এ বছরই কি দেশে তাপপ্রবাহ সবচেয়ে দীর্ঘ হবে?

4

বিবিসি বাংলা

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ শেষ হতে পারেনি। ইতোমধ্যে ঢাকা-সহ দেশের মোট চারটি বিভাগের বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়েই মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বইছে। তাই এসব এলাকায় তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা বা ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই এপ্রিল মাসে গড়ে সাধারণত দুই-তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ ও এক-দু’টি তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। তবে তারা আশঙ্কা করছেন, এ বছরের তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তিকাল বিগত বছরগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশে কোনও স্থানের তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে সেখানে সতর্কবার্তা জারি করা হয়। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর গত ৩ এপ্রিল, বুধবার বিকেল তিনটায় যে আবহাওয়ার সতর্কবার্তা দেয়, তাতে বলা হয় যে ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া চলমান তাপপ্রবাহ পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। এতে আরও বলা হয় যে চলমান তাপপ্রবাহের কারণে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের তাপমাত্রাও বাড়তে পারে। কোনও বিশাল এলাকা জুড়ে যখন তাপপ্রবাহ হয়, তখন এরকম সতর্কবার্তা দেওয়া হয়, বলেন আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক।
তিনি জানান, যে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় গত কয়েকদিন ধরে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা বয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে চুয়াডাঙ্গা ও ঈশ্বরদীতে। বৃহস্পতিবার, চৌঠা এপ্রিল আবহাওয়া অফিসের সকাল নয়টার পূর্বাভাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় এই দুই এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত এটিই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বলে জানান ড. মল্লিক। বিদ্যমান তাপপ্রবাহের কারণে বাতাসে এখন জলীয় বাষ্পের আধিক্য থাকবে। এতে করে মানুষের শরীরে অস্বস্তিবোধ বৃদ্ধি হতে পারে, যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশে সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসকে বছরের উষ্ণতম সময় ধরা হয়। এর মধ্যে এপ্রিল মাসেই সাধারণত তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি থাকে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোর ক্ষেত্রে ২০১৪, ২০১৬, ২০১৯, ২০২২ ও ২০২৩ সাল ছিল উত্তপ্ত বছর। কিন্তু এগুলোর মাঝে ২০২৩ সালের কথা আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য। আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ বলেন, গত বছর চরম তাপপ্রবাহ ছিল। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সারা দেশে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় জুড়ে তাপপ্রবাহ ছিল। তিনি মনে করেন, গতবার দেশে রেকর্ডধারী তাপমাত্রা ছিল। সেই তুলনায় এবার তো এখনও কম আছে। শুধু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে না, সারা বিশ্বেই ২০২৩ সাল উষ্ণতম বছর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। ওই বছর বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহকে আবহাওয়াবিদ মল্লিক সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে, ঐ বছরের তাপপ্রবাহকে ‘এক্সট্রাঅর্ডিনারি’ তাপপ্রবাহ বলে। তিনি আরও জানান, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে একটানা ২০ থেকে ২৩ দিন তাপপ্রবাহ ছিল।
বর্তমানে বাংলাদেশে যে তাপমাত্রা বিরাজ করছে, তা ৮ ও ৯ এপ্রিল নাগাদ কিছুটা কমতে পারে। আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেন, এপ্রিল উষ্ণতম মাস, এসময় তাপমাত্রা এমনিতেও বেশি থাকে। কিন্তু এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়া দরকার। যখন ঝড় হয়, তখন ভারি বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা আর বাড়ে না। কিন্তু আট-নয় তারিখের আগে ভারি বৃষ্টি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই, তিনি যোগ করেন। এদিকে তাপপ্রবাহ কতদিন থাকবে, তার সুনির্দিষ্ট কোনও প্যাটার্ন নেই। তবে তীব্র তাপপ্রবাহ সাধারণত গড়ে তিন থেকে সাতদিন ধরে চলে। মৃদু তাপপ্রবাহের দৈর্ঘ্য আবার অনেক বেশি থাকে। বাংলাদেশে মৃদু তাপপ্রবাহ সর্বোচ্চ ২৩ দিন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হওয়ারও রেকর্ড রয়েছে বলে জানান মি. মল্লিক। তিনি মনে করেন, তাপপ্রবাহ দীর্ঘায়িত হলে তা নিয়ন্ত্রণে আসার জন্য বজ্রবৃষ্টি দরকার।
অনেকদিন ধরে তাপপ্রবাহ হলে কোনও কোনও এলাকার বায়ুরচাপ কমে যায়। বায়ুরচাপ কমলে সাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্প বাতাসের কোথাও জড়ো হতে শুরু করে এবং তখন সেখানে বজ্রমেঘ তৈরি হয়। পরবর্তীতে সেই মেঘ বৃষ্টিপাত ঘটায়, তিনি ব্যাখ্যা করেন। বাংলাদেশ বা ভারতের বিহার, আসাম, উড়িষ্যা, মেঘালয়, ত্রিপুরা, দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশে তাপপ্রবাহ বিদ্যমান। তাই, তাপমাত্রা কমিয়ে দেওয়ার একমাত্র মাধ্যম হলো বজ্রবৃষ্টি।
এটা ঠিক যে বাংলাদেশে এপ্রিল মাস উষ্ণতম। কিন্তু প্রতি বছর এপ্রিল মাসে তাপপ্রবাহ শুরু হয় না। কোনও কোনও বছর এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহেই তাপপ্রবাহ শুরু হয়। আবার কোনও কোনও বছর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের পর তাপপ্রবাহ শুরু হতে দেখা দেয়। আবহাওয়াবিদ মল্লিক বলেন, তাপপ্রবাহ শুরু হওয়ার কোনও পর্যায়ভিত্তিক আবর্তনরীতি নাই। এই মাসের এক তারিখ তাপপ্রবাহ হল, আগামী বছরও যে একই তারিখে হবে, বিষয়টা এমন না। ২০১৪ সাল ছিল বাংলাদেশের উষ্ণতম বছরগুলোর মাঝে অন্যতম। সে বছর ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ২৪ এপ্রিল, ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ২৪ এপ্রিলেই, ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১৮ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩২ দশমিক পাঁচ ডিগ্রি।
২০১৯ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৩৭ দশমিক এক ডিগ্রি। আবার, ২০২০ সালে আবার ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৭ এপ্রিল, ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর পরের তিন বছরেও কখনও এপ্রিলের শেষে, কখনও বা মার্চের শেষে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের এসব তথ্য থেকে বোঝা যায় যে তাপপ্রবাহ একই আবর্তনে চলে না।