করোনা পরবর্তী বাংলাদেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি প্রসংগে

28

ডা. হাসান শহীদুল আলম

বাংলাদেশের শ্রম বাজার: ‘দেশে বর্তমানে ৬ কোটি ৪০ লাখের মতো শ্রমিক কাজ করে।এর মধ্যে ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষ কাজ করে কৃষি খাতে। বাকী প্রায় ৪ কোটি শ্রমিক কাজ করে শিল্প ও সেবা খাতে। এর মধ্যে অনানুষ্ঠানিক খাতেই অধিকাংশ শ্রমিক কাজ করে [সময়নিউজ, ১৬-০৪-২০]।’
বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা: ক) ‘করোনা শুরু হওয়ার আগে দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ।এ সময় আয় করার মতো কাজে যুক্ত ছিল ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ।এদিকে প্রায় দুই বছর ধরে চলমান করোনার মধ্যে কাজ বা চাকুরী হারিয়েছে অন্তত ৩০ শতাংশ মানুষ। সেই সংগে আয় কমেছে ৭০ শতাংশ মানুষের। [দেশ রুপান্তর, ১৮-০৩-২২ ]।’ অর্থাৎ করোনার কারণে বেকার বেড়েছে ১ কোটি ৮৮ লাখ। সে হিসাবে বর্তমানে মোট বেকারের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ কোটি ১৫ লাখ।
দক্ষিণ এশিয়ার সাথে তুলনা: ‘দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশী’ ( দেশ রুপান্তর, ১৮-০৩-২২ )।
প্রতি বৎসর বেকার বৃদ্ধির কারণ: প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুন- তরুণী বাংলাদেশের চাকুরীর বাজারে যোগদান করে। তাদের বড় একটা অংশ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পড়াশুনা শেষ করে সরকারী বেসরকারী চাকুরীতে প্রবেশের চেষ্টা করেন।
করোনা পরবতী বাংলাদেশে বেকারত্ব বেড়েছে: ‘গত ১৯ জানুয়রি ২০২১ বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমানে ৫.০৩ শতাংশ যা ২০১০ সালে ছিল ৩.৩৮ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে ৪.২২ শতাংশ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, করোনা ভাইরাস সংকটের কারণে বাংলাদেশে প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন বা বেকার রয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ডিগ্রী আছে এমন বেকারের সংখ্যা ৪ লাখ’ (যায় যায় দিন, ১৯-০৫-২১)। ‘করোনার কারণে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের ৬৬ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলের ৪১ শতাংশ মানুষ চাকুরী হারিয়েছে। সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে,শহরাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মানুষ কর্মহীন হয়েছে ঢাকায়। এখানে ৭৪ শতাংশ মানুষ চাকুরী হারিয়েছে।ঢাকা বিভাগের গ্রামাঞ্চলের ৪৫ শতাংশ মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছেন। গ্রামাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশী কর্মহীন হয়েছে বরিশাল বিভাগে। এখানে কর্মহীন হয়েছে ৪৭ শতাংশ মানুষ’ (রাইজিং বিডি, ১১-০৪-২২)।
বাংলাদেশে করোনার কারনে চাকুরী হারানোর সংখ্যা: ‘বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাবে করোনার কারণে বাংলাদেশে চাকুরী হারানোর তালিকায় যুক্ত হচ্ছে অন্তত দেড় কোটি মানুষ। এই দেড় কোটি মানুষ চাকুরী হারালেও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে অন্তত ৬ কোটি মানুষ (প্রতি পরিবারে গড়ে ৪ জন করে সদস্য)। গার্মেন্টস, ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স ও সরকার এই চারটিখাত ছাড়া বাকী সবই অনানুষ্ঠানিক। করোনায় আনুষ্ঠানিক কর্মজীবী ছাড়া আর সবাই বেকার হয়েছে।বেকারের এই সংখ্যা দেড় থেকে দুই কোটি’ (সময় নিউজ, ১৬-০৪-২০)
বেকারত্বের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি: আমরা এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবটি হলো মূলত ডিজিটাল বিপ্লব। ভবিষ্যতে কলকারখানাগুলোতে ব্যাপক হারে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হবে। শুধু কলকারখানাই নয় যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও আসবে আমূল পরিবর্তন। আগের শিল্প বিপ্লবগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে মানুষ যন্ত্রকে পরিচালনা করছে। কিন্তু চতুর্থ বিপ্লবে যন্ত্রকে উন্নত করা হয়েছে। যার ফলে যন্ত্র নিজেই নিজেকে পরিচালনা করতে পারবে। ফলে শ্রমিকের প্রয়োজন কমে যাবে। এতে বেকারত্ব বাড়বে।
অটোমেশনের ফলে বেকারত্ব বাড়বে: বাংলাদেশী শ্রমিকের বিদেশে আর প্রয়োজন হবে না। বাংলাদেশের গার্মেন্টেস এও এত শ্রমিকের প্রয়োজন হবে না। ভবিষ্যৎ পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যয় মেটাতে ব্যর্থ হবে। সে পরিস্থিতিতে কর্মী ছাঁটাই হবে। ‘বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অগ্রসর প্রযুক্তির ফলে ৫০ শতাংশ চাকুরী চিরকালের মতো হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে’। (সোনার দেশ, ১৭-০৪-২০)
দেশে বেকারত্ব সৃষ্টির কারনসমূহ: ক) দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে দেশের মূল্যবান সম্পদ পাচার হয়ে যাওয়া, খ) শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে উৎপাদন শ্রমিকনির্ভর না হয়ে অধিকতর যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়া, গ) মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে শিল্পায়নে গতিহীনতা, ঘ) অধিক জনসংখ্যার চাপ, ঙ) সরকারের পরিকল্পনাহীনতার কারনে শিক্ষা ব্যবস্থা কর্মমুখী না হয়ে সার্টিফিকেটমুখী হয়ে পড়া, চ) অপরিকল্পিত ভ‚মি ব্যবহার এবং অপরিকল্পিত উৎপাদন ব্যবস্থা, ছ) রাষ্ট্রীয় অবহেলার কারণে সুশাসন ভেংগে পড়া, জ) আত্ম কর্মসংস্থানের সুযোগ যথোপযুক্ত না থাকা।
বাংলাদেশে বেকারত্বের অব্যাহত বৃদ্ধির জাতীয় আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ফলে বাংলাদেশ দীর্ঘসময় সামরিক স্বৈরাচারের অধীনে ছিল। এ সময়ে শাসক শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রীয় লুন্ঠনের একটি সহযোগী শ্রেণী সমাজের বিভিন্ন স্তরে গড়ে উঠে। উক্ত সহযোগী শ্রেণীসমূহ অবৈধ উপায়ে প্রাপ্ত বিশাল অংকের ব্যাংক ঋণ এবং কমিশন এজেন্ট হিসাবে অবৈধভাবে অর্জিত বিশাল অংকের কমিশন হস্তগত করে বিশালাকার লুঠেরা পুঁজি তৈরী করে। লুঠেরা পুঁজিপতিদের আসল উদ্দেশ্য থাকে দ্রæত মুনাফা বৃদ্ধি করা । মাথা খাটিয়ে পরিশ্রম করে ব্যবসা বানিজ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এদের উদ্দেশ্য নয়, কর্মও নয়। এরা অস্ত্র, স্বর্ণ, মাদক, পর্নো ইত্যাদি অবৈধ ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগ করে। এ সব কর্মকান্ডে বিপুল অংকের দেশীয় পুঁজি বিদেশে পাচার হয়ে যায়। এ সমস্ত অবৈধ ব্যবসায়ে প্রয়োজন হয় দূর্নীতিবাজ পুলিশ ও প্রশাসনিক আমলাদের সমর্থন। এরা আইন শৃংখলা বাহিনীকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে। এদের ছায়ায় সমাজবিরোধীরা সদর্পে বিচরণ করতে থাকে। এভাবে সুশাসন ভেংগে পড়ে। বিদেশীরা বিনিয়োগে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ে। দেশে কর্ম সংস্থানের সৃষ্টি হয় না। ফলে বেকারত্ব বাড়তেই থাকে।
সরকারি বেসরকারি চাকুরী প্রার্থীদের থেকে কোটি কোটি টাকা ঘুষ সংগ্রহের জন্য আদর্শহীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সিন্ডিকেট গঠন করতে থাকে দুর্নীতিবাজদের নিয়ে। অযোগ্য প্রার্থীদের ঘুষের বিনিময়ে চাকুরীতে নিয়োগদান করা হতে থাকে। যোগ্য প্রার্থীরা বেকার হতে থাকে। শিক্ষিত বেকার বাড়তে থাকে। উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়। বিপুল হারে দেশত্যাগ করতে থাকে মেধাবী তরুণরা। দেশ মেধাশূন্য হয়ে পড়তে থাকে। ব্যাংক ঋনখেলাপীরা দুর্নীতির দায়ে ভবিষ্যতে সাজা হতে পারে এরুপ আশংকায় বিদেশী নাগরিকত্ব গ্রহণ করে, বিদেশে আবাসন প্রতিষ্ঠা করে বিদেশের হাসপাতালে চিকিৎসা বা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে সন্তানের উচ্চ শিক্ষার ছদ্মাবরণে বিবিধ কৌশল অবলম্বন করে বিপুল হারে অর্থ পাচার করতে থাকে। দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের মতে, এভাবে বৎসরে প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়। দেশে বিনিয়োগ হবার মতো অর্থসম্পদ আর থাকে না। ব্যাংকসমূহ দেউলিয়া হয়ে পড়ে।বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দেয়। বেকারত্ব বাড়তে থাকে।
বেকারত্ব নিরসনকল্পে কতিপয় প্রস্তাব: ক) কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করে বৃত্তিমূলক ও কারিগরী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, খ) সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, গ) জীবনধারনের জন্য ন্যূনতম মজুরী ঠিক করা, ঘ) প্রকৃত উদ্যোক্তারা যাতে ঋন পায় তেমনি ব্যবস্থা করা, ঙ) শ্রমিকদের ভাষাগত দূর্বলতা কাটাতে প্রশিক্ষন দেয়া এবং বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়ানো, চ) দেশে অধিক সংখ্যক শিল্পনগরী গড়ে তোলা।
উপসংহার: এ পর্যন্ত যেটুকু আলোচনা হলো তার সারমর্ম হিসাবে উপসংহারে বলতে চাই যে, বেকারত্ব নিরসনে সবচেয়ে যেটা প্রয়োজন ও কার্যকর সেটা হচ্ছেÑ বাংলাদেশে কমপক্ষে ২০টি শিল্প নগরী বা সোশ্যাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলা যেখানে সব ধরনের বেআইনী কার্যকলাপ বা রাজনৈতিক কর্মকাÐ নিষিদ্ধ থাকবে। এ ধরনের শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারী উদ্যোক্তাদেরও উৎসাহিত করতে হবে এবং বৈদেশিক উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে হবে।
লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগ বিশেষজ্ঞ