কোন পথে পাকিস্তান?

12

পূর্বদেশ ডেস্ক

অশান্ত হয়ে উঠেছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গন। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব নাকচ হয়ে যাওয়ার পর দেশটির পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদ ভেঙে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। গতকাল রোববার জাতীয় পরিষদের ডেপুটি স্পিকার কাসিম খান সুরি অনাস্থা প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়ার পর ইমরান খানের পরামর্শে আইনসভা ভেঙে দেন প্রেসিডেন্ট।
এই পরিস্থিতিতে আগামী তিন মাস অর্থাৎ ৯০ দিনের মধ্যে দেশটিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে শোনা যাচ্ছে। এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম জিও নিউজ।
পাকিস্তানের সংবিধানের ২২৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, পার্লামেন্ট ভেঙে যাওয়ার পর এখন প্রেসিডেন্ট একজন তত্ত¡াবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন। দেশটির নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী থাকবেন ইমরান।
অনাস্থা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া সংক্ষিপ্ত ভাষণে ইমরান বলেন, নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিন। দেশের ভবিষ্যৎ কী হবে তা কোনো দুর্নীতিবাজ শক্তিই ঠিক করবে না। তিনি বলেন, শাসন পরিবর্তনের প্রচেষ্টা এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করেছেন ডেপুটি স্পিকার।
জাতির সামনেই ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করা হচ্ছিল বলে মন্তব্য করে পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী জানান, ডেপুটি স্পিকার জাতীয় পরিষদে বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করে দেওয়ার পর ‘উদ্বিগ্ন’ অনেকের কাছ থেকে বার্তা পেয়েছেন তিনি। ইমরান খান বলেন, আমি বলতে চাই ‘ঘাবরানা নেহি হ্যায়’ (চিন্তার কিছু নেই)। আল্লাহ পাকিস্তানের ওপর নজর রাখছেন।
জাতীয় পরিষদ (পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ) ভেঙে দেওয়ার একটি দাপ্তরিক নোটিশ জারি করা হয়েছে। ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, পিএমএল-এনের নির্বাসিত প্রতিষ্ঠাতা নওয়াজ শরিফ ঠিক এটাই চেয়েছিলেন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী ইমরানের সুপারিশে প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার পর থেকেই দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠেছে। বিরোধীরা আইনসভার অধিবেশন পুনরায় শুরু করেন। তারা ডেপুটি স্পিকারের অনাস্থা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করার পাশাপাশি শাহবাজ শরিফকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একতরফা ঘোষণা দিয়েছেন। শাহবাজ শরিফ সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাই। ‘নতুন প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে আইনসভায় এরই মধ্যে ভাষণও দিয়েছেন শাহবাজ।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ইমরান খানের প্রশাসনের শক্তির অন্যতম উৎস হিসেবে সামরিক বাহিনীর সমর্থনকে বিবেচনা করা হয়। বিশ্লেষকদের মতে, গোয়েন্দা বাহিনীর নতুন নেতা নির্বাচন বিষয়ে মতভেদের পর সামরিক বাহিনীর সমর্থন হারিয়েছেন ইমরান। তবে বিরোধী দলের নেতারা বর্তমান রাজনৈতিক সংকটে সামরিক বাহিনীর ভূমিকাকে ‘নিরপেক্ষ’ বলে অভিহিত করেছেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা শেরি রেহমান একটি ভিডিও টুইট করেছেন। তাতে তিনি দাবি করেছেন, ১৯৭ জন সদস্য পিএমএল-এনের সাংসদ আয়াজ সাদিককে নতুন স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত করেছেন।
সাদিক স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি ইমরান খানের সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব চালু করেন। পার্লামেন্টে ইমরান খানের শাসক জোটের সদস্যদের অনুপস্থিতিতে অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে রায় দিয়েছেন বিরোধীদলীয় সাংসদেরা।
২৫ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি হওয়ার পর পার্লামেন্টের অধিবেশন পুনরায় আহŸান করার ক্ষেত্রে এটি একটি প্রতিবাদী পদক্ষেপ বিরোধীদের। নিয়মানুসারে, স্থগিত হওয়া অধিবেশন কেবল প্রেসিডেন্ট বা স্পিকার ডাকতে পারেন।
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডনের খবরে বলা হয়, দিনের শুরুতে ডেপুটি স্পিকার কাসিম খান সুরি ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব নাকচ করে বলেন, এটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫-এর বিরোধী। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫-এ বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করা। সংবিধান ও আইনের প্রতি আনুগত্য প্রত্যেক নাগরিকের জন্য অলঙ্ঘনীয়ভাবে বাধ্যতামূলক; তিনি যেখানেই থাকুন এবং পাকিস্তানে অবস্থান করার সময় প্রত্যেকের জন্যই তা প্রযোজ্য।
জিও নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের সংবিধান বিশেষজ্ঞ আব্দুল মইজ জাফেরি বলেন, মিথ্যাকে বড় করুন, সহজ করুন এবং বারবার বলতে থাকুন। এর পর সবশেষে আপনি সংবিধান ছিঁড়ে ফেলতে পারবেন। মইজ জাফেরির ভাষায়, ডেপুটি স্পিকার আজ (রোববার) যা করেছেন তা কেবলমাত্র সাংবিধানিক অনুচ্ছেদের অযৌক্তিক অপপ্রয়োগ নয়। একইভাবে এটি পিটিআইয়ের (ইমরানের দল) সদস্যদের সংবিধানের অপপ্রয়োগ এবং প্রকাশ্যে ভুল ব্যাখ্যা ও সংবিধানকে ভুলভাবে উপস্থাপনের বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টার চ‚ড়ান্ত পরিণতি।
দেশটির আইন বিশেষজ্ঞ মুনীব ফারুক বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার ডাক পুরোপুরি অসাংবিধানিক।
রীমা ওমর নামে দেশটির আরেক আইন বিশেষজ্ঞ টুইট করে বলেছেন, কোনো যদি এবং কিন্তু নয়, স্পিকারের রায় স্পষ্টভাবে অসাংবিধানিক। তিনি আরও লিখেছেন, পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেওয়ার কোনো ক্ষমতা ইমরান খানের নেই।
দেশটির আরেক আইন বিশেষজ্ঞ সালমান আকরাম টিভি চ্যানেলকে বলেন, বিরোধীদের এখন উপায় হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া। অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের মতো তিনিও বলেন, আমার দৃষ্টিতে এটি একটি সাংবিধানিক পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় স্পিকারের দেওয়া একটি অসাংবিধানিক রায়।
এদিকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জাতীয় পরিষদে ঘটা ঘটনাগুলোতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। রয়টার্স জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর জনসংযোগ শাখার প্রধান মেজর জেনারেল বাবর ইফতিখার বলেছেন, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সেনাবাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই।
ভারতের ইন্ডিয়া টুডের খবরে বলা হয়, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে অনাস্থা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর পাকিস্তানে রাজনৈতিক সংকটের জেরে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ গঠন করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট নোটিশ জারি করে জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার সব রেকর্ড তলব করেছেন। এ নিয়ে বিরোধীদের আবেদনের শুনানি আজ অনুষ্ঠিত হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুপ্রিম কোর্টের হাতে এখন কঠিন কাজ। দেশে জরুরি অবস্থা জারি বা সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের মতো বিকল্প পথ খোলা রয়েছে। তবে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিলে ইমরানের সমর্থন বাড়বে।
ইমরান খানের বিরুদ্ধে দেশ শাসনে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ এনে গত ৮ মার্চ অনাস্থা প্রস্তাব জমা দেয় বিরোধী দলগুলো। এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা ও ভোটাভুটির জন্য অধিবেশন ডাকতে স্পিকার আসাদ কায়সারের প্রতি লিখিত আবেদন জানান তারা।
পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী লিখিত আবেদন জমার ১৪ দিনের মধ্যে স্পিকারকে আলোচনার জন্য অধিবেশন ডাকতে হবে। সে অনুযায়ী ২২ মার্চের মধ্যে অধিবেশন আয়োজন করার কথা ছিল।
তবে ২২ মার্চ থেকে জাতীয় পরিষদে ওআইসির দুই দিনব্যাপী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন শুরু হওয়ায় তা আর হয়নি। এরপরই অধিবেশনের তারিখ পেছায়। একপর্যায়ে তা রোববার এসে ঠেকে।
নিম্নকক্ষে ৩৪২ আসনের মধ্যে বিরোধীদের দখলে আছে ১৬৩টি। বাকি ১৭৯ আসন। এর মধ্যে ইমরানের দলের আছে ১৫৫টি, চার জোট সঙ্গীর ২০টি। অনাস্থা প্রস্তাবে টিকে থাকতে হলে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) ইমরান খানকে অন্তত ১৭২ সদস্যের সমর্থন পেতে হতো। এরই মধ্যে তিন জোটসঙ্গী মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম-পি), পাকিস্তান মুসলিম লিগ-কায়েদ (পিএমএল-কিউ) এবং বালুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি) বিরোধী শিবিরে যোগ দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে।
দুর্নীতির দায়ে নওয়াজ শরিফ অভিশংসিত হওয়ার পর ২০১৮ সালে চার দলের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসেন তারকা ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ইমরান খান। ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত তার সরকারের মেয়াদ রয়েছে। এর আগে তিন বছরের মাথায় গত মার্চে অনাস্থা ভোট হয় ইমরানের বিরুদ্ধে। সেবার সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় অনায়াসেই উতরে গিয়েছিলেন তিনি।
নাটকের এখনই শেষ নয় বলেও অনেকে মনে করছেন। বিরোধীদের আবেদনে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তও অনেক কিছু বদলে দিতে পারে।
অনেক আইনজীবী বলছেন, সংবিধানের ‘মনগড়া’ ব্যাখ্যা দিয়ে ডেপুটি স্পিকার অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব বাতিল করতে পারেন না। তিনি যা করেছেন সেটিই সংবিধানের লংঘন।
ফের একবার পার্লামেন্টের ভবিষ্যৎ ঠিক করতে যাচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট, বলেছেন আইনজীবী আসাদ রহিম খান। সূত্র : আল-জাজিরা, ডন, জিও নিউজ।