খালেদ, জামিলই সেই ভয়াল কালরাতের মহাবীর

17

 

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি মহাকালের এক অমর মহামানব বঙ্গবন্ধুকে বেমালুম হারালাম আমাদের গাফিলতিতে কিংবা কর্তব্যহীনতার কারণে। চরম অবহেলায়। দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পরাজিত শক্তি তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারীদের পত্রিকা ‘গণকন্ঠ’ অপপ্রচার এবং নানামুখী ষড়যন্ত্র চলে আসছিল।
বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে মনে প্রাণে ভালোবাসতেন একথা সত্য। যে কারণে তার অগাধ বিশ্বাস ছিল তাকে অন্তত বাঙালির হাতে প্রাণ দিতে হবে না বা এমন কোনো বাঙালি নেই যে জনকের প্রাণ হরণ করতে পারে। এটিই ছিল বীরের জাতি এবং স্বাধীনতাপ্রেমী বিদ্রোহী জাতির প্রতি তাঁর প্রগাঢ বিশ্বাস। শেখ মুজিবের অন্তরে এ প্রগাঢ় বিশ্বাস কেনই বা জন্ম নেবে না, কারণ সমস্ত বাঙালি বছরের পর বছর তাঁর নির্দেশ পালন করেছে। মাঠে নেমেছে দ্রোহে বিদ্রোহে রাজপথে রক্ত দিয়েছে। যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে পশ্চিমা শক্তিকে রুখে দিয়েছে এবং এই শ্মশানভূমি কে আবার প্রাণ দিতে তারা মাঠে নেমে পড়েছিল অবিশ্বাস্য দেশপ্রেমকে পুঁজি করে। আমাদের নিয়মিত সেনাবাহিনী বিমান বাহিনী নৌ বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সক্রিয় ছিল সারা দেশে। তাদের কেউ কি বাঁচাতে পারল বঙ্গবন্ধুকে। আশা ছিল তোফায়েলের রক্ষীবাহিনী ইস্পাতকঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। শফিউল্লাহ তার বাহিনী নিয়ে জান উজাড় করে দিয়ে ঢাকার রাজপথে নেমে আসবে আওয়ামী লীগের এমপিগণ অন্যান্য নেতাকর্মীসহ যুবলীগ, শ্রমিকলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ তারা পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকবে না।
কিন্তু বাস্তবে কি ঘটলো সমগ্র বিশ্ববাসী দেখল অত্যন্ত অসহায় ভাবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মহাত্মা ইন্দিরা গান্ধী কোন রূপ হস্তক্ষেপ বা শক্তি প্রয়োগ থেকে বিরত থাকলেন।সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন কিছু বিপথগামী সেনা বাহিনী থেকে বহিষ্কৃত কিছু মেজর রাতের অন্ধকারে গোলা-বারুদবিহীন ট্যাংক যে গুলো বঙ্গবন্ধু মিশর থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন, সে ট্যাংক দিয়ে রাজধানীতে এক ভয়াল পরিবেশের সৃষ্টি করে শেখ মুজিবকে হত্যা করল। বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রইল যারা জানতো এই বাঙালি বীরের জাতি, এই বাঙালি শেখ মুজিবের অবদান অস্বীকার করতে পারবে না তারা কোনো অবস্থাতেই তাকে সপরিবারে এমন নির্মম ভাবে এমনকি তার শিশু সন্তানকে হত্যা করতে পারে না। হয়েছে তাই।খালেদ মোশাররফ কর্নেল জামিল শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলল এবং বাংলাদেশি মতবাদের ধ্বজাধারী ও একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে অনেকটাই রুখে দিয়েছিল পনেরোই আগস্টের কাল রাত্রিতে। তাদের এই পাল্টা অভ্যুত্থান যদি টিকে থাকত তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। বঙ্গবন্ধু হত্যার কঠিন প্রতিশোধ তারা যদি ধরে রাখতে পারতেন, একাত্তরের চেতনা ও আদর্শ উদ্দেশ্য গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদে’র জয় নিঃসন্দেহে নিশ্চিত ও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারতো।
খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম মুক্তিযুদ্ধকালীন কে ফোর্সের সর্বাধিনায়ক ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে তার নেতৃত্বে পাল্টা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের তেসরা নভেম্বর কিন্তু ৭ই নভেম্বর তাঁকে হত্যা করে বাংলাদেশের রাজনীতিকে অন্যদিকে প্রবাহিত করা হয় এবং জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের পথ প্রশস্ত করা হয়েছিল। এ বীরের বীরত্ব আজ অনেকটাই ঝাপসা হয়ে গেছে। কালেভদ্রে খালেদ মোশাররফের নাম শোনা যায় মাত্র। সেই কালরাত্রিতে বঙ্গবন্ধু কর্নেল জামিল কে ফোন দিয়েছিলেন কথা শেষ না হতেই ফোন কেটে গিয়েছিল তথাপি জামিল বুঝতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিপদ হয়েছে। তিনি সাথে সাথে শফিউল্লাহ সহ অন্যান্যদের ফোন করেন এবং তার পিস্তল নিয়ে দ্রæত বেরিয়ে পড়েন এবং তার স্ত্রীকে বলে যান ‘তুমি আমার বাচ্চাদের দেখো’ সে জামিল দুর্দান্ত সাহসে ৩২ নম্বরে ছুটে আসেন কিন্তু কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই তাকে হায়েনারা ঘায়েল করে। সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর ডালিম তৎকালীন বাংলাদেশ বেতারের নাম পরিবর্তন করে রেডিও বাংলাদেশ থেকে ঘোষণা করে, শেখ মুজিব আর নেই ‘ইতিহাসের কি জঘন্য উদাহরণ মেজর ডালিম ঘোষণা দিচ্ছেন আর বেতার ভবন এর সাথে লম্বা টেবিলে অপেক্ষা করছেন তৎকালীন ডেপুটি আর্মি চিফ জিয়াউর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধকালীন অধিনায়ক এমএজি ওসমানী। এতেই বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে নায়ক কারা। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনায় হাত ছিল কাদের এবং কারা সাজিয়েছিলেন ইতিহাসের এই জঘন্যতম নীলনকশা ? জাতি তাদের জঘন্যতম কার্যকলাপ যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন মীরজাফরের মত স্মরণে রাখবেন এই আশা সমগ্র মুক্তিকামী বাঙালি জাতির। যুদ্ধকালীন বন্দী অবস্থায় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। ফলে তার অনুপস্থিতিতে মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব পড়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের উপর। খন্দকার মোশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, ফনি মজুমদার এদের চক্রান্তে বঙ্গবন্ধুর আস্থা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নেয়া হয় তাজউদ্দিন আহমেদকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এটি উপলব্ধি করতে পারেননি ভবিষ্যতে কী পরিণতি তাঁর এবং তাঁর পরিবারের ওপর উঠে আসছে। এরকম মোস্তাক অনুসারীরা এখনও নেই তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবেনা। সময় বলে দেবে তাদের উত্তরসূরি কারা। তারা কিন্তু বসে নেই সুযোগের অপেক্ষায় আছে তাই সময় থাকতে আমাদের এসব ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করতে হবে। ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। হাইব্রিডদের রুখতে হবে। যেসব বহিস্কৃত সেনা কর্মকর্তারা বিদেশে বসে বাংলাদেশ সম্পর্কে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে এবং সেগুলোর ইউটিউবের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা বিশ্বে। আমাদের এই শোকের মাসে বিষাদের ক্ষণে দাবি থাকবে সরকার যেন এগুলোর প্রতি সাবধান থাকে এবং এসব অপপ্রচারণা অনতিবিলম্বে বন্ধ করে যেকোনো ষড়যন্ত্র থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করা হয়। মনে রাখতে হবে সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড়।
লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা