এখনো নির্ভর করতে হয় পেশাদার রক্তদাতার ওপর

11

ফারুক আবদুল্লাহ

মানুষকে ভালোবেসে যত কাজ করা যায়, তার অন্যতম হলো রক্তদান। অন্যকে রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে যেমন তার জীবন বাঁচানো যায়, তেমনি রক্তদান করলে রক্তদাতার নিজের শরীরেরও উপকার হয়। দুর্ঘটনায় আহত, ক্যান্সার বা অন্য কোনো জটিল রোগ, অস্ত্রোপচার কিংবা সন্তান প্রসব অথবা থ্যালাসেমিয়ার মতো বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় প্রয়োজন হয় রক্তের।
তবে বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় রক্তদাতার সংখ্যা এখনো নগণ্য। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে বছরে আট থেকে নয় লাখ ব্যাগ রক্তের চাহিদা থাকলেও রক্ত সংগ্রহ হয় ছয় থেকে সাড়ে ছয় লাখ ব্যাগ। ঘাটতি থাকে তিন লাখ ব্যাগের বেশি। এছাড়া সংগ্রহকৃত রক্তের মাত্র ৩০ শতাংশ আসে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের থেকে। নিজের পরিবারের সদস্য বা পরিচিতজন না হলে এখনো বেশিরভাগ মানুষ রক্তের জন্য নির্ভর করেন পেশাদার রক্তদাতার ওপর। রক্তের অভাবের কারণে প্রতিবছর বহু রোগীর প্রাণ সংকটের মুখ পড়ে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড এলাকায় অগ্নিকান্ডের পর বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এসময় তাৎক্ষণিক আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আহতদের চিকিৎসায় প্রয়োজন হয় বিভিন্ন গ্রুপের রক্ত। তা তাৎক্ষণিক ছড়িয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।এসময় হাজারো মানুষ রক্তের প্রয়োজনে হাসপাতালের আসার আহবান জানিয়ে যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দেন। মুহূর্তে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বেচ্ছায় রক্তদানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ছুটে আসেন। একপর্যায়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আর রক্তের প্রয়োজন নেই বলে জানাতে বাধ্য হন। এমন মানবিক দৃশ্য আগে কখনো দেখেনি চট্টগ্রাম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণ মানুষের মাঝে রক্তদানে সচেতনতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার পর তাৎক্ষণিক রক্তদানে ছুটে আসা মানুষের ভিড় দেখে বুঝা যায়। রক্তদানে আরও বেশি সচেতনতা বাড়াতে হবে। যাতে কোন রোগী রক্তের প্রয়োজনে সংকটে না পড়ে।
আজ মঙ্গলবার (১৪ জুন) বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। সারা বিশ্বের মতো চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হবে। ২০০৪ সাল থেকে নিরাপদ রক্ত নিশ্চিত করতে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এবারের দিবস পালনে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি এগিয়ে এসেছে চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে চার লাখ রক্তদাতার সর্বোচ্চ ডোনার পুল নিয়ে মানবিক সংগঠন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবারের রক্তদাতা দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে, ‘রক্তদান সংঘবদ্ধতারই প্রকাশ, এ কাজে যুক্ত হোন, জীবন বাঁচান’।
এদিকে সন্ধানী ব্লাড ব্যাংক ১৯৭৭ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রথম যাত্রা শুরু করে। এরপর ১৯৮২ সালের ২ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে কার্যক্রম শুরু করে। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শাখা থেকে প্রতিবছর ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার ইউনিট রক্ত সংগ্রহ করে সন্ধানী ব্লাড ব্যাংক। তবে করোনার আগে প্রতিবছর সংগ্রহ ছিল ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার। করোনার কারণে রক্তদাতা ডোনারদের সংখ্যা কমে যায়।
সন্ধানী ব্লাড ব্যাংক, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক তাহিয়্যা করিম রামিসা বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫৫ শতাংশ রক্তের চাহিদা জোগান দিয়ে থাকে সন্ধানী বøাড ব্যাংক চমেক ইউনিট। প্রতিবছর এই ইউনিট থেকে কমপক্ষে ৩ থেকে সাড়ে সাড়ে ৩ হাজার ইউনিট রক্ত সংগ্রহ করা হয়। যা করোনার আগে ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার সংগ্রহ করা হতো।
তিনি বলেন, রক্ত নেওয়ার আগে রক্তদাতার স্ক্রিনিং টেস্ট করা হয়। এতে যদি রক্তদাতার কোন রোগ পজেটিভ আসে, তাহলে আমরা রক্তদাতাকে আমাদের অফিসে আসতে বলি। তারপর তাকে এই রোগের বিষয়ে কাউন্সিলিং করি। কিভাবে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় সেই বিষয়ে তাকে পরামর্শ দিই। এছাড়া রক্ত কালেকশনে থাকলে সহজে রক্ত প্রদান করা হয়ে থাকে। তবে সব রোগীদের কালেকশনে থাকা রক্ত দেওয়া যায় না। সেক্ষত্রে আমরা তাদের রক্তের ডোনার ঠিক করে দিই।
কারা রক্ত দিতে পারবেন: চিকিৎসকদের মতে প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ নারী-পুরুষ চাইলেই নির্দিষ্ট সময় পরপর রক্ত দিতে পারেন। রক্ত নেয়ার আগে এর সঠিক পরীক্ষা নিরীক্ষা জরুরি। ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সের মধ্যে শারীরিকভাবে সুস্থ নারী ও পুরুষ রক্ত দিতে সক্ষম। এক্ষেত্রে পুরুষের ওজন থাকতে হবে অন্তত ৪৮ কেজি এবং নারীর অন্তত ৪৫ কেজি। এছাড়া রক্তদানের সময় রক্তদাতার তাপমাত্রা ৯৯.৫ ফারেনহাইটের নিচে এবং নাড়ির গতি ৭০ থেকে ৯০ এর মধ্যে এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকতে হবে।
পুরুষদের ক্ষেত্রে রক্তের হিমোগ্লোবিন প্রতি ডেসিলিটারে ১৫ গ্রাম এবং নারীদের ক্ষেত্রে ১৪ গ্রাম হওয়া দরকার। রক্তদাতাকে অবশ্যই ভাইরাসজনিত রোগ, শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং চর্মরোগ মুক্ত থাকতে হবে। সাধারণত ৯০ দিন পর পর, অর্থাৎ তিন মাস পর পর রক্ত দেওয়া যাবে।
রক্ত দেয়ার সময় শরীর থেকে ২৫০-৩০০ মিলিগ্রাম আয়রণ কমে যায়। সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের শরীরে ৪ থেকে ৬ লিটার পরিমাণ রক্ত থাকে। প্রতিবার ৪৫০ মিলিলিটার রক্ত দেয়া হয়। এ কারণে রক্ত দিলে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই নেই।

রক্ত দেয়ার পর কী হয়: রক্ত দেয়ার পর কিছুটা মাথা ঘোরাতে পারে। এটা স্বাভাবিক। তবে এ সময় হাঁটাহাঁটি না করে অন্তত এক থেকে দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। রক্তদাতা যদি ঘামতে থাকেন এবং অস্থিরতা বেড়ে যায়, তবে তাকে স্যালাইন খাওয়ানোর পরামর্শ তাদের। এছাড়া রক্ত দেয়ার সময় শরীর থেকে রক্তের পাশাপাশি ২৫০-৩০০ মিলিগ্রাম আয়রণ কমে যায় তাই তার ক্ষয়পূরণে আয়রণ ও প্রোটিনযুক্ত খাবার বেশি বেশি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

রক্ত দেয়ার উপকারিতা: এতে একজন মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব। নিয়মিত রক্তদাতাদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। বছরে তিনবার রক্ত দিলে শরীরে নতুন লোহিত কণিকা তৈরির হার বেড়ে যায়, এতে অস্থিমজ্জা সক্রিয় থাকে। দ্রুত রক্ত স্বল্পতা পূরণ হয়। রক্তে কোলেস্টরেলের মাত্রা কমে যায়, এতে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। রক্ত দিলে যে ক্যালোরি খরচ হয়, তা ওজন কমানোর ক্ষেত্রে ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। শরীরে হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, জন্ডিস, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, এইচআইভি বা এইডসের মতো বড় কোন রোগ আছে কি না, সেটি বিনা খরচে জানা যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। রক্তদাতার যদি নিজের কখনো রক্তের প্রয়োজন হয় তাহলে বøাড ব্যাংকগুলো তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে রক্তের ব্যবস্থা করে দেয়।