ইস্রা ও মে’রাজের সত্যতা প্রমাণে ইসলাম, বিজ্ঞান ও তাসাউফের দৃষ্টিভঙ্গি এক ও অভিন্ন

37

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

প্রিয়নবীজির ইস্রা ও মে’রাজের সত্যতা প্রমাণে ইসলাম, বিজ্ঞান ও তাসাউফের দৃষ্টিভঙ্গি এক ও অভিন্ন।ইসলাম ওতাসাউফ বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের যে সকল তথ্য দ্বারা মে’রাজকে সহজে বুঝা যায়, তার সাথে বিজ্ঞানের সূত্রগুলোর কোনো দ্বিমত বা গরমিল দেখা যায়না। বরং পরস্পর পরস্পরকে সমর্থন করে।
বিজ্ঞান ও তাসাউফের দৃষ্টিতে বিশ্বের শ্রেণী বিন্যাস :
সম্মানিত সূফীগণ সমগ্র সৃষ্টিকে তিনটি ‘আলম’ বা জগতে বা স্তরে বিভক্ত করেছেন। অনুরূপভাবে বিজ্ঞানও সমগ্র সৃষ্টিকে তিনটি জগতে বা স্তরে বিভক্ত করেছে। সম্মানিত সূফীগণ বর্ণিত এ তিনটি স্তরের প্রথমটি হচ্ছে, ‘আলমে শাহাদাত বা আলমে খালক’ অর্থাৎ ব্যক্তিজগৎ বা দৃশ্যজগৎ। দ্বিতীয়স্তরটি হচ্ছে, ‘আলমে গায়েব’ বা অদৃশ্য জগৎ। এটি আমাদের স্থূল ইন্দ্রিয়জ্ঞানের অতীত এক সূ² জগৎ। তৃতীয়স্তরটি হচ্ছে, ‘আলমে মেসাল’ বা প্রতিরূপ জগৎ।
অনুরূপভাবে বিজ্ঞান বর্ণিত বিশ্বও ইলমে তাসাউফ বর্ণিত বিশ্বের মতোই তিনটি স্তরে বিভক্ত। যথা- জড়জগৎ, অতীন্দ্রিয়জগৎ ও ঋণাত্মক পদার্থ জগৎ বা প্রতিরূপ জগৎ। এতে দেখা যায় তাসাউফ ও বিজ্ঞানের ধারণা এ ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন।
তাসাউফের এ তত্তে¡র ভিত্তিতে মে’রাজের বিশ্লেষণ :
প্রথমে বলে রাখা দরকার; তাসাউফের পরিভাষায় পূর্বে বর্ণিত ‘আলমে মেসাল’ বা প্রতিরূপ জগৎ হচ্ছে পূর্ববর্তী জগৎ দুটোরই অবিকল প্রতিরূপ- ঠিক যেন দর্পণে প্রতিফলিত প্রতিবিম্ব। জড়জগৎ ও অদৃশ্য জগতের জড়ও অজড় সবকিছুই এখানে প্রতিবিম্বিত রূপে বর্তমান। এ জগতের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে; এখানে স্থান, কাল ও গতি বলে কিছু নেই, এখানে সবই বর্তমান। স্থান, কাল ও গতি এখানে পরস্পরের সাথে মিশে একাকার হয়ে আছে।
তাসাউফের তত্তে¡র ভিত্তিতে মে’রাজকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মাসজিদে হারাম থেকে মাসজিদে আকসা পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিভ্রমণ ছিল জড়জগতের ভ্রমণ। অতঃপর সেখান থেকে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত ভ্রমণ হচ্ছে আলমে গায়েব বা সূ²জগৎ পরিভ্রমণ এবং সর্বশেষে আরশে আযিম পর্যন্ত যে আলাদা জগৎ তিনি পরিভ্রমণ করেন, তা হচ্ছে আলমে মেসাল বা প্রতিরূপ জগৎ। তিনি এ জগতে প্রবেশ করেই স্থান-কালের অতীত অবস্থায় সৃষ্টির সব রহস্য অবগত হন এবং অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যতের সবকিছু চাক্ষুষ দর্শন করেন এবং আল্লাহ তাআলার দিদার লাভে ধন্য হন ও তাঁর সাথে কথোপকথন সম্পন্ন করে পুনরায় জড়জগতে ফিরে আসেন। ফিরে এসে দেখেন যে, পৃথিবীর সময়ের হিসাব মোতাবেক অতি সামান্য সময়ই এতে অতিবাহিত হয়েছে। সুতরাং বিজ্ঞান মে’রাজকে আরো সহজে বোঝার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
বিদ্যুৎ (ঊষবপঃৎরপরঃু) এর গতি, বোরাক, মি‘রাজ ও রফরফের গতি এবং নবীজির নূরানী দেহ মুবারক :
মিরাজে ব্যবহৃত বাহন ‘বোরাক’ শব্দটি আরবি ‘বারকুন’ শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হলো বিদ্যুৎ (ঊষবপঃৎরপরঃু)। এটা নূরের তৈরি জান্নাতি বাহন। বিজ্ঞানীদের মতে আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ১,৮৬০০০ (এক লাখ ছিয়াশি হাজার) মাইল। শাব্দিক অর্থ বিবেচনায় বোরাকের গতি অন্তত আলোর গতির সমান ছিল বা তারও বেশিই ছিল। যার কারণেই অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সপ্তাকাশ ভ্রমণ সম্ভব হয়েছে। বোরাকের দ্রæতগতির বর্ণনা দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, বোরাক নিজ দৃষ্টি সীমার শেষ প্রান্তে প্রতিটি কদম ফেলে। এতে বুঝা যায় বোরাক কত দ্রæতগতির বাহন ছিল। বোরাকের গতির প্রকৃত জ্ঞান এখনও হয়তো মানুষের অর্জনই হয়নি।
মসজিদে আকসা থেকে ঊর্ধ্বলোকের ভ্রমণের জন্য ব্যবহৃত বাহনের নাম হল, ‘মি‘রাজ’। এটি আরবী শব্দ, যার শাব্দিক অর্থ সিঁড়ি। এটি সাধারন কোন সিঁড়ি ছিলনা বরং এটি ছিল নূরের তৈরী ঊর্ধ্বগামী সিঁড়ি, যার গতি বিদ্যুৎ (ঊষবপঃৎরপরঃু) এর গতির চেয়েও অধিক ছিল। বোরাকে চড়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই সিঁড়িতে আরোহন করেন। ফলে বোরাকের গতির সাথে নূরের তৈরী ঊর্ধ্বগামী এ সিঁড়ির গতি যোগ হওয়াতে গতি কত বেড়ে গিয়েছিল তা মহান আল্লাহই ভালো জানেন। বিজ্ঞানীদের বক্তব্য হচ্ছে, আলো অপেক্ষা আলোর তরঙ্গের গতি আরও অধিক। বোরাক ও মিরাজে ব্যবহৃত সিঁড়ির সমন্বিত গতি আলো ও আলোর তরঙ্গের গতি থেকেও বেশি ছিল। কারণ মিরাজের জন্য এ যানটি বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল।
আর ‘রফরফ’ হলো বোরাকের চেয়েও শক্তিশালী, যা মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। ‘রফরফ’-এর আভিধানিক অর্থ নরম তুলতুলে, সবুজ বিছানা। সূর্যরশ্মির চেয়েও ক্ষিপ্র তার গতিবেগ।
‘বোরাক’, ‘মিরাজ’ ও ‘রফরফ’ মানসদেহ অপেক্ষা অধিকতর সূ², শক্তিশালী, প্রযুক্তিময়, যা স্থান-কালের মাঝে কোন সীমা-পরিসীমা ছাড়াই সসীমে মিশে যেতে পারে। এসবগুলোই ছিল বিদ্যুৎ জাতীয়নূরের বাহন।
অন্য দিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেহ মোবারকও নূরের তৈরি। তাই আলোর গতির চেয়েও অধিকতর দ্রæতগামী কুদরতি বাহনে স্বল্প সময়ে মে’রাজ সংঘটিত হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।
তবে লক্ষণীয় যে, বিদ্যুৎ জাতীয় এ নূরের বাহনগুলো ছিল সম্পূর্ণরূপে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিয়ন্ত্রণাধীন। গতিবেগ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল বলে তা কখনো আলোর গতিবেগের সমান এবং কখনো বা প্রয়োজনের তাগিদে কমবেশি করা হয়েছিল।
কাজেই কাবা শরীফ থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত তাঁর যে পরিভ্রমণ ছিল, তাতে সম্ভবত আলোর চাইতে কম গতিবেগে ‘বুরাক’ পরিচালিত হয়েছিল বিধায়তাতে ‘রাতের কিয়দংশ’ বা সামান্য সময় লেগেছিল, কিন্তু সেখান থেকে ঊর্ধ্বলোকে তাঁর যে ভ্রমণ, তা আলোর গতিবেগের সমান বা এর চাইতেও বেশি ছিল। ফলে এ অংশের ভ্রমণে কাল ছিল স্থবির এবং পরে পশ্চাৎগামী। বিশেষ করে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ হতে ‘আলমে মেসাল’ বা প্রতিরূপ জগতে পরিভ্রমণের সময়‘বুরাক’ থেকে বেশি গতিবেগসম্পন্ন ‘রফরফ’ ব্যবহৃত হয়েছিল বলে সেখানে কাল ছিল পশ্চাৎগামী। ফলে তিনি সেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্যক অবহিত হয়েছিলেন ও চাক্ষুষ পরিদর্শন করেছিলেন। সব মিলিয়ে তাঁর পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত সময় লেগেছিল অতি সামান্য।
অতএব প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মে’রাজ যে স্বশরীরে হয়েছিল আজকের বিজ্ঞানের মহাকাশ বিজয়ই তার উজ্জ্বল প্রমাণ।
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম :
কারও কারও দাবী, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কাজ হল শূন্যে অবস্থিত ভূ-মÐলের যে কোনো স্থূল বস্তুকে নিচের দিকে টেনে নামানো, তাই কোনো স্থূল দেহী মানুষের দ্বারা মহাকাশ ভ্রমণ সম্ভব নয়। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান তা প্রত্যাখ্যান করছে এবং বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করলেন যে, শূন্যে অবস্থিত যে কোনো স্থূল বস্তুকে পৃথিবী যেসব সময়সমানভাবে আকর্ষণ করতে পারে না আজ তা পরীক্ষা-নিরীক্ষায়সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তাঁরা বলেন, প্রত্যেক গ্রহেরই নিজস্ব আকর্ষণ শক্তি রয়েছে। সূর্য ও পৃথিবী একে অন্যকে টেনে রাখে। এ টানাটানির ফলে উভয়ের মাঝখানে এমন একটা স্থান আছে, যেখানে কোনো আকর্ষণ-বিকর্ষণ নেই। যার ফলে পৃথিবীর কোনো বস্তু যদি সীমানা পার হয়ে সূর্যের সীমানায় যেতে পারে, তা হলে তা আর পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। গতিবিজ্ঞানের মতে, পৃথিবী থেকে কোনো বস্তুকে প্রতি সেকেন্ডে ৬.৯০ অর্থাৎ ৭ মাইল বেগে ঊর্ধ্বলোকে ছুড়ে দেওয়া হলে তা আর পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। আবার পৃথিবী থেকে কোনো বস্তু যতই ওপরে উঠবে ততই তার ওজন কমবে। যার ফলে অগ্রগতি ক্রমেই সহজ হয়ে যাবে। আধুনিক বিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবী থেকে কোনো বস্তুর দূরত্ব যতই বাড়ে, ততই তার ওজন কমে, পৃথিবীর এক পাউন্ড ওজনের কোনো বস্তু ১২ হাজার মাইল ঊর্ধ্বে মাত্র এক আউন্স হয়ে যায়।
আর আমরা আগেও প্রমাণ করেছি যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানব ছিলেন বলে আমাদের মতো জড় উপাদান বিশিষ্ট মানব ছিলেন না। তাঁকে জড়দেহী মানুষ বেশে দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি জড়ধর্মী ছিলেন না। তিনি জ্যোতি বা নূর দিয়ে সৃষ্ট। নূরের কোনো ওজন নেই। তাই তাঁর দেহ মুবারক নূরের তৈরি হওয়াতে মূলত তাঁর পক্ষে মহাকাশ ভ্রমণ ছিল খুবই স্বাভাবিক।
পরিশেষে বলা যায়, প্রকৃতপক্ষে মানুষের কাছে যা অসাধারণ বা অসাধ্য আল্লাহর কুদরতের কাছে তা একেবারেই সাধারণ ও পরিপূর্ণ সম্ভব। মিরাজের গোটা ঘটনাটিই মানুষের কাছে বিস্ময়কর হলেও বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারের মাধ্যমে তার সম্ভাব্যতা প্রমাণ হয়েছে। কিয়ামত অবধি তা আরও স্পষ্ট হতে থাকবে। মে’রাজ বিজ্ঞানীদের চিন্তা ও গবেষণার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি মিরাজের সত্যতাকে বারবার প্রমাণ করেছে। ভবিষ্যতে আরও করতে থাকবে। মে’রাজকে কেন্দ্র করে গবেষণা অব্যাহত রাখলে বিজ্ঞানীরা আরও বহুদূর এগিয়ে যাবেন নিঃসন্দেহে। তাতে ঈমানদারদের ঈমান-বিশ্বাস আরও সুদৃঢ় হবে এবং কুরআনুল করীম ও হাদীস শরীফের সত্যতা আরও মজবুতভাবে প্রমাণিত হবে।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন
বিশ্ববিদ্যালয়, খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ