ঈদে মিলাদুন্নবী ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত সার্বজনীন পুণ্যময় একটি কাজ

136

সমগ্র সৃষ্টি জগতের সৃষ্টির উৎস,রাহমাতুল্লিল আলামীন,মানবতার মুক্তির দূত,দোজাহানের সরদার, শাফায়াতের কান্ডারী হযরত মুহাম্মদ (দ.) ৫৭০ সালের ১২রবিউল আউয়াল সোবহে সাদিকের সময় মক্কার কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন।এ পৃথিবীতে তার আগমনে অসমান জমিন সহ কুল কায়েনাতের সকল সৃষ্টি খুশী হয়ে আনন্দ উদযাপন করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতি বৎসর সমগ্র মুসলিম বিশ্বের মুসলমানরা এদিনের সম্মানে ,স্মরণে ও পুণ্যের প্রত্যাশায় খুশি, আনন্দ উদ্যাপন করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে। রাসুল (দ.) এর জন্মের এ দিন থেকে শুরু করে মাসব্যাপী কিংবা সারা বৎসরব্যাপী তার জীবনী আলোচনা, তাকে সম্মান ও সালাম জানানো হয় এবং এ উপলক্ষে ধর্মীয় বিভিন্ন পুণ্য কার্যাদী সম্পন্ন হয় তাকে মিলাদুন্নবী (দ.) নাম দেওয়া হয়। একটি পক্ষ এদিনে খুশী উদযাপন করা, জুলুস করা, ফাতেহাখানি করা ,যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করাকে শরীয়ত বিরোধী ও বেদাত বলে দাবী করেন। ঐদিনের পরবর্তী আনুষ্ঠানাদিকে মিলাদুন্নবী (দ.) নামের পরিবর্তে সিরাতুন্নবী (দ.) বলতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। উভয় শব্দ প্রয়োগে আয়োজিত অনুষ্ঠানাদির উদ্দেশ্য ও পদ্ধতিগত মিল থাকলেও নাম নিয়ে বিতর্ক করে থাকে। যাকে আমরা শুধু বিরোধীতার খাতিরে বিরোধীতা বলে বিবেচনা করতে পারি। কেননা ব্যক্তির জন্মের মধ্য দিয়ে তার মহানত্বের বিকাশ ঘটে। তারই সূত্র ধরে বিশ্বজুড়ে মহান ব্যক্তিবর্গের স্মরণ হয় তার জন্মদিন ও মৃত্যুদিবসকে কেন্দ্র করে। আল্লার নবীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। রাসুল (দ.) এর জন্ম ও ওফাত একই মাসে হয়েছে। এজন্য একটি শ্রেণী প্রশ্ন রাখেন নবী করিম (দ.) জন্মদিনে মিলাদুন্নবী আয়োজনের মধ্য দিয়ে খুশি উদযাপন করা হলেও ওফাত দিবসের স্মরণে কেন শোক প্রকাশ করা হয়না ? এক্ষেত্রে তাদের দাবি অনুযায়ী শোকের সংজ্ঞা,আকার, গতি, প্রকৃতি মুসলিম উম্মাহর নিকট প্রকাশ করা দরকার। তাহলেই পরে মুসলিম উম্মাহ বিবেচনা করতে পারত।নবী করিম (দ.) এর বেলাদত বা ওফাত যাই হোকনা কেন সবগুলোইতো তার জীবনাদর্শ আলোচনা , তার প্রতি সম্মান, দোয়া ,যিকির মিলাদ ইত্যদী পালনের মাধ্যমে পালিত হয়। সুতরাং এখানে আলাদাভাবে মিলাদুন্নবী পালন করছে বলে প্রিয় নবীর ইন্তেকালে শোক প্রকাশও করতে হবে এমন ধারণা একেবারে অমূলক। যাই হোক ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা এটা কোন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের নতুন আবিস্কৃত অনুষ্ঠান নয়। যুগে যুগে কালে কালে ঐশী কোন নির্দেশনা বা নেয়ামত প্রাপ্তিতে খুশি উদযাপন করা এটি একটি চিরায়ত নিয়ম হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। হযরত (দ.) এর আগমনের পূর্বেও এ রীতি বিরাজমান ছিল রাসুল (দ.) নিজেও এরীতি শিক্ষা দিয়েছেন। তার ইন্তেকালের পরেও তার উম্মতেরা বিশ্বের সকল প্রান্তে তা পালন করে আসছে। ইসলামী শরীয়তও তা পালনে নির্দেশনা দিয়েছেন।ইসলামী শরীয়তের অন্যতম উৎস কুরআনুল করীমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন“ হে নবী আপনি বলে দিন যেন (বান্দারা) আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত প্রাপ্তিতে আনন্দ, খুশি উদযাপন করে(সুরা ইউনুছ ৫৮)। আল্লামা জালাল উদ্দিন ছুয়ুতি (রহ.) তার রচিত গ্রন্থ “আদদুররুল মনচুর ” নামক গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছ (রা.) হতে বর্ণনা করেন আলোচ্য আয়াতে “অনুগ্রহ” দ্বারা “জ্ঞান” এবং“ রহমত ” দ্বারা “হযরত মুহাম্মদ(দ.)” কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। কেননা আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত মুহাম্মদ (দ.) সর্বশ্রেষ্ঠরহমত । আল্লাহ নিজেই এবিষয়ে ঘোষণা দিয়েছেন। ইরশাদে করেছেন “আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরন করেছি”(সুরা আনবিয়াহ ) সুতরাং কুল কায়েনাতের জন্য হযরত মুহাম্মদ (দ.) এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ রহমত দ্বিতীয় কিছু নেই। আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী তার এর এ অতুলনীয়, অদ্বিতীয় রহমত প্রাপ্তিতে খুশি আনন্দ উদযাপন করা আমাদের ইমানী দায়িত্ব। আমরা কুরআনুল করীমে দেখতে পাই পূর্ববর্তী নবীরা আল্লাহর রহমত ও নেয়ামত প্রাপ্তিতে আনন্দ উদযাপন করত। যেমন হযরত ঈসা (আ.) এর পবিত্র কোরআনুল করীমে বর্ণিত হয়েছে এভাবে“ হে আমাদের প্রতিপালক আপনি আমাদের জন্য আসমান থেকে মায়েদা তথা ঐশী নেয়ামত অবতীর্ণ করুন যাতে (অবতীর্ণের ঐ সময় ) আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সম্প্রদায়ের জন্য খুশি ও আনন্দ উদযাপনের উপলক্ষ হয়। (সুরা মায়েদা ১১৪) আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে রুহুল বয়ান গ্রন্থকার আল্লামা ঈসমাঈল হক্কী (রহ.) বলেন এ দোয়ার লক্ষ্য উদ্দেশ্য হল যেন অবতীর্ণের দিনকে ঈদের দিন হিসেবে আমরা সম্মানের সাথে উদযাপন করতে পারি। হযরত ঈসা (আ.) স্বীয় জম্মাদিনকে সম্মানের সাথে স্মরণ করেছেন। তার জম্মদিনের স্মরণের এ বিষয়টি পবিত্র কুরআনুল করীমের মধ্যে ইরশাদ হয়েছে এভাবে“সালাম ঐদিনের উপর যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন আমি ইন্তেকাল করব,এবং যেদিন আমি জীবিত প্রেরিত হব( সুরা মরিয়ম৩৩)। হযরত ইসা(আ.) এর পাশাপাশি আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) ও জম্মদিনের সম্মানার্থে রোজা পাালন করতেন যেমন হাদীসে পাকে এসেছে “ হযরত কাতাদাহ (রা.) হতে বর্ণিত নিশ্চয় রাসুল(দ.)কে সোমবার দিন রোযা রাখার কারণ প্রসংগে প্রশ্ন করা হয়েছিল তখন রাসুল (দ.) প্রতি উত্তরে বলেন এদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি”।(আল হাদীস) এভাবে দেখা যায় জন্মদিনের সম্মানে বিভিন্ন পুণ্যময় কাজ করা সকল নবীদের সুন্নাত। আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলী (রহ.) তার রচিত “লতায়েফুল মাআরেফ ফিমা লি মাওয়াসিমিল ওয়াজায়েফ” নামক গ্রন্থে বলেন “আল্লাহর নেয়ামত লাভের বা অবতীর্ণের দিন রোযা রাখা মুস্তাহাব। এহিসেবে উম্মতে মুহাম্মদির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত হল হযরত মুহাম্মদ (দ.)। এ কথাটি স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কুরআনল করীমে ইরশাদ করেছেন“আল্লাহ তায়ালা মোমেনদের উপর বড় অনুগ্রহ করেছেন তাদের মাঝে তাদের মধ্য থেকে রাসুল প্রেরণ করেছেন (সুরা আলে ইমরান ১৬৪ ) সুতরাং প্রিয়নবী (দ.) এর পৃথিবীতে আগমনি দিনে খুশি আনন্দ উদযাপন করা প্রত্যেক মোমেনের ঈমানী দায়িত্ব। আমরা আরও দেখতে পাই প্রিয় নবী (দ.) বিদায় হজ্বের সমযে আরাফর দিন কুরআনুল করীমের আয়াত “আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দিনাকুম ওয়া আতমামতু আলাইকুম নেমাতি ওয়া রাদিতু লাকুমুল ইসলামা দিনা”( সুরা মায়েদা ০৩) আয়াতটি নাযিল হওয়ার কারণে রাসুল (দ.)আরাফার দিন এবং ঐদিন জুমার দিন হওয়াতে দুইদিনকে ঈদ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।এ সংক্রান্ত একটি হাদীস ইমাম তিরমিযী (রহ.)স্বীয় হাদীস গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছ (রা.) হতে বর্ণনা করেছেন। আল্লামা জালাল উদ্দিন সূয়ূতি (রহ.) এর উদ্ধৃতি দিয়ে “তাফসীরে রুহুল বয়ান”গ্রন্থকার বলেন হুযুর (দ.) এর দিনে শুকরিয়া আদায় করা আমাদের নিকট অত্যন্ত প্রিয়কাজ ছিল।“মাজমায়ে বিহারুল আনোয়ার” তয় খÐের ৫৫ পৃষ্ঠায় গ্রন্থকার বলেছেন“ নুর এবং রহমতের আলোকবর্তিকা পৃথিবীতে প্রকাশিত হওয়ার মাস হল রবিউল আউয়াল। এটা এমন একটি মাস যে মাসে আমাদের প্রতি নির্দেশনা ছিল যেন আমরা প্রতি বৎসর ঈদ তথা খুশি উদযাপন করি”। “মা ছাবাতা বিস সুন্নাহ” গ্রন্থের৭১ পৃষ্টায় গ্রন্থকার বলেছেন“ সর্বকালে মুসলমানরা বিশ্বনবীর জম্মমাসে মিলাদ মাহফিল আয়োজনের রেওয়াজ বিদ্যমান ছিল”। “আদ দুরুসুস ছামিনফি মুবাশশিরাতিন নবীয়্যিল আমিন” গ্রন্থের লেখক বর্ণনা করেছন শাহ ওয়ালী উল্লাহ মোহাদ্দেসে দেহলবী (রহ.) এর পিতা শাহ আবদুর রহিম মোহাদ্দেসে দেহলবী (রহ.) প্রতিবৎসর নবী করিম (দ.) এর জন্মদিনে ভাল খাবার রান্না করে সাধারণ জনগণের নিকট বন্টন করতেন। একবৎসর দূর্ভিক্ষজনিত কারণে ভাল খাবার ঐরী করতে পারেনি তিনি বলেন ঐ বৎসর আমি শুধু চনা রান্না করে সাধারণ মানুষকে খাওয়ালাম। ঐ রাতে আমি আমার রাসুল (দ.) কে দেখেতে পাই চনা (ছোলা) গুলো রাসুল (দ.) এর সামনে উপস্থিত। যার উপর রাসুল (দ.)সন্তুষ্ট ছিলেন।“হুসনুল মাকসাদ ফী আমলিল মাওলাদ” গ্রন্থের রচয়িতা আল্লামা জালাল উদ্দিন আবদুর রহমান আসসুয়ূতি (রহ.) ঈদে মিলাদুন্নবীর উৎপত্তির ইতিহাস বর্ননা করতে গিয়ে বলেন “ মিলাদুন্নবী (দ.) উপলক্ষে বর্তমান যুগের আয়োজন (বর্তমান যুগের টাইগ্রিস নদীর পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত) ইবরিল শহরের শাসক সুলতান মুজাফফরের আমলে হয়েছে। তার পুরো নাম হল সুলতান আবু সাঈদ কৌকরবী ইবনে যাইনুদ্দিন ইবনে বক্তগীন। ( মৃত্যু ৬৩০ হিজরী) তিনি সমকালীন যুগের ক্ষমতাশালী, স্বাধীন , দানশীল শঅসক ছিলেন।তার কীর্তি, সুনাম , এবং বীরত্বপূর্ণ অনেক কর্মকাÐ রয়েছে। তাঁর স্মরণে জামে মুজাফফরী এখনো সে শহরে বিদ্যমান। সুলতান মুজাফফর মিলাদ শরীফকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন পবিত্র মন এবং ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে পালন করার পাশাপাশিজাঁক জমক সহকারে শোভাযাত্রা বাহির করতেন। শায়খ আবুল খাত্তাব ইবনে দাহয়াহ(রহ.) “ আত্ তানভীর ফী মাওলেদীল বাশীর ওয়ান নযীর”শীর্ষক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থের মূল বিষয় হলো প্রিয় রাসুলের জন্মদিনে মিলাদ পালনের বৈধতা প্রমাণ করা। ইহাতে সুলতান খুশি হয়ে উপহার তাকে এক হাজার দিনার দান করেন। আল্লামা ইবনুল জুযি তার রচিত গ্রন্থ “মিরআতুয যামান ” নামক গ্রন্থে সুলতান মোজাফফর কর্তৃক আয়োজিত মীলাদ শরীফের বিশাল কর্মযজ্ঞের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন বাদশা উপস্থিত মেহমানদের জন্য শাহী দস্তরখানা বিছাতেন এবং সেখানে দামী খাবার ও মিষ্টান্ন খাবারের ব্যবস্থা করতেন। তার মিলাদ মাহফিলে শীর্ষ পর্যায়ের ওলামায়ে কেরাম এবং সুফগীণকে আমন্ত্রণ জানানো হত। তাদেরকে রাজকীয় উপহার দেওয়া হত। সেখানে তিনি সেমা মাহফিলের আয়োজন করতেন । এতে প্রমাণিত হয় ঈদে মিলাদুন্নবী নতুন কোনে অনুষ্ঠান নয় এটি একটি ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান।
লেখক : ইতিহাস বিভাগ
কামালে ইশকে মুস্তফা(দ.)ফাজিল মাদরাসা
পূর্ব বাকলিয়া, চট্টগ্রাম