খেলা থামাতে বললেন পশ্চিমাদের

43

পূর্বদেশ ডেস্ক

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অভিপ্রায় প্রকাশ করছেন একটি বিস্তৃত রাশিয়ান-আধিপত্যযুক্ত সুরক্ষা অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, যা সোভিয়েত যুগে মস্কোর শক্তির মতো হবে।
এর মধ্যে তিনি ইউরোপের দিক থেকে রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য একটি প্রধান ভূমিকা চান। কারণ গত দুই দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বেশিরভাগ ন্যাটো মিত্ররা ইউরোপে রাশিয়ার প্রভাবকে অধস্তন করার চেষ্টা করেছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ন্যাটো পূর্ব দিকে প্রসারিত হয়, অবশেষে কমিউনিস্ট বলয়ের মধ্যে থাকা বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ ন্যাটোতে যোগ দেয়। লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া এবং এস্তোনিয়ার বাল্টিক প্রজাতন্ত্র, এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, পোল্যান্ড, রোমানিয়া এবং অন্যদের মতো ন্যাটোতে যোগদান করেছিল। পরিকল্পনা ছিল ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার। রুশ প্রেসিডেন্ট ন্যাটোর সম্প্রসারণকে হুমকি হিসেবে এবং ইউক্রেনের এতে যোগদানের সম্ভাবনাকে তার দেশের জন্য একটি অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে অভিহিত করেন। তাই রাশিয়া সিদ্ধন্ত নেয় ইউক্রেনের ওপর প্রভাব বিস্তার অব্যাহত রাখা।
অন্যদিকে রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন চালালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা প্রত্যক্ষভাবে ইউক্রেনের পক্ষে থাকবেন এবং সার্বিক সহযোগিতা করবেন- এ দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ইউক্রেন প্রসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কির।
এছাড়া পশ্চিমারাও তাই বলেছিলেন। কিন্তু রাশিয়া হামলা চালানোর পর জেলেনস্কি দেখতে পেলেন পশ্চিমারা যেভাবে বলেছিলেন, সেভাবে এগিয়ে আসেননি। তবে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা না করলেও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা দিচ্ছেন পশ্চিমারা। রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধসহ নানাভাবে চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। দেখা দেয় খাদ্য সংকট। এ কারণে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, পশ্চিমারা যদি তার দেশের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়, তাহলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট এড়াতে মস্কো উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে প্রস্তুত। ইতালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘির সঙ্গে এক ফোনালাপে এ কথা বলেন তিনি।
এ অবস্থায় ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি চান রাশিয়ার ব্যাপারে আরো কঠোর সিদ্ধান্ত। তিনি পশ্চিমাদের নিয়ে সমালোচনা বাড়িয়েছেন। জেলেনস্কি রাশিয়াকে ঘিরে পশ্চিমাদের খেলা বন্ধ করা এবং আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইউক্রেনে দেশটির ‘কান্ডজ্ঞানহীন যুদ্ধ’ অবসানের আহব্বান জানিয়েছেন। তার দেশ স্বাধীনই থাকবে দাবি করে তিনি বলেন, কোন মূল্যে এই স্বাধীনতা রক্ষা হবে সেটিই প্রশ্ন।
সম্প্রতি পশ্চিমাদের সমালোচনা বাড়িয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। রুশ তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে ধীরে এগোচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। একই সময়ে হাজার হাজার রুশ সেনা ইউক্রেইনের পূর্বাঞ্চলীয় দুই শহর সিভিয়েরোদোনেতস্ক এবং লিসিচানস্ক ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে।
এদিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ গতকাল অভিযোগ করে বলেছেন, রাশিয়া এবং তার জনগণ ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে তিনি বলেন, পশ্চিমারা আমাদের বিরুদ্ধে, পুরো রাশিয়ান বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এসময় তিনি রাশিয়ান লেখক, সুরকার এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে নিষিদ্ধ করার জন্য পশ্চিমাদের অভিযুক্ত করেন। তিনি বলেন, এটা বলা নিশ্চিত যে এই পরিস্থিতি আমাদের সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের জন্য থাকবে।
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, ওয়াশিংটন এবং এর উপগ্রহগুলো আমাদের দেশকে ‘ধারণ’ করার জন্য তাদের প্রচেষ্টাকে দ্বিগুণ, তিনগুণ, চারগুণ করছে। তারা বিস্তৃত পরিসরের উপকরণ ব্যবহার করছে- একতরফা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী মিডিয়া স্পেসে পুরোপুরি মিথ্যা প্রচার করছে। অনেক পশ্চিমা দেশে দৈনিক রুশফোবিয়া একটি নজিরবিহীন প্রকৃতি হয়ে উঠেছে।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের তিন মাস হতে চলেছে। এর মধ্যে কিইভ দখলের চেষ্টা থেকে সরে এসেছে রাশিয়া। ইউক্রেইনের পূর্বাঞ্চলীয় ডনবাস এলাকার অবস্থান সুসংহত করতে চাইছে তারা। ২০১৪ সাল থেকে ওই অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিয়ে আসছে মস্কো।
পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষকরা সিভিয়েরোদোনেতস্ক এবং লিসিচানস্ক শহরের যুদ্ধকে সম্ভাব্য টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখছেন। গত সপ্তাহে মারিউপোলে ইউক্রেইনীয় সেনাদের আত্মসমর্পণের পর এ দুই শহরের পতন হলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যেতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
গত বৃহস্পতিবার রাতে এক ভিডিও বার্তায় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, ইউক্রেইন সবসময় স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। এটি ভেঙে যাবে না। একমাত্র প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীনতার জন্য আমাদের জনগণকে কী মূল্য দিতে হবে; আর আমাদের বিরুদ্ধে কান্ডজ্ঞানহীন যুদ্ধের জন্য রাশিয়া কী মূল্য দেবে সেটি।
তিনি আরও বলেন, বিপর্যয়কর যেসব ঘটনা সামনে আসছে, তা এখনও বন্ধ করা যেতে পারত, যদি বিশ্ব ইউক্রেনের মতো একইরকম পরিস্থিতিতে পড়ার উপলব্ধি দিয়ে সেভাবে কাজ করতে পারত। যদি বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো রাশিয়াকে নিয়ে খেলা না করে বরং যুদ্ধ শেষ করার জন্য সত্যিকারের চাপ প্রয়োগ করত।
রাশিয়ার ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে ইইউ দেশগুলোর মধ্যে মতবিরোধের সমালোচনা করেছেন জেলেনস্কি। কিছু দেশকে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিকল্পনা বন্ধের সুযোগ কেন দেওয়া হচ্ছে তা নিয়েও অভিযোগ করেছেন তিনি।
ইইউ রাশিয়ার তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞাসহ দেশটির ওপর ষষ্ঠ দফা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করছে। এক্ষত্রে মতৈক্য প্রয়োজন। কিন্তু হাঙ্গেরি তাদের অর্থনীতি বাঁচাতে এই নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করছে।
ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে জ্বালানি সরবরাহ করে রাশিয়া প্রতিদিন শত কোটি ইউরো আয় করছে।
তিনি প্রশ্ন করে বলেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়ন ষষ্ঠ প্যাকেজে (নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাব) একমত হওয়ার জন্য আরও কত সপ্তাহ চেষ্টা করবে? রাশিয়ার ওপর চাপ আক্ষরিক অর্থে জীবন বাঁচানোর ব্যাপার। বিলম্ব, দুর্বলতা, নানাবিধ বিরোধ বা কিংবা আগ্রাসীকে ‘শান্ত’ রাখার প্রস্তাবের অর্থ হচ্ছে আরও বেশি ইউক্রেনীয় নাগরিকের মৃত্যু।