ঐক্যের আশায় আলোচনা হলেও দোলাচলে নেতারা

18

পূর্বদেশ ডেস্ক

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দাবি আদায়ে যুগপৎ আন্দোলনের জন্য রাজনৈতিক ঐক্যের আশায় দৃশ্যত বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হলেও চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন নিয়ে দোলাচলে রয়েছেন নেতারা। পাশাপাশি কোনপথে লক্ষ্য অর্জন হবে, এ নিয়ে বিরোধী দলগুলোতে সন্দেহ বিরাজ করছে। গত কয়েক দিনে বিএনপিসহ বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপকালে এ বিষয়টি উঠে আসে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারকে দাবি আদায়ে চাপে রাখতে গত ২৪ মে থেকে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক শুরু করে বিএনপি। এ পর্যন্ত নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও লেবার পার্টির সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন দলটির নেতারা।
এসব আলোচনায় সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন করার বিষয়ে প্রকাশ্যে বিএনপির সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে দলগুলো। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আলোচনা প্রাথমিক পর্বে রয়েছে। আবারও আলোচনা শেষে সবার দাবি এক করে একটি সমন্বিত রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে। চলতি জুনে আরও অনেক দলের সঙ্গে মতবিনিময় করবে বিএনপি।
গত কয়েক দিনে অন্তত ১০ জন বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে আলাপ হয়। আলাপে নেতারা জানিয়েছেন, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ; নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন এবং সেই কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি নিয়ে বিরোধী দলগুলো ঐকমত্য হয়েছে। তবে ক্ষমতার প্রশ্নে সূ²ভাবে অমীমাংসিত দ্ব›েদ্ব জড়িয়েছেন নেতারা। আর এ দ্ব›দ্বকে ঘিরেই কার্যত সন্দেহ কাজ করছে দলগুলোর নেতাদের মধ্যে। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
ইতোমধ্যে সংঘটিত সাত দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেছেন, আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়ে সবাই একমত। সেক্ষেত্রে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে বিএনপির চিন্তা রয়েছে। অন্তর্র্বর্তীকালীন সেই সরকারের মেয়াদ কত হবে, এ নিয়েও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর মতপার্থক্য রয়েছে।’
প্রভাবশালী এই নেতা বলেন, ‘বিএনপি মনে করে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ হওয়া উচিত ৩ মাস। অন্যরা মনে করে এর বেশি। বেশি সময় নেওয়ার বিষয়টিতে বিএনপির ভয় হচ্ছে নতুন রাজনীতির উত্থান। যারা অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারে অংশগ্রহণ করবে, তারা যদি নতুন রাজনীতি সামনে আনতে সক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে বিএনপির নেতাকর্মীরা আকৃষ্ট হবে, এমন ভয়ও তাদের আছে।’
কেন সময়সীমা বেশি হওয়া উচিত, ব্যাখ্যায় সাত দলের অন্যতম এই নেতার ভাষ্য, ‘লাখ-লাখ মানুষের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার ছাড়া কি নতুন নির্বাচন হবে? এই মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা; গুম-খুনের বিচার করা; বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা, নির্বাচন কমিশন গঠন ইত্যাদি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে সময় প্রয়োজন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘ইনফ্যাক্ট ফরমালি কোনও আলোচনা হয়নি। তবে ইনফরমালি কথা হচ্ছে। আমরা সবাই বলছি এই সরকারের পদত্যাগের কথা। এরপর কী হবে। কেউ বলছে ইন্টারিন গভর্নমেন্ট, কেউ বলছে কেয়ারটেকার, কেউ বলছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার। এসব নিয়ে বিতর্ক করা যায়। কেয়ারটেকার মানে কেবল নির্বাচন করবে। নিরপেক্ষ মানে কোনও দলের বিরুদ্ধে কিছু করবে না, সরকার গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবে।’
গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের মেয়াদ নিয়ে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সন্দেহজনক অবস্থার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এক দাবি, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ। তাদের পতন চাই। তারপর দেখা যাবে। ’ বিএনপির প্রভাবশালী একজন দায়িত্বশীল দাবি করেন, দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থা এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অন্তর্নিহিত রহস্য ধরে ফেলেছে। তারা বুঝতে পেরেছে বিএনপি এককভাবে ক্ষমতায় আসতে পারছে না। এ কারণে তারা একমঞ্চে না উঠে যুগপৎ কর্মসূচির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিশেষত, উভয় পক্ষের সঙ্গে যেন দরকষাকষি করার সুযোগ থাকে, সেদিকে লক্ষ রেখে ছোট দলগুলো আলাদা-আলাদা করে শক্তি প্রদর্শনের পক্ষে।
এ প্রসঙ্গে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘সমঝোতা বা দরকষাকষির কোনও প্রশ্নই নেই। সাত দলের ঐক্যের প্রাথমিক ভিত্তি হচ্ছে এই সরকারের পদত্যাগ’
বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা মনে করেন, বিরোধী দলগুলোকে ঠকিয়ে বিএনপি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন হবে না। বরং বোঝাপড়া আরও ঘনিষ্ঠ ও স্পষ্ট করে কর্মসূচির দিকে গেলে উদ্দেশ্য সাধন হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা কোনও অবস্থাতেই আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনও নির্বাচনে যাবো না। এরকম কোনও চিন্তা-ভাবনার সুযোগ নাই। কিন্তু এটা ঠিক যে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই বন্ধু বাড়াতে চাইবে। তারা জানে ১৪ দল দিয়ে হবে না। তারা ইতোমধ্যে নেমে পড়েছে; দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছে।’
গণফোরাম একাংশের সঙ্গে মতবিনিময় করতে বিএনপির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে। দলটির কাছে তাদের কার্যালয়ে যেতে সময় চাওয়া হয়েছে। জানতে চাইলে সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ হয়েছে। তারা সময় চেয়েছেন। আমাদের মতবিনিময় হবে।’‘ক্ষমতাসীনদের শুভানুধ্যায়ী কেউ কেউ সহযোগিতার কথা বলছে’ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আসন ভাগাভাগির নির্বাচনে যাবো না। আমরা খোলাখুলি বলছি, নিউট্রাল সরকার ছাড়া কোনও নির্বাচনে গণফোরাম যাবে না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও প্রভাবশালী সূত্রগুলো বলছে, দেশি ও আন্তর্জাতিক শক্তির চাপ তৈরি হলে এবং সব রাজনৈতিক দলকে অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে সক্ষমতা দেখালে নির্বাচনে যেতে পারে বিএনপি। এক্ষেত্রে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নেবেন তারা।
তবে জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে বিগত দিনের মতো ‘মাখামাখি’ সম্পর্কে যাচ্ছে না বিএনপি। বর্তমানে জামায়াতের সঙ্গে দৃশ্যমান দূরত্ব, সেটিও উভয় দলের সমঝোতার মধ্যেই সৃষ্ট বলে জানিয়েছেন বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল। তারা জানান, কেবল নির্বাচনে আসনভিত্তিক সমঝোতা ছাড়া আপাতত জামায়াতকে বিএনপির পাশে দেখা যাচ্ছে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা বলছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কোনও কারণ নাই। যারা আওয়ামী লীগ করে তারাও এটা জানে।’ আসনভিত্তিক সমঝোতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইস্যু তো আসনের না; নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন না দিলে বিএনপি ২০০ আসন দিলেও যাবে না। আমাদের আসন দেবে জনগণ। দেশের মালিক জনগণ, তারা ভোটের মাধ্যমে যাকে নির্বাচন করবে তারা যাবে সংসদে। আসনের খেলা আর চলবে না।’