কোনো দুধই মায়ের দুধের বিকল্প নয়

26

হাসিনা আকতার লিপি

কোনো দুধই মায়ের দুধের বিকল্প হতে পারে না। ফর্মুলা বা গুঁড়ো দুধ কিংবা গরুর দুধ বিকল্প হিসেবে বা মায়ের দুধের পাশাপাশি পান করালে শিশু নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারে। গরুর বা গুঁড়ো দুধ খাওয়ানোর নিপল থেকে শিশুর শরীরে ক্ষতিকর জীবাণু সংক্রমিত হয়। পাশাপাশি এসব দুধের আমিষসহ নানা উপাদান শিশুর হজমেও ব্যাঘাত ঘটায়। তা ছাড়া মায়ের দুধ থেকে শিশু যে রোগ প্রতিরোধের উপাদান পায়, এসব দুধে তা থাকে না। মায়ের দুধের পুষ্টি বিষয়ে অজ্ঞতার কারনে দেশে বহু শিশু মায়ের দুধ পান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুস্থ শিশুই সুস্থ-সবল জাতি গঠনের প্রাথমিক ধাপ। বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালিত হয়। বুকের দুধের উপকারিতা সম্পর্কে মানুষকে জানাতেই এই উদ্যোগ। এ বছর মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালিত হচ্ছে ১ আগস্ট থেকে ৭ আগস্ট।

মায়ের দুধ এবং গরুর দুধের পুষ্টিগুণের তুলনা
একটি ব্রিটিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুসারে মায়ের ১০০ মিলিলিটার দুধে জলীয় অংশ থাকে ৮৯ দশমিক ৯৭ গ্রাম, খাদ্যশক্তি থাকে ৭০ কিলো ক্যালরি, ৭ দশমিক ৪ গ্রাম শর্করা, ৪ দশমিক ২ গ্রাম চর্বি ও ১ দশমিক ৩ গ্রাম আমিষ। অপর দিকে মায়ের প্রথম বা শাল দুধে রয়েছে ৫৮ কিলো ক্যালরি, ৫ দশমিক ৩ গ্রাম শর্করা, ২ দশমিক ৯ গ্রাম চর্বি ও ৩ দশমিক ৭ গ্রাম আমিষ। এই হলুদ রঙের দুধে রয়েছে বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন ই ও জিংক। ফলে শিশু জন্মের পর এই দুধ অনেকটা টিকার মতো কাজ করে। শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। মায়ের দুধে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ চর্বি থাকলেও গরুর দুধে রয়েছে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। অপর দিকে গরুর দুধে আমিষের পরিমাণ অনেক বেশি। মায়ের দুধে যেখানে আমিষ রয়েছে ১ শতাংশ, সেখানে গরুর দুধে রয়েছে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ আমিষ।
বাছুর মানবশিশুর চেয়ে দ্রুত বড় হয় বলে গরুর দুধে আমিষের পরিমাণ বেশি। কিন্তু মানবশিশু এই আমিষ হজম করতে পারে না। অপর দিকে ফর্মুলা বা গুঁড়ো দুধ পান করালে শিশু সব সময়ই রোগ-জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। দুধ, নিপল ও বোতলের সঙ্গে অথবা বিকল্প দুধ তৈরিতে ব্যবহৃত পানির সঙ্গে রোগ-জীবাণুু থাকার আশঙ্কা রয়ে যায়। তাই শিশুর ঘন ঘন অসুখ হয়। কৃত্রিম গুঁড়ো দুধ পান করানো শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক কম থাকে। শিশু ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। পরিণামে তারা অপুষ্টি ও মৃত্যুর শিকার হয়।
শিশুকে দুধ পান করানো মায়ের জন্যও উপকারী
অন্তত নয় হাজারটি গবেষণাপত্রের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্তন্যদানকারী মা প্রসব-পরবর্তী বিষন্নতায় কম ভোগেন। স্তন্যদানকালে অক্সিটোসিন নামক একটি হরমোনের মাত্রা শরীরে বেড়ে যায়, যেটি মানসিক প্রশান্তি আনে। স্তন্যদানকারী মায়ের শরীরে এই হরমোনের মাত্রা ৫০ শতাংশ, যেখানে অন্য মায়েদের মধ্যে এর মাত্রা থাকে মাত্র ৮ শতাংশ। অন্যদিকে স্তন্যদানকারী মায়ের স্তন ও জরায়ুর ক্যান্সার হওয়ার আশংকাও কম। সন্তান গ্রহণের ফলে শরীরে যে বাড়তি মেদ জমা হয়, স্তন্যদান করলে তা আবার কমে যায়। স্তন্যদান করানোর মাধ্যমে গর্ভধারণের পরে আবার শরীরে স্বাভাবিক আকারে ফিরে আসা সহজ হয়। অজ্ঞতার কারণে শিশুকে মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত করায় দেশের শিশুর অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগ ব্যাধি ও শিশুর মৃত্যুর হার বেশী হওয়ার অন্যতম কারণ। একটি শিশুর সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই।
৩১ শতাংশ নবজাতকের মৃত্যু রোধ করা যায়, যদি মায়েরা জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে তাদের শিশুকে বুকের দুধ পান করান। শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য অন্তত ছয় মাস ধরে মায়ের দুধ পান করানোর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিষ্ট, ল্যাব এইড লিমিটেড (ডায়াগনষ্টিক) চট্টগ্রাম ও পার্ক ভিউ হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনষ্টিক লিমিটেড।