ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকার

38

 

মানুষ হিসাবে আমাদেরকে সমাজবদ্ধ জীবন যাপন করতে হয়। সমাজে বসবাস করতে গেলে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। এ সমাজ ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে প্রতিবেশী। প্রতিবেশী ভালো হলে সামাজিক জীবন সুন্দর ও মধুময় হয়। এর বিপরীতে প্রতিবেশী মন্দ হলে সমস্যার কোনো শেষ থাকে না। এক প্রতিবেশী অন্য প্রতিবেশী ও তার সন্তানদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে থাকে পরস্পর মেলা-মেশা ও দেখা-সাক্ষাতের কারণে। সে হিসেবে প্রতিবেশী যদি সৎ হয় তাহলে ব্যক্তির ঘর ও পরিবার নিরাপদ থাকে। আর যদি অসৎ হয়, তাহলে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অকল্যাণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভালো প্রতিবেশী তার প্রতিবেশীর গোপন কোন বিষয় অবহিত হলে তা গোপন রাখে। আর অসৎ প্রতিবেশী তা প্রকাশ ও প্রচার করে বেড়ায়। ভালো প্রতিবেশী ভালো কাজে সাহায্য করে, সৎ উপদেশ দেয়। আর অসৎ প্রতিবেশী ধোঁকা দিয়ে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে। তাই ইসলামে সৎ প্রতিবেশী নির্বাচনের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বলা হয় ‘বাড়ি বানানোর পূর্বে প্রতিবেশী নির্বাচন কর’।
প্রতিবেশী কারা ? মূলত নিজ বাড়ির আশে-পাশে বসবাসকারীকে প্রতিবেশী বলা হয়। নিজের বাড়ীর চতুর্দিকে চল্লিশ ঘর পর্যন্ত হচ্ছে প্রতিবেশীর সীমানা। আবার কেউ কেউ বলেন, যে তোমার সাথে ফজর পড়ল সেই তোমার প্রতিবেশী। তবে নিজের বাড়ীর পাশে যার বাড়ী সেই আসল প্রতিবেশী। সে হিসেবে নিজ বাড়ীর সাথে লাগানো বা কাছাকাছি প্রতিবেশীর প্রতি দূরের প্রতিবেশীর চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। সফর সঙ্গী অথবা কাজের সঙ্গীকেও প্রতিবেশী বলা হয়। অনুরূপভাবে বাজার, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির অভিন্নতার দিক থেকেও প্রতিবেশী হতে পারে। নিজ দেশের পার্শ্ববর্তী দেশও প্রতিবেশীর অন্তর্ভুক্ত।
প্রতিবেশী কয় প্রকার : প্রতিবেশী তিন প্রকার। এক ধরনের প্রতিবেশী আছে যাদের অধিকার তিনটি। তারা হলেন, নিকটাত্মীয়-মুসলমান-প্রতিবেশী। আর তার অধিকার তিনটি হলো: আত্মীয়তা, ইসলাম ও প্রতিবেশীত্ব। আরেক ধরনের প্রতিবেশী আছে যাদের অধিকার দু’টি। তারা হলেন, অনাত্মীয় মুসলিম প্রতিবেশী। এ প্রতিবেশীর অধিকার হলো, প্রতিবেশীত্ব ও ইসলাম। আরেক ধরনের প্রতিবেশী রয়েছে, যাদের অধিকার শুধুমাত্র একটি। আর তারা হলেন, অমুসলিম প্রতিবেশী। এ প্রতিবেশীর অধিকার শুধু প্রতিবেশীত্ব।
প্রতিবেশী সম্পর্কে ইসলামের দিক-নির্দেশনা : মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন: “পেতামরা ইবাদত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতা-পিতার সাথে, নিকট আত্মীয়ের সাথে, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকট আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে। নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিক, অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না ” (সূরা আন নিসা : ৩৬)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন : “জিবরীল আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে অনবরত অসিয়ত করতে থাকেন। এমনকি এক পর্যায়ে আমার ধারণা হয়েছিল যে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে (প্রতিবেশীকে) উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেবেন” (বুখারী ৬০১৪ ও মুসলিম ২৬২৪)
তিনি আরও ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন কল্যাণমূলক কথা বলে, না হয় চুপ থাকে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন স্বীয় প্রতিবেশীর সম্মান রক্ষা করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন নিজ মেহমানের মেহমানদারী করে” (বুখারী-৬০১৮ ও মুসলিম-৬৬০.২৮৮০,২৮৮১)।
তিনি আরও ইরশাদ করেন, “আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম সঙ্গী সে, যে তার সঙ্গীর কাছে উত্তম। আল্লাহর নিকট সেই প্রতিবেশী সর্বোত্তম, যে তার প্রতিবেশীর দৃষ্টিতে সর্বাধিক উত্তম।”(তিরমিযী ১৯৪৪, আহমাদ ৬৫৬৬, দারমী ২৪৩৭, বুখারী: আদব আল মুফরাদ-১১৫,)
একবার এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে আরয করলেন, হে আল্লাহর প্রিয় রাসূল, আমাকে এমন একটি কাজ বলে দিন, যা করলে আমি জান্নাতে যেতে পারব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, পরোপকারী হও। লোকটি আরয করলেন, আমি কিভাবে বুঝব পরোপকারী হয়েছি কি না? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমার প্রতিবেশীর কাছে জিজ্ঞেস করো। সে যদি বলে যে, তুমি পরোপকারী, তাহলে তুমি পরোপকারী (হাকেম, হা-১৩৩১)।
কথা ও কাজের মাধ্যমে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া হারাম : যেমন, তাকে অভিশাপ দেয়া, তার গীবত করা, কটুকথা বলা, নিন্দা করা, গোয়েন্দাগিরি করা, পরনিন্দা করা, তিরস্কার করা, উত্ত্যক্ত করা, গালি দেয়া, কুৎসা রটানো, খোঁটা দেয়া, গোলযোগ ও মনোমালিন্য সৃষ্টি করা, উপহাস করা, ছিদ্রান্বেষণ করা ইত্যাদি হারাম। এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর প্রিয় রাসূল! অমুক মহিলা প্রচুর নফল নামাজ, রোজা ও সদকার জন্য প্রসিদ্ধ। কিন্তু প্রতিবেশীকে কটুকথা বলার মাধ্যমে কষ্ট দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে জাহান্নামে যাবে। লোকটি আবার আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর প্রিয় রাসূল! অমুক মহিলা সম্পর্কে খ্যাতি রয়েছে যে, সে নফল নামায, রোযা ও সদকা করে না; কিন্তু নিজের জিহŸা (কথা) দিয়ে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। আল্লাহর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে জান্নাতে যাবে।’ (আহমদ ২/৪৪০)
তাই প্রকৃত ঈমানদার মানুষের দ্বারা কখনো তার প্রতিবেশী কষ্ট পেতে পারে না। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: “আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মু’মিন নয়। আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মু’মিন নয়। আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মু’মিন নয়। প্রশ্ন করা হলো- হে আল্লাহর রাসূল! ‘কোন ব্যক্তি?’ তিনি ইরশাদ করেন: “যার প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ নয়।” (সহীহুল বুখারী ৬০১৬)
প্রতিবেশীল খোঁজ-খবর নেয়া ঈমানের পরিচয় : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: “সেই ব্যক্তি মু’মিন হতে পারে না, যে ব্যক্তি নিজে পেট ভরে পানাহার করে, কিন্তু তার পার্শ্বেই প্রতিবেশী খাদ্যের অভাবে অভুক্ত থাকে।” (বুখারী: আদব আল মুফরাদ-১১২, হাকেম-৪/১৬৭, , ত্বাবরানী: মুজামুল কবীর, ৩/১৭৫ )।
তিনি আরও ইরশাদ করেন: ‘দরিদ্র প্রতিবেশী কিয়ামতের দিন ধনী প্রতিবেশীকে জাপটে ধরে বলবেঃ হে আল্লাহ, এই ভাইকে তুমি সচ্ছল বানিয়েছিলে এবং সে আমার নিকটেই থাকত; কিন্তু আমি ভুখা থাকতাম আর সে পেটপুরে খেত। তাকে জিজ্ঞেস করো, কেন সে আমার ওপর দরজা বন্ধ করে রাখত এবং আমাকে বঞ্চিত করত।(ইহয়াউল উলূম ২/২১৩)
তিনি আরও ইরশাদ করেন: “কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে দুই ব্যক্তির মামলা আল্লাহর আদালতে বিচারার্থে পেশ করা হবে তারা হবে দু’জন প্রতিবেশী।” (আহমদ,হা-১৭৪১০, ত্বাবরানী: মুজামুল কবীর, হা-৮৩৬, ৮৫২)
উপঢৌকন প্রদান করা : প্রতিবেশীকে মাঝে মধ্যে কিছু উপহার প্রদান করা উচিৎ। এর মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক, ভালোবাসা বৃদ্ধি পায় ও দ্ব›দ্ব নিরসন হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ‘তোমরা পরস্পরকে উপঢৌকন দাও, তাতে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।’ (বুখারী: আদব আল মুফরাদ-৫৯৪, বায়হাক্বী: সুনান আল কুবরা, হা-১২২৯৭, )
হযরত আবূ যার রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:, “হে আবূ যার! যখন তুমি ঝোল (ওয়ালা তরকারি) রান্না করবে, তখন তাতে পানির পরিমাণ বেশী করে দেবে। অতঃপর তোমার প্রতিবেশীর বাড়ীতে তা পৌঁছে দাও। (মুসলিম, ৪/২০২৫, হা- ২৬২৫)
তিনি আরও ইরশাদ করেন: “হে মুসলিম রমণীগণ! কোন প্রতিবেশী যেন অপর প্রতিবেশীর দেয়া কোন উপঢৌকনকে তুচ্ছ মনে না করে। যদিও তা একটি বকরীর সামান্য পায়াও হয়।” (বুখারী ২৫৬৬ ও মুসলিম ১০৩০)
হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, “ইয়া রাসুল! আমাদের দ’ুজন প্রতিবেশী আছেন। আমি উপঢৌকন পাঠাতে চাই একজনের কাছে। এখন আমি কার কাছে পাঠাবো?” তিনি ইরশাদ করেন:, “ঐ প্রতিবেশীকে পাঠাবে, যার ঘর তোমার ঘরের অধিক নিকটে।” (বুখারী ৬০২০,২২৫৯, আবূ দাউদ ৫১৫৫)
প্রতিবেশী অমুসলিম হলেও উপহার দেয়া: হযরত ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমার একজন ইহুদি প্রতিবেশী ছিল। যখনই তাঁর বাড়ীতে ছাগল জবাই হতো, তিনি বলতেন, আমার ইহুদি প্রতিবেশীকে কিছু গোশত দিয়ে আস। (তিরমিযী, হা-১৯৪৩)।
প্রতিবেশীর প্রতি আরও কিছুৃ কর্তব্য: প্রতিবেশীকে সালাম দেওয়া, তার সালামের উত্তর দেয়া, কেউ অসুস্থ হলে তার সেবা করা, বিভিন্ন উপলক্ষে তাকে দাওয়াত দেয়া এবং তার দাওয়াতে অংশগ্রহণ করা, প্রয়োজনে সাহায্য করা, কোন জিনিস ব্যবহার করতে চাইলে তা দেয়া ইত্যাদি। প্রতিবেশীর দুঃখ-কষ্টে যেমন সহমর্মিতা দেখাতে হবে, তেমনি তার ভাল কোন সংবাদ যেমন-সন্তান জন্ম নিলে, তার সন্তান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে, কারো বিয়ে হলে এবং এ জাতীয় উপলক্ষে তাকে মোবারকবাদ জানানো এবং বরকতের দোয়া করতে হবে।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন
বিশ্ববিদ্যালয়, খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ