ইউক্রেনে মানবিক বিপর্যয়

12

পূর্বদেশ ডেস্ক

অবরুদ্ধ ইউক্রেনে পদে পদে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। যে যেভাবে পারছেন জীবন নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। খাবার ফুরিয়েছে, বরফ গলিয়ে খেতে হচ্ছে পানি, হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রায় শরীর উষ্ণ রাখতে জ্বালাতে হচ্ছে কাঠ, রাস্তায় লাশের সারি। সমাধিক্ষেত্রে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। তাই গণকবর দেয়া হচ্ছে নিহতদের লাশ। এক একটি গণকবরে ৩৩টি পর্যন্ত লাশ। এই চিত্র সপ্তাহখানেক ধরে রুশ বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে থাকা ইউক্রেনের বন্দরনগরী মারিওপোলের। দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ, উত্তরাঞ্চলীয় চেরনিহিভ, দক্ষিণাঞ্চলীয় মিকোলেইভসহ বিভিন্ন শহরেও এখন অনেকটা একই অবস্থা।
এসব শহরে নিয়মিত গোলা নিক্ষেপের পাশাপাশি বিমান থেকে ফেলা হচ্ছে বোমা। এতে গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, পুরো শহর হয়ে পড়ছে বিদ্যুৎহীন। আটকে পড়া বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নিতে সাময়িক যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নেওয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা কার্যকর হচ্ছে না। এ জন্য ইউক্রেন ও রাশিয়া একে অপরকে দোষারোপ করছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা জানিয়েছে, প্রায় দুই লাখ বেসামরিক নাগরিক নিজ দেশেই শরণার্থী হয়ে পড়েছে। ২০ লাখের বেশি মানুষ হাঙেরি, পোল্যান্ড এবং মলদোভাসহ কয়েকটি প্রতিবেশি দেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘ ধারণা করছে, সাড়ে চার কোটির দেশ ইউক্রেনের ৭০ লাখ মানুষ দেশের মধ্যেই বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়বে এবং দেশ ছাড়তে পারে ৫০ লাখ মানুষ। ১৯৯০ সালের বলকান যুদ্ধের পর এতো বড় শরণার্থী সংকট দেখা যায়নি।
এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রুশ হামলাকে ইউক্রেনকে নির্মূল করার যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
বিবিসি জানিয়েছে, অনেকে ইউক্রেনের শহরগুলোর পরিস্থিতিকে সিরিয়ার সঙ্গে তুলনা করছেন। সিরিয়ায় বেশ কয়েক বছরের যুদ্ধের পর এ অবস্থা দেখা গিয়েছিল। অবরুদ্ধ শহর চেরনিহিভের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তিন লাখ বাসিন্দার এই শহরে গ্যাস, ঘর উষ্ণ রাখার ব্যবস্থা এমনকি পানি সরবরাহও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আঞ্চলিক গভর্নর ভিয়াচেস্লাভ চাউস গত শনিবার এক ভিডিও বার্তায় বলেন, রুশ বাহিনী বেসামরিক স্থাপনায় হামলা চালাচ্ছে। তাতে নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর মারিওপোলে। চার লাখের বেশি মানুষের এই শহর সপ্তাহখানেকের বেশি সময় ধরে রুশ বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে রয়েছে। প্রকাশিত বিভিন্ন ছবি ও স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, অনেক আবাসিক এলাকা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে বিপণিবিতান। হামলা হয়েছে হাসপাতালেও। নিহত অনেক মানুষকে গণকবর দেওয়া হয়েছে।
শহর কর্তৃপক্ষ জানায়, এখানে দেড় হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। শনিবারও মারিওপোলের একটি মসজিদে হামলা হয়েছে।
মারিওপোলের ডেপুটি মেয়র সের্গেই ওরলোভ বলেন, শহরের বাসিন্দারা খাবার ও পানির ভয়ানক রকমের সংকটে পড়েছেন। শহরে বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, ঘর উষ্ণ করার ব্যবস্থা নেই, পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থাও কাজ করছে না। লোকজন বরফ গলিয়ে খেতে বাধ্য হচ্ছেন। কাঠে আগুন জ্বালিয়ে রান্না এবং বরফ শীতল তাপমাত্রায় নিজেদের উষ্ণ রাখার চেষ্টা করছেন।
ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভেও মানবিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। ১৪ লাখ মানুষের এই শহরও রুশ হামলায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন বহু মানুষ।
গত ২৪ ফেব্রæয়ারি ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। আজ ১৯ দিনের মতো রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনের সেনারা।
মায়ের ওষুধ আনতে গিয়ে রুশ গোলায় ছিন্নভিন্ন তরুণী : জানতেন যুদ্ধবিধ্বস্ত কিয়েভের পথে বেরোনো বিপজ্জনক। পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি। তথাপি মরিয়া হয়ে মায়ের ওষুধ আনতে বেরিয়ে ছিলেন তিনি। আর রুশ গোলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল তরুণী ইউক্রেনীয় চিকিৎসাকর্মীর দেহ। যে মানুষটা যুদ্ধে আহত মানুষের সেবাকেই জীবনের ব্রত করছিলেন, দেশ ছাড়ার সুযোগ পেয়েও বিপন্নদের হাত ছাড়েননি, মর্মান্তিক মৃত্যু হল তার।
৩১ বছর বয়সি ভ্যালেরিয়া মাকসেটস্কা আদতে দনেৎস্কের বাসিন্দা। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের শুরু থেকেই আহতদের সেবার কাজ করছিলেন তিনি। স¤প্রতি দনেৎস্কের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এর পর বাধ্য হয়ে কিয়েভের শহরতলিতে চলে আসেন ভ্যালেরিয়া। এখানেও একই কাজ করছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন ‘ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট-এ। সেই মানুষটাইরই করুণ পরিণতি হল।
এদিন মায়ের ওষুধের জন্য রাস্তায় বেরিয়ে ছিলেন। কিন্তু শহরতলির একটি এলাকায় গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর এগোতেই রুশ ট্যাঙ্কের ছোড়া গোলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তরুণী চিকিৎসাকর্মীর দেহ। কিছুদূরে দাঁড় করানো গাড়ির ভিতরে ছিলেন ভ্যালেরিয়ার মা ইরিনা ও গাড়ির ড্রাইভার। রুশ হামলায় তাদেরও মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা : যুদ্ধের আগুনে জ্বলছে ইউক্রেন। রাজধানী কিয়েভ, খারকভ কার্যত বিধ্বস্ত। এদিকে, ইউক্রেনে জোরকদমে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে রাশিয়া। পালটা মার দিচ্ছে ইউক্রেনীয় বাহিনীও। খেরসন শহরে রুশ অ্যাটাক হেলিকপ্টার গুলি করে নামানোর দাবি করেছে ইউক্রেনের সেনা। মেলিটোপলের পর নিপ্রোর মেয়রকে রুশ সেনা অপহরণ করেছে বলে অভিযোগ কিয়েভের। মিকোলাইভে দু’টি হাসপাতালে মিসাইল হামলা চালিয়েছে বলেও অভিযোগ। লিভিভের কাছে ইউক্রেনের সামরিক ঘাঁটিতে অন্তত তিরিশটি ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। ওই হামলায় ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, গতকাল ছিল ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের আঠেরোতম দিন। এতদিনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরও রাজধানী কিয়েভ দখল করতে পারেনি রাশিয়ার সেনা। ইউক্রেনের প্রবল প্রতিরোধে ক্রমে মস্কোর উপর চাপ বাড়ছে। পরিস্থিতি আরও জটিল করে ইউক্রেনকে আরও হাতিয়ার দিচ্ছে আমেরিকা। পালটা হামলার হুমকিও দিয়েছে মস্কো। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা বলেন, মারিওপোল, খারকভ, চেরনিহিভ-সহ একাধিক শহরে বোমাবর্ষণ করেছে রাশিয়া। খেরসন শহরে জনসমর্থন পেতে রাশিয়া সেখানে একটি গণভোটও পরিচালনা করার পরিকল্পনা করেছে।
মানবিক বিপর্যয়ের দায় কি পশ্চিমারা এড়াতে পারবেন : গত ২৪ ফেব্রæয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায় রাশিয়া। ভøাদিমির পুতিনের এ পদক্ষেপ ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও অখÐতা এবং ইউরোপের শান্তি পদদলিত করেছে। প্রাথমিকভাবে এ যুদ্ধের কারণ হচ্ছে সামরিক হঠকারিতা এবং একজন স্বৈরশাসকের নিজেকে ভুক্তভোগী ভাবার মানসিকতা। রুশ সমাজের গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার দিকে ঝুঁকতে না পারার ব্যর্থতাও আরেকটা কারণ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা কি যুদ্ধের ফলে ইউক্রেনে মানবিক বিপর্যয়ের দায় এড়াতে পারবেন?
গত ১৯ জানুয়ারি মার্কিন ফরেন পলিসি জার্নালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিফেন ওয়াল্ট এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের আগ্রাসী মূল্যবোধভিত্তিক বিদেশনীতি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন চালাতে প্ররোচিত করবে। তার সেই অনুমান সত্যে পরিণত হলো। ওয়াল্ট আরো বলেন, ন্যাটোর পূর্বমুখী স¤প্রসারণের প্রশ্নটির সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। তার মতে, এটা ধারণা করা মোটেই কঠিন নয় যে এ ধরনের পদক্ষেপকে রাশিয়া নিজেদের একঘরে করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখবে। এটিকে তার শাসনের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে পুতিন শেষমেশ কঠোর সামরিক পদক্ষেপ নেবেন।
এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর জেলেনস্কির সমর্থন দেশে ও বিদেশে ব্যাপক বেড়ে গেছে। রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে তার দেশের জনগণ ও সেনাবাহিনী যে প্রতিরোধ যুদ্ধ করছে, সেটার সমর্থনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানো এবং আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের সঙ্গে তার সক্রিয় কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে তার অবস্থান দৃঢ় হয়েছে। তবে তিনি সংকট নিরসন করতে এবং যুদ্ধ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন। পরস্পরবিরোধী বার্তা দিয়ে, সমর্থকদের সামনে ন্যাটোর সদস্যপদের মুলো ঝুলিয়ে, রাশিয়ার সঙ্গে নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রæতি দিয়ে এবং পশ্চিমাদের কাছ থেকে পারমাণবিক অস্ত্র চেয়ে জেলেনস্কি সমস্যাটাকে আরও জটিল করে তুলেছেন। রাশিয়ার প্রভাববলয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা নিয়ে যদি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা আরও কুশলি হতো, যদি ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ঐক্যবদ্ধ হতো এবং সংকট নিরসনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পারদর্শী হতেন, তাহলে ইউক্রেনে আজকের এই মানবিক বিপর্যয় এড়ানো যেত। সূত্র : বিবিসি, সংবাদ প্রতিদিন।