হঠাৎ করে অভিযান বন্ধ করলো- প্রশ্ন জনমনে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিনে নিউ মার্কেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে কোনো গাড়ির স্টেশন নেই। তবুও কিছু হাইয়েস সেখানে অবস্থান করতে দেখা গেছে। আর তারা যাত্রী নিচ্ছে সাতকানিয়ার কেরাণীহাট পর্যন্ত। ভাড়া জানতে চাইলে হেলপার সুমন জানায়, যেখানে নামুন না কেন একদাম ১৫০ টাকা অথচ নতুন ব্রিজ থেকে কেরাণীহাটের ভাড়া মাত্র ৬০ টাকা। নতুন ব্রিজ এলাকায় গিয়ে দেখা গেলো একই অবস্থা। লোকাল গাড়িগুলোও এখন রিজার্ভ বাস সার্ভিস বলে যাত্রী উঠাচ্ছে। আর নিরুপায় হয়ে উঠছেন যাত্রীরা। আবার কয়েক জায়গায় যাত্রীদের সাথে হেলপারদের বাক বিতন্ডার বিষয়টিও দেখা গেছে। ভাড়া নিয়ে একজন অপরজনকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতেও দেখা যায় এসময়।
যাত্রী মহিউদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, নিউ মার্কেট থেকে উঠলাম বিজিসি ট্রাস্ট নামবো বলে; কিন্তু ভাড়া ১৫০ টাকা। ঈদ উপলক্ষে বাড়ি যেতে হচ্ছে বিধায় বাধ্য হয়ে উঠে গেলাম। আমাদের প্রশাসন আজ কোথায়? আমাদের সরকার কি এটাই চায় যে, আমরা ভোগান্তিতে পড়ি? এটার সুরাহা কবে হবে?
নতুনব্রিজ এলাকা থেকে সোলাইমান বলেন, কি মগের মুল্লুক রে ভাই। নতুন ব্রিজ থেকে দোহাজারি ৫০ টাকার ভাড়া সেখানে কিভাবে ১২০ টাকা ভাড়া দাবি করে? হেলপাররা দেখছি তো সুযোগে সদ ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে।
আরেক যাত্রী সেলিম বলেন, বড় বড় নেতা-মন্ত্রীরা আরাম আয়েশ করে আমাদের টাকায়। অথচ আমরা ভোগান্তিতে। ভোট আসলেই তারা ভিক্ষা চায়, আর ভোট চলে গেলে ভুলে যায়। দেশের নেতাদের মন মানসিকতা পরিবর্তন না হলে জীবনেও গাড়ির সমস্যা সমাধান হবে না। শিক্ষক ফারুক বলেন, গত ঈদুল ফিতরের সময় আমরা দেখেছিলাম ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে ছিলো। কিন্তু এবারের ঈদে তারা কোথায় গেলো? তারা কি পরিবহন নেতাদের কাছে জিম্মি? নাকি ম্যানেজড? তারা তো সুন্দরভাবে রাস্তায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলো কিন্তু হঠাৎ করে কেন এরকম হয়ে গেলো। বিষয়টা পরিবহন মন্ত্রীসহ অন্যান্যদের দৃষ্টিগোচর হওয়া দরকার।
দামপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শ্যামলী এন আর ট্রাভেলস আগে নাটোরের ভাড়া নিতো ৭০০ টাকা কিন্তু গতকাল (বৃহস্পতিবার) মো. আলতাব হোসেন নামের একযাত্রী থেকে নিয়েছে ১২০০ টাকা। তিনি বলেন, ভাই কি আর বলবো, ওইদিন ম্যাজিস্ট্রেট জরিমানা করেছিলো তো সেগুলো এখন আমাদের থেকে বাড়তি নিয়ে উসুল করে নিচ্ছে।
এ কে খান এলাকায় শাহী কাউন্টার থেকে ফারহান মুহিব টিকেট কেটেছেন ল²ীপুরের। যেখানে সচরাচর ভাড়া ৩৩০ টাকা; গতকাল ৫০০ টাকা না হলে টিকেট হবে না বলে একবাক্যে বলে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, নিরুপায় হয়ে আমি টিকেট নিয়েছি। যদি ম্যাজিস্ট্রেটরা মাঠে থাকতো তাহলে তারা এসব অপকর্মের সুযোগ পেতো না।
এ প্রসঙ্গে আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কফিল উদ্দিন আহামদ পূর্বদেশকে বলেন, যাত্রীদের কাছ থেকে যাতে অতিরিক্ত ভাড়া না নেওয়া হয় আমরা এর জন্য কাজ করছি। কাউন্টারের পাশে আমাদের মালিক সমিতির লোকজন অবস্থান করছে দেখার জন্য। যদি অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট পরিবহনের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিবো।
বিআরটিএ’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এসএম মনজুরুল হক বলেন, গত ঈদে আমরা বাড়তি ভাড়া নেয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিলাম। ফলে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছিলেন যা অনেক যাত্রী আমাদের পেইজে ইনবক্স করে তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছিলেন। এবারও আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম, পরিবহন মালিকরা কোনোভাবেই সরকার-নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া নিলে আমরা তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। এবারও আমরা অনেক যাত্রীর কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ পাওয়ায় অভিযুক্ত পরিবহনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মালিকপক্ষ সম্পূর্ণ মিথ্যা অজুহাতে প্রশাসনকে বø্যাকমেইল করার উদ্দেশ্যে হুট করে ধর্মঘট ডেকে বসেন। এতে হঠাৎ করে সাধারণ যাত্রীরা প্রচুর ভোগান্তির মধ্যে পড়ে যায়। পরে সংবাদপত্র মারফত জানতে পারি, জেলা প্রশাসক মহোদয়ের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে মালিকপক্ষ ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন। কিন্তু কি ধরণের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয় বিষয়টি আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। এতে করে যাত্রীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে আবারও বাড়তি ভাড়া নেয়া হচ্ছে মর্মে প্রতিদিনই আমাদের কাছে অভিযোগ আসছে। মালিকপক্ষ চেয়েছিলো এ ধরণের একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আমাদের পরিচালিত অভিযানকে বাধাগ্রস্ত করতে। তাদের ইচ্ছাই কি তাহলে পূরণ হতে যাচ্ছে?
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন পূর্বদেশকে জানান, প্রতি বৃহস্পতিবার আসলেই কিন্তু নতুন ব্রিজের ভাড়া বেড়ে যায়, এটা নিয়মিত অভিযোগ ছিল। এখন ঈদ উপলক্ষে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা মাঠে থাকবে। বেশি ভাড়া নেয়া পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমাকে কেউ অভিযোগ করেনি বলেই কাউন্টারে ম্যাজিস্ট্রেট পাঠাইনি। যদি অভিযোগ করতো তাহলে সাথে সাথে পাঠাতাম।
ধর্মঘটের পর বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেটরা ভ্রাম্যমাণ আদালত বন্ধ করে দিয়েছে কেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে ভ্রাম্যমাণ আদালত বন্ধ রাখতে বলিনি। তাদের বলা হয়েছে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যাতে আমাকে জানিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে।