এগিয়ে যাচ্ছে দৈনিক পূর্বদেশ

67

কমরুদ্দিন আহমদ

অনুকায় পিঁপড়া হতে অতিকায় হাতি পর্যন্ত সবার খবর ধারণ করে ১২.১২.২০১২ তে ‘চাটগাঁর খবর সবার আগে’ ¯েøাগান ধারণ করে যাত্রা শুরু করেছিল দৈনিক পূর্বদেশ। হাঁটিহাঁটি পা পা করে আজ দৈনিক পূর্বদেশ ১০ম বর্ষে পদার্পণ করলো। সম্পাদক ও পূর্বদেশ পরিবার পত্রিকার অগণিত পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপন দাতা, কর্মরত সাংবাদিকসহ সকল শুভানুধ্যায়ীকে শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করছে। বাংলা ভাষায় মুদ্রিত সংবাদপত্রের জনক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। ঈশ্বর গুপ্তের সম্পাদনায় ‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রথমে সাপ্তাহিক পরে বাংলা দৈনিকে রূপান্তরিত হয়। ১৮৩১ সালে এ উপমহাদেশে ‘সংবাদ প্রভাকর’ শিরোনামে যে বাংলা দৈনিক পত্রিকার যাত্রা শুরু হয় তা বর্তমান পর্যন্ত অব্যাহত আছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিশ্বব্যাপী দাপটের সাথে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিশ্বের এক প্রান্তে কি ঘটছে তা সব প্রান্তে দ্রæত দেখতে পাচ্ছে বিশ্ববাসী। খবর শোনার পাশাপাশি ঘটনার আদ্যোপান্ত দেখতে পাচ্ছে। তবু সংবাদপত্রের গুরুত্ব এতটুকু কমেনি। কেননা টেলিভিশনে আমরা খবর শুনি ও দেখি কিন্তু তা আমাদের কাছে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয় না। অবচেতন মনের দৌরাত্ম্যে পড়ে আদ্যোপান্ত কোথাও বর্ণনা করতে চাইলে তার বিস্তারিত তথ্য পূর্ণদৃষ্টি কিংবা পূর্ণশ্রবণ সকলের জন্য স্বাচ্ছন্দ্য থাকে না। সংবাদপত্র বিশ্বে ঘটে যাওয়া ঘটনার ইতিহাস বা স্থায়ী ডকুমেন্ট হয়ে বর্তমানকে যেমন মূর্ত করে তেমনি ভবিষ্যতেও উদ্ধৃতি কাজে লাগে। ঢেকিছাঁটা চাল আর রাইচ মিলের চালের যে পার্থক্য সংবাদপত্র আর টেলিভিশন, ইন্টারনেটের সংবাদের পার্থক্য একি রকম। সনাতন পদ্ধতির সুবিধা কম কিন্তু ডিজিটাল পদ্ধতি মারাত্মক অসুবিধাগুলো সনাতন পদ্ধতিতে নেই। ভেষজ গ্রহণ আর ওষুধ গ্রহণের মধ্যে যে পার্থক্য, সনাতন পদ্ধতি আর ডিজিটাল পদ্ধতির পার্থক্য তেমনই। ভেষজ সেবনে আর যাই হোক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, ওষুধে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। সংবাদপত্র সাহিত্য নয়, জ্ঞানের কথা, কাল পরম্পরায় ইতিহাস, ঐতিহ্যের স্মারক। সাহিত্যের মতো এর শাশ্বত আবেদন না থাকলেও সংবাদপত্র ইতিহাসের ঘটনাবলীর মতো প্রয়োজনে কাজে আসে। সাহিত্য ভাবের কথা। ভাবের কথা চির নতুন। সংবাদ সাহিত্যে পরিবেশিত হলে একদিকে শাশ্বত আবেদন সৃষ্টি করে, অন্যদিকে কালের ঘটনা বা সংবাদকে শাশ্বত মূল্যমানে বাঁচিয়ে রাখে। সংবাদপত্র জন্মলগ্ন থেকে সাহিত্যের প্রচার ও লালন করেছে। কবি ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত প্রথম সংবাদ প্রভাকরে সমালোচনা ও সাহিত্যের আলোচনার সূত্রপাত করেন। তাঁর সংবাদ প্রভাকরে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, মীর মোশাররফ হোসেনসহ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম পর্বের দিকপালরা লিখে হাত পাকান। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিকাশে সংবাদ পত্রের ভূমিকা অপরিসীম।
চট্টগ্রাম বাংলাদেশের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ একটি প্রাচীন শহর। ঢাকা দেশের রাজধানী হলেও আমাদের ভাষা, সংবাদপত্র এবং সাহিত্যের জন্মলগ্ন থেকে চট্টগ্রামের অবদান রয়েছে। দেশের ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রামের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। সংবাদপত্রের ইতিহাসে রাজধানী ঢাকার পরেই চট্টগ্রামের স্থান। ঢাকা বাদে অন্যান্য বিভাগীয় শহরের চেয়ে চট্টগ্রামের সংবাদপত্র শিল্প গুণে ও মানে সেরা। এখানে আজাদী, পূর্বকোণের মতো মানসম্পন্ন পত্রিকা থাকা সত্তে¡ও ১২.১২.২০১২ তে নতুন করে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার রাজকীয় যাত্রা শুরু হয়। দৈনিক আজাদীর ৫০ বছরেরও অধিক দাপটে যাত্রা এবং এখানকার সংবাদপত্র শিল্পের মানসম্পন্ন আভিজাত্য গড়ে তোলার লক্ষে দৈনিক পূর্বকোণ দীর্ঘদিন তার যাত্রা অব্যাহত রাখার পর দৈনিক পূর্বদেশের গজেন্দ্র গমন বিস্ময়কর। চট্টগ্রামে বহু দৈনিক পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়। কিন্তু তারা আজাদী-পূর্বকোণের সাথে তুলনায় আসে না। মাত্র চার বছরের মধ্যে আজাদী-পূর্বকোণের সাথে পাল্লা দিয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সত্তা বজায় রেখে পাঠকনন্দিত দৈনিক পত্রিকায় পরিণত হতে পেরেছে পূর্বদেশ। যেকেউ আমাদের কথার সত্যতা যাচাই করে দেখতে চাইলে ফলাফল হাতে হাতে পেয়ে যাবেন। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান জেলা ঘুরে আসলে দেখা যাবে মিরসরাই থেকে টেকনাফ পর্যন্ত চট্টগ্রামের অন্যকোন পত্রিকা পূর্বদেশের মতো গুরুত্ব সহকারে সর্বস্তরের পাঠকের কাছে শোভা পেতে দেখা যায় না। মাত্র চার বছর অতিক্রম করলো চট্টগ্রামের পাঠক নন্দিত দৈনিক পূর্বদেশ। চট্টগ্রামের সংবাদ পত্রের ইতিহাসে এটা একটি বিস্ময়কর ঘটনা। কোন কোন পত্রিকা ১৫-২০ বছরেও পাঠকের হাতে মর্যাদার সাথে শোভা পেতে দেখা যায়নি। তুল্যমূল্য বিচারে পূর্বদেশ চট্টগ্রামের সংবাদপত্রের ইতিহাসে একটি চমক। চমক এই কারণে যে, আজাদী-পূর্বকোণের মতো পত্রিকার পাশাপাশি পূর্বদেশ স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে সহজেই ভদ্রলোকের ড্রয়িং রুম থেকে সেলুনের দোকান এমনকি তরকারির বাজার পর্যন্ত পৌঁছেছে। বাস্তবতার নিরিখে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে চট্টগ্রামের যে কোন পত্রিকার চেয়ে দৈনিক পূর্বদেশের প্রচারসংখ্যা কম সময়ের মধ্যে ঈর্ষণীয়।
আলহাজ মাস্টার নজির আহমদ দৈনিক পূর্বদেশ এর প্রতিষ্ঠাতা। মাস্টার নজির আহমদ তাঁর জীবদ্দশায় স্মার্ট গ্রæপ নামে একটি শিল্প গ্রæপ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি এলাকার শিক্ষা বিস্তারে প্রতিষ্ঠা করেন কলেজ প্রাথমিক বিদ্যালয়, ক্যাডেট মাদ্্রাসা, হেফজখানা ও এতিমখানা ইত্যাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান । তিনি মূলত একজন সমাজহিতৈষী, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব। চট্টগ্রামের লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, সাধারণ মানুষের হৃদয়ের দুঃখ যন্ত্রণা, অভাব-অনটন, এলাকার উন্নয়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। দেশের খ্যাতনামা সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী কামাল লোহানি প্রধান সম্পাদক, ওসমান গণি মনসুর সম্পাদক, আবু সাঈদ জুবেরি নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। শুরু থেকে এ পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন আলহাজ মুজিবুর রহমান সিআইপি। প্রকাশক আলহাজ শফিকুর রহমান। পত্রিকার শুরু থেকে প্রখ্যাত লেখক, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা এ পত্রিকায় লেখালিখি করতে থাকেন। প্রবীণ-নবীন একঝাঁক প্রতিশ্রæতিশীল সাংবাদিক এ পত্রিকায় কাজ করছেন। জাতীয় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দেশের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন ছাড়াও সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিল্প-বাণিজ্য, ইতিহাস ঐতিহ্য, আনন্দ-বিনোদন, ক্রীড়া ইত্যাদি বিষয়ে আলাদা পাতার মাধ্যমে বিজ্ঞপাঠক থেকে সাধারণ পাঠক পর্যন্ত সকলের পাঠ চাহিদা মিটানোর প্রয়াস রয়েছে দৈনিক পূর্বদেশের। সম্পাদকীয় বিভাগে দেশের এবং স্থানীয় সমসাময়িক অর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিরন্তর লিখে চলেছেন একদল প্রবীণ নবীন মেধাবী বুদ্ধিজীবী। মান সম্পন্ন সাহিত্য সাময়িকী ছাড়াও ফিচারপাতা সমূহে বিচিত্র বিষয়ের চমৎকার উপস্থাপনা মনোমুগ্ধকর। এ পত্রিকার গেটাপ-ম্যাকাপ জাতীয় পত্রিকার মতোই দৃষ্টিনন্দন। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো একটি মান সম্পন্ন সংবাদপত্রের সবক’টি বিভাগ যতœ সহকারে সম্পাদনার পাশাপাশি ‘পূর্বদেশ’ নামটি এ অঞ্চলের পাঠক সমাজকে বেশি পরিমাণে আকৃষ্ট করেছে। কেননা বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বৃহত্তর চট্টগ্রামের সার্বিক কন্ঠস্বর হিসেবে পূর্বদেশ নামটি এ পত্রিকার ভৌগোলিক অবস্থান ও জনগণের অন্তর জয় ও চাহিদা মেটানোর শিরোনাম হয়েছে স্বল্পসময়ের মধ্যেই। বর্তমানে পূর্বদেশ নামটি পাঠকের অন্তরে গেঁথে গিয়েছে। পূর্বদেশ তো কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন নয়। নামের মধ্যেই বৃহত্তর চট্টগ্রামের মুখপাত্রের ইঙ্গিত রয়েছে। যে কারণে পূর্বদেশ নাম দ্রæত পাঠকের হৃদয়ঙ্গম হয়ে গেছে। দৈনিক পূর্বদেশ নামটির একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বও রয়েছে। তা হলো- এ পত্রিকাটি দেশ স্বাধীনের পূর্বে জাতীয় পত্রিকা হিসেবে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতো। আবদুল গফ্্ফার চৌধুরী, খন্দকার আবদুল মোতালেব, কামাল লোহানির মতো বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা পূর্বদেশের সাথে জড়িত ছিলেন। এ দেশের নাম ‘বাংলাদেশ’ নামটিও তৎকালীন পূর্বদেশ পত্রিকার বুদ্ধিজীবীরাই নির্ধারণ করেছেন বলে আমরা কামাল লোহানির প্রবন্ধ থেকে জেনেছি। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও পূর্বদেশ পত্রিকার বিশেষ ভূমিকা ছিল। কিন্তু কোনো অজানা কারণে দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৩ সালে দৈনিক পূর্বদেশের প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। আলহাজ্ব মাস্টার নজির আহমদ দেশের মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থানের লক্ষে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি স্বাধীনতা পূর্বকালের জনপ্রিয় পত্রিকা পূর্বদেশ নামটি ব্যবহার করে চট্টগ্রাম থেকে তার নতুন যাত্রার সূচনা করেন। দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ ও বাণিজ্য সম্পাদক আলহাজ্ব মুজিবুর রহমান সিআইপি। চট্টগ্রামের সাংবাদপত্রের জগতে দৈনিক পূর্বদেশ বিজ্ঞতা ও তারুণ্যের স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পদ্মা, যমুনা, কর্ণফুলী, শঙ্খের মতো নিরন্তর। আজ পূর্বদেশ পত্রিকার নবম বছর পূর্তিতে এ পত্রিকার অগণিত পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপন দাতা, কর্মরত, সাংবাদিকসহ সকল শুভানুধ্যায়ীকে পূর্বদেশ পরিবার শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করছে। সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকতায় পূর্বদেশ আগামীতে আরো সাবলীলভাবে এগিয়ে যাবে তারুণ্যের অদম্য শক্তিতে, সর্বস্তরের মানুষ ও দেশের কল্যাণে। এমন কামনা পূর্বদেশ পরিবারের।
জয়তু দৈনিক পূর্বদেশ।
লেখক : কবি, গবেষক, সহকারী অধ্যাপক- বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ