কাক চড়ুই সহ বন্য জীবজগৎ হুমকীতে

4

বিশ্ব পঁচিশ বছর আগেও পাখিদের কল কাকলীতে ঘুম ভাঙতো। কাক চড়ুই দোয়েল পাখি তাদের অন্যতম। এরা খুব ভোরে তাদের গান/ প্রার্থনা সঙ্গীত শুরু করে। হালে নাগরিক সমাজে বাড়িঘরের কাঠামো বদলে গেছে। এখন বহুতল ভবনের জয়জয়কার। বাড়িঘরে আগের মতো খোপ, গুগলি, ভেন্টিলেটর থাকে না। বাড়ির উঠোনে ফলদ ও পুষ্পজ গাছের বড় অভাব। অথচ বাড়ির খোপে খাপে চড়ুই বাসা বাঁধত। ঝোপে ঝাড়ে ও ফলদ গাছে বাস করতো কাক, দোয়েল, বুলবুটি, টুনটুনিসহ নানা ধরনের পাখি। আর এদের ঘিরে বাস করতো নানাবিধ কীটপতঙ্গ তথা জীববৈচিত্র্য। মানব বসতি গড়ার লক্ষ্যে বন বনানী ঝোপঝাড়, জলাশয়, পাহাড়, টিলা খাল বিল, সব এখন ভরাটের আওতায়। জীব বৈচিত্র্যের বাস্তুতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে নগরায়ন। কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাড়ছে। ফলে পাকপাখালিসহ জীববৈচিত্র্য আজ সংকটে। খাদ্য আবাস ও প্রজননের অভাবে জীবজগত আজ হুমকিতে পড়ে গেছে। শহরে নগরে এমন কী গ্রামের পাখিদের সংকট চলছে। এ সংকট মানব বসতির জন্য হুমকী। লোভীমানব সমাজ তা বুঝতে পারছে না।
বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে জানা যাক। প্রাণী, উদ্ভিদ, তাদের বাসস্থান, ও জিনসমূহ হলো বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্রের অন্তর্ভুক্ত। অক্সিজেন, খাদ্য, সুপেয় পানি, উর্বর মাটি, ওষুধ, আশ্রয়, ঝড় ও বন্যা হতে প্রতিরোধ, স্থিতিশীল ঋতু এবং নির্মল আনন্দ এসবই আমরা পেয়ে থাকি সুস্থ প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র হতে। পৃথিবীর অগণিত উদ্ভিদকুল, প্রাণীকুল এবং অনুজীবসমূহ রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় একত্রিত হয়ে পরিবেশকে মানুষসহ সকল জীবের বাসযোগ্য করে তোলে। এই জীববৈচিত্র্য বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে আমরা নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনছি। অথচ বাস্তুতন্ত্র এই পৃথিবীর মানব সম্পদকে খাদ্য ওষুধ ও গুরুত্বপূর্ণ জিনপুল জোগান দিচ্ছে। একটি দেশের নাগরিকদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য এবং ভবিষ্যতের প্রজন্মকে সুস্থ ও সুন্দরভাবে গড়ে ওঠার জন্য জীববৈচিত্র্য সুন্দর পক্রিয়ায় স্বাস্থ্যসম্মত ও সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।
পরিবেশ বিজ্ঞানি ও গবেষকগণ অতিস্পর্শকাতর ভাবে লক্ষ্য করছেন যে, চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের শহরে নগরে বিশেষ বিশেষ কিছু পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তার মধ্যে কাক, চড়ুই অন্যতম। কাক আমাদের অতি পরিচিত পাখি যেখানে মানব বসতি সেখানেই কাকের দেখা মেলে। মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করা কাক সামাজিক প্রাণী। এরা প্রকৃতির ঝাড়–দার বলে মানুষের বন্ধু বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। কাক সর্বভুক প্রাণী। পচাগলাসহ সকল উচ্ছিষ্ট তার খাদ্য তালিকায়। কাক বাড়িঘরের আশেপাশে থেকে নাগরিকদের সকল পচাগলা খেয়ে পরিবেশ বিশুদ্ধ রাখে। পথে ঘাটে থাকা বা চলাচল করা শিশুদের হাতের খাদ্য বস্তু দেখলেই ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। কাক নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনেক অনেক প্রবাদ প্রবচন ও মিথ ও নীতিকথা প্রচলিত আছে। রাজনীতিতেও কাকের প্রভাব লক্ষনীয়। উদাহরণতঃ ‘ দলে কাউয়া রাজনীতিবিদ প্রবেশ করেছে’ ওবায়দুল কাদের’। মোদ্দা কথা আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি রাজনীতি, বাস্তুতন্ত্রের কাকের প্রভাব লক্ষনীয়। বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতি পত্রিকা ২০১৪ সালে কাক সংখ্যা প্রকাশ করে। (সম্পাদক : মুশফিক হোসাইন)। সর্বশেষে কাক নিয়ে হাজার পৃষ্ঠা হলে তার উপকারও কল্পকথা শেষ হবার নয়। মানব সমাজে তার প্রভাব সুস্পষ্ট।
এবার আসা যাক চড়ুই পাখির কথায়। ছোট আকারের পাখি হলে পৃথিবীর ইতিহাসে স্থান নিয়েছে। বিশ্ব সাহিত্য, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি রাজনীতিতে তার ভূমিকা অম্লান। একটি ঐতিহাসিক ঘটনা শেয়ার করা যাক। ১৯৫৪ সালের ঘটনা। কমরেড মাওয়াসেতু এর নেতৃত্বে গণচীনে লালবাহিনী ক্ষমতায়। সকল কার্যক্রম চীনা কম্যুনিস্টপার্টির নির্দেশে চলছিল। পুঁজিবাদী ও পশ্চিমারা চীনের বিরুদ্ধে সার্বিক অবরোধ ঘোষণা করে। পার্টির নির্দেশ হল জনগণকে বাঁচাতে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। এর প্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লালফৌজ পার্টি নেতৃবৃন্দকে জানালো, দেশের মোট খাদ্য উৎপাদনের কিছু অংশ চড়ুই পাখি খেয়ে সাবাড় করছে। পার্টির প্রধান নির্দেশনা দিলেন- যেখানে পাও চড়ুই হত্যা করো। পুরস্কার ঘোষণা করা হলো। চীনা সেনা সদস্যসহ আবাল বৃদ্ধ যুবা সকলেই বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে চড়ুই হত্যা যজ্ঞে নেমে পড়ে। শুমার করে দেখা গেল কিছু দিনের মধ্যে ৩০ লক্ষ চড়ুই পাখি হত্যা করা হল। চীনে আর চড়ুই পাখি নেই। সেই মওসুমে খাদ্য উৎপাদনে ধস নামলো। পরের মওসুমে একই বিপর্যয়। গণবাহিনী তদন্ত করে দেখলো কোন বিদেশি শত্রু নয়। চীনের কীট পতঙ্গ রবিশষ্যের ক্ষেত সাবাড় করে দেওয়ার কারণে এই ধস। তদন্তে বেরিয়ে এল চড়ুই হত্যার কারণে কীটপতঙ্গের এই সর্বনাশি উৎপাধন। ক্ষেতের ফসলের বন্ধু চড়ুই ফসলের ক্ষতিকারক কীট পতঙ্গ খেয়ে উৎপাদনের সহায়তা করে থাকে। বিপাকে পড়ে গেল চীনা কম্যুনিস্ট পার্টি। তিন বছরে ১৫ লক্ষের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। মাওসে তুং এর বন্ধু রাশিয়ার ব্লেজনেঙ্গের হস্তক্ষেপে রাশিয়া থেকে চীনে ৩০ লক্ষ চড়ুই আমদানী করতে হয়েছিল। বিশ্ব বাজারে চড়ুই পাখি আমদানীর এমন নজির বিহীন ঘটনা আর ঘটেনি। সাথে সাথে বিশ্ববাসী শিক্ষা নিল ক্ষুদ্র চড়ুই পাখিও মানব জাতির বন্ধু।
বড়ই দুর্ভাগ্যের কথা বাংলাদেশের শহর নগর ও গ্রামীণ পরিবেশে কাক, চড়ুই, দোয়েল পাখি নীরবে নিভৃতে ধ্বংস হতে চলছে। বলা চলে এই ধ্বংস মাত্রাতিরিক্ত হওয়ার বাস্তুতন্ত্র ও জীব বৈচিত্র্য হুমকির মুখে। প্রকৃতির খাদ্য শৃঙ্খলে একটি প্রজাতি ধ্বংস হলে অন্য একটি ক্ষতিকর প্রজাতি বেড়ে যায়। ফলে খাদ্যচক্র বাধাগ্রস্ত হয়। বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হলে প্রকৃতিতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেয়। জীববৈচিত্র্যের অন্যতম দুখি পাখি কাক ও চড়ুই হ্রাস পাওয়ায় বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ স্পর্শকাতর বিষয়ে আমরা সভ্য মানুষেরা নজর দিচ্ছি না। আমরা লোভের বশীভুত হয়ে বহুতল ভবনের স্বপ্নে বিভোর। পুকুর, জলাশয়, পাহাড় ধ্বংস করে বনবনানী ধ্বংস করে সুখের যে স্বপ্ন গড়ে তুলেছি। আমরা ভাব ছিনা জীব জগতে যে মারাত্মক অঘটন ঘটে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে তার কথা। আমরা হয়ত ভুলেগেছি করোনা, জিগা, বার্ড ফ্লু, প্লেগ ইত্যাদি মহামারীর কথা। এসকল মহামারীর অন্যতম কারণ হচ্ছে জীববৈচিত্র্যের হারিয়ে যাওয়ার কারণে। অতএব ক্ষুদ্র হলেও আমাদের প্রকৃতির পাখিদের ফিরিয়ে আনতে হবে। সে জন্য বনবনানী ও মুক্ত জলাশয়কে ফিরিয়ে আনতে হবে। কোন বিকল্প নেই হে মানবজাতি।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)