করোনার ‘হোঁচট’ সিএমপির সাইবার ফরেনসিক ল্যাবে

11

তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকা সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ এবং এ ধরনের অপরাধের সাথে জড়িতদের শনাক্তের কাজ দ্রæত ও সহজতর করতে সিএমপির কাউন্টার টেররিজম (সিটি) ইউনিটে ‘সাইবার ফরেনসিক ল্যাব’ স্থাপনের কার্যক্রম শুরু করা হয়। জায়গা নির্ধারণের পর দামপাড়ায় দুটি কক্ষে প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট ইনস্টলেশনসহ আনুয়াঙ্গিক কাজ এগিয়ে গেলেও করোনার প্রাদুর্ভাবজনিত বিধি-নিষেধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের এন্টি টেররিজম এসিসট্যান্স (এটিএ) সার্ভিসের প্রশিক্ষক দলের কেউ আসতে পারেননি। ইউনিটের সংশ্লিষ্ট সদস্যরা প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় সাইবার ফরেনসিক ল্যাবের যাত্রাও করোনার ‘হোঁচট’ খেয়েছে।
তবে নগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আশা করছেন, করোনার ধকল সামলে বৈশ্বিক পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চলাচলের পথও ক্রমান্বয়ে উন্মুক্ত হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি সাপেক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রশিক্ষক টিমের সদস্যরা চট্টগ্রামে এসে সাইবার ফরেনসিক ল্যাব পরিচালনার কাজের জন্য নির্বাচিত পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণের কাজও সম্পন্ন করবেন। প্রশিক্ষণ শেষে ল্যাবের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে পুরোদমে চালু করতে আর কোনও বাধা থাকবে না।
নগর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আরাফাতুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, বৈশ্বিক অতিমারি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবজনিত কারণে প্রশিক্ষকদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসায় বিঘœ ঘটেছে। পরিস্থিতির উন্নতি সাপেক্ষে তারা এসে পৌঁছলে ল্যাব পরিচালনার দায়িত্ব পালনে নির্বাচিত পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণের কাজ সম্পন্ন করা হবে। এরপর সাইবার ফরেনসিক ল্যাবের অপারেটিং কার্যক্রম শুরু করতে আর কোনও বাধা থাকবে না।
সিএমপি সূত্র জানায়, ক্রমশ বাড়তে থাকা সাইবার অপরাধ প্রতিরাধে ডিএমপির পর সিএমপিতে দ্বিতীয় সাইবার ফরেনসিক ল্যাব স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়। নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইনে অবস্থিত কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কার্যালয়ে দুটি কক্ষে এ ল্যাব স্থাপন করা হচ্ছে। এতে অতি সহজে অন্ততপক্ষে ১২ ধরনের সাইবার অপরাধী শনাক্ত করা যাবে। ল্যাবের কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এন্টি টেররিজম এসিসট্যান্স (এটিএ)। এ ল্যাব স্থাপিত হলে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের ডিজিটাল ময়না তদন্ত কাজ সম্পন্ন করা যাবে। প্রযুক্তির ক্রমাগত প্রসারের সাথে পাল্লা দিয়ে অপরাধ সংঘটিত করতে অপরাধীরা বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার করছে। ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জারের মত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করেও হরহামেশা নানা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং পুলিশের বিশেষায়িত সংস্থা অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডির ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব রয়েছে। এ কারণে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধ নির্ণয় ও জড়িতদের শনাক্ত করতে এতদিন থানা পুলিশসহ অন্যান্য ইউনিটগুলোকে পুলিশের সিআইডি ও পিবিআইয়ের ল্যাবের উপর নির্ভর করতে হয়। তাতেও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অথচ সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত প্রতিদিন নানা অভিযোগ জমা হচ্ছে নগরীর থানাগুলোতে। থানা থেকে এসব অভিযোগ তদন্তের জন্য পাঠানো হয় কাউন্টার টেররিজম ইউনিটে। আর সাইবার অপরাধের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে নানা ধরনের ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস। এসব ডিভাইস পরীক্ষা করতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সুবিধাসম্বলিত সাইবার ফরেনসিক ল্যাবের বিকল্প নেই।
পুলিশ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সাইবার অপরাধ প্রতিরোধের সক্ষমতা অর্জনে যুক্তরাষ্ট্রের এন্টি টেররিজম এসিসট্যান্সের (এটিএ) সহযোগিতায় সিএমপিতে সাইবার ফরেনসিক ল্যাব স্থাপনের কাজ শুরু হয় ২০২০ সালে। পুলিশের সিটি ইউনিটের কার্যালয়ের দুটি কক্ষে ফরেনসিক ল্যাবের ল্যাপটপসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি বসানো হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ল্যাবের কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে তা বিঘ্নিত হয়। মহামারির কারণে এটির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সময়মত কাজ এগিয়ে নিতে পারেন নি। মাঝপথে থমকে যায়।
সাইবার ফরেনসিক ল্যাবে মূলত চার ধরনের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি থাকছে। এগুলো হল- কম্পিউটার, মোবাইল, অডিও এবং ভিডিও ফরেনসিক। এর মধ্যে কম্পিউটার ফরেনসিকের মাধ্যমে কম্পিউটার ও ডিজিটাল স্টোরেজ মিডিয়া থেকে গোপনীয় ডেটা উদ্ধার ও বিশ্লেষণ, থাম্ব ড্রাইভ, ইন্টারনেট, ল্যাপটপ এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিক ডিভাইস দিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য এবং মূল্যবান ডেটা সংরক্ষণ বা স্থানান্তর করা যাবে। অপরাধ ঢাকতে বা আলামত গায়েব করতে মুছে ফেলা তথ্য, সোআপ ফাইল, মেমোরি ডাম্প, হার্ড ড্রাইভে ফাঁকা ফোল্ডার ও প্রিন্ট স্পুলার ফাইলের ফরেনসিক পরীক্ষা সম্পন্ন করা যাবে। মোবাইল ফরেনসিকের আওতায় রয়েছে- অপরাধ কর্মকান্ডে ব্যবহৃত মোবাইল ফোনসহ এ ধরনের যে কোনও ডিভাইস। ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে মোবাইল ফোন, ট্যাব, জিপিএস, ড্রোন ইত্যাদি থেকে ডেটা উদ্ধার ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে। যেমন- এসএমএস, চ্যাটিং বা এমএমএস জাতীয় মুছে ফেলা ডেটা, কল লগ ও যোগাযোগের তালিকা, ডিভাইসের আইএমইআই ও ইএসএন সম্পর্কিত তথ্য, ওয়েব ব্রাউজিং, ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক সেটিংস, জিওলোকেশন তথ্য, ই-মেইল এবং ইন্টারনেট মিডিয়া ও ফর্ম, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং পরিষেবা, ফেসবুক পোস্ট কা ম্যাসেঞ্জারের মত অ্যাপভিত্তিক ডেটা এবং ক্লাউড ড্রাইভে সংরক্ষিত ডেটা স্বল্প সময়ের মধ্যেই উদ্ধার ও বিশ্লেষণ করা যাবে।
এ ছাড়া অডিও ফরেনসিকের মধ্যে রয়েছে- ভয়েস বা অডিও ক্লিপ প্রমাণের সত্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য ফরেনসিক পরীক্ষা, কথোপকথন শনাক্তকরণ ও সংলাপ লিপিবদ্ধকরণ ইত্যাদি। আর ভিডিও ফরেনসিকের মধ্যে ডিজিটাল (ডিভিআর) এবং অ্যানালগ ভিডিও প্রসেসিং, ডেমাল্টিপ্লেক্স ভিডিও, ভিডিও থেকে স্টিল- ফ্রেম বের করা, স্টিল পিকচার বা ডিজিটাল ফাইলের ফ্রেম মুদ্রণ এবং অডিও-ভিডিওর নির্দিষ্ট অঞ্চল ট্র্যাক করে তথ্য নিয়ে তা ল্যাবে পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে অপরাধী শনাক্ত করা।